ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাজ শুরুর অপেক্ষায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট

মানুষ পোড়ানো বীভৎস রাজনীতির বিপরীতে জীবনের জয়গান

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৯ নভেম্বর ২০১৮

মানুষ পোড়ানো বীভৎস রাজনীতির বিপরীতে জীবনের জয়গান

মোরসালিন মিজান ॥ সেই মানুষ পোড়ানো বীভৎস রাজনীতির কথা মনে পড়ে? না মনে পড়ার কোন কারণ নেই। তখন ২০১৪ সাল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সারাদেশে অবরোধ ডেকেছে। মুখে বলা হচ্ছে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী। বাস্তবে অন্য। চলন্ত বাসে পেট্রোলবোমা ছোড়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন। নিরীহ-নির্দোষ মানুষ পুড়ে ছাই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষটি অফিসে যাওয়ার পথে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন। ‘আসছি মা’ বলে সকালে ঘর থেকে বের হওয়া স্কুল বালক আর ফিরছে না। সুস্থ, সবল, প্রাণবন্ত কলেজছাত্রীর দু’পা ঝলসে যাচ্ছে। শিশুটিও রক্ষা পাচ্ছে না। এমনকি ডিপোতে স্থির হয়ে থাকা বাসে আগুন দেয়া হচ্ছে। পুড়িয়ে মারা হচ্ছে ঘুমন্ত হেলপারকে। আর যারা মৃতপ্রায় তাদের ঠিকানা হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে। এখানে প্রতিদিন আসছেন দগ্ধরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে মানুষ হত্যার, জনজীবনে আতঙ্ক ছড়ানোর এই নোংরা রাজনীতি বহুদিন অব্যাহত রাখে বিএনপি-জামায়াত জোট। ফলে দেশে চরম মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে আশার কথা যে, এ অবস্থায় মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অগ্নিদগ্ধদের আহাজারি তাকে অস্থির করে তোলে। মৃতপ্রায় রোগীদের সাহস জোগাতে তিনি ছুটে যান ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে। বিছানায় রোগী। মেঝেতে রোগী। ভাল করে দাঁড়াতে পারে না। উঠে বসতে পারে না। এমনকি শুয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। সব দেখে কেঁদে ফেলেন শেখ হাসিনা। আগুনে পোড়া মানুষকে তার আগের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। তবে উন্নত গবেষণা ও সুচিকিৎসার মাধ্যমে এ ধরনের রোগীর কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে। সে লক্ষ্যে একটি ইনস্টিটিউট গড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সে অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৪ নবেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল। স্থান চানখারপুল। ঢাকা মেডিক্যাল সংলগ্ন বিশাল জায়গা। ২৭ এপ্রিল নির্মাণ কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। আর তারপর গত ২৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। নামও ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।’ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভবন যেমন অগ্নিসন্ত্রাসের প্রতিবাদ করছে, তেমনি গাইছে জীবনের জয়গান। রাজনীতির নামে নিষ্ঠুরতা নয়, মানবিক পৃথিবী চাই। ইনস্টিটিউট যেন সে কথাই বলছে শুধু। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দুই একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক ভবন। ১৮ তলাবিশিষ্ট হাসপাতালে ৫০০ শয্যা। বিশ্বের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯১২ কোটি টাকা। শুধু রোগী সারানো নয়, পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্সদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এ প্রতিষ্ঠান। মূল ভবন তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এক পাশে বার্ন ইউনিট। অন্য পাশে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। অপর বøকে একাডেমিক ভবন। এতে রয়েছে ২০টি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট, ৬০টি এসডিইউ, সর্বাধুনিক ১২টি অপারেশন থিয়েটার ও পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। থাকছে ব্যথা ও জীবাণুমুক্ত ড্রেসিং রুম। ইনস্টিটিউটটির ভ‚গর্ভস্থ তিনতলা বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং ছাড়াও রেডিওলজিসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগ রাখা হচ্ছে। আছে হেলিপ্যাডও। এর ফলে দূর-দূরান্ত থেকে অল্প সময়ের মধ্যে রোগী আনা সম্ভব হবে। বার্ন ইউনিট থেকে ইনস্টিটিউট। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি নামÑ ডাঃ সামন্ত লাল সেন। তারকা খ্যাতি সম্পন্ন চিকিৎসক বলা চলে তাকে। নতুন প্রতিষ্ঠানেরও চীফ কো-অর্ডিনেটর। বিস্তারিত জানতে সম্প্রতি কথা হয় তার সঙ্গে। নিজের অফিস কক্ষে বসে বিগত দিনের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। জার্নিটা তুলে ধরে জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য আমেরিকা থেকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আনা হয়েছিল। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই অর্থপেডিক সার্জন কাজ শুরুর পর বুঝতে পারেন, এখানে একজন বার্ন প্লাস্টিক সার্জনের খুব প্রয়োজন। তার পরামর্শে পরে ভারত থেকে একজন ডাক্তার আনা হয়েছিল। এভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ’৭২, ’৭৩ সালের দিকে বাংলাদেশে ছোট পরিসরে বার্ন প্লাস্টিক সার্জারি শুরু হয় বলে জানান তিনি। যতদূর তথ্য- স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম বার্ন ওয়ার্ড চালু করা হয় ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। খুবই সীমিত পরিসরে ৫ শয্যার বার্ন ওয়ার্ড। অন্যদিকে, ঢাকা মেডিক্যালে আশির দশকের প্রথমভাগেও দগ্ধ রোগীদের জন্য কোন ইউনিট ছিল না। ১৯৮৬ সালে প্রথম বার্ন ইউনিট চালু করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময় এর শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়। জোরদার হয় কার্যক্রম। একই প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবার হয়েছে ইনস্টিটিউট। সামন্ত লাল সেন বলেন, একবার সাধারণ রোগী দেখতে ঢাকা মেডিক্যালে এসে আগুনে পোড়া রোগীদের দুরবস্থা নিজ চোখে দেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোগীদের জন্য তার যে মায়া, আমি সেদিন দেখে অভিভ‚ত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে তার আরও কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তখন উপলব্ধি হয়েছে, কাছে না গেলে কেউ তার মানবিক গুণ সম্পর্কে সহজে কিছু বুঝতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে চলে আসে ২০১৪ সালের আগুন সন্ত্রাসের কথাও। সামন্ত লাল বলেন, ওই সময়টা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ এই ধরনের হঠাৎ করে পুড়ে যাওয়া রোগী সামলানোর অজ্ঞিতা অনেকেরই ছিল না। একজন ট্রাক ড্রাইভার, একজন বাসের হেলপার, যে হয়ত জানেও না কে দেশের প্রধানমন্ত্রী, কে বিরোধী দলের নেত্রী, তাদেরকে পোড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিন আসছে রোগী। কী যে করুণ দৃশ্য! তার পরও ডাক্তার-নার্স সবাই মিলে রাতদিন পরিশ্রম করে কিছুটা সামলাতে পেরেছিলাম। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বক্ষণিক তদারকি তাদের কাজকে সহজ করেছিল বলে জানান তিনি। বলেন, হতভাগ্যদের দেখতে এসে অঝর ধারায় কেঁদেছেন তিনি। এত রোগী, জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। তিনি সব দেখেছেন। তখনই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রæত এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রী। এত বড় ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সামন্ত লাল বলেন, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৯ লাখ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। আমাদের ১০০ রোগীর বেডে ৫০০ জন চিকিৎসা নেয়। এ অবস্থায় ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা বিশেষ ফলদায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অবশ্য এখনও চালু হয়নি ইনস্টিটিউট। আগামী ফেব্রæয়ারি-মার্চ নাগাদ পুরোদমে কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। সে লক্ষ্য চলছে জোর প্রস্তুতি। ভবনের কোন কাজ বাকি নেই। নবনির্মিত ভবনে হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের ব্যবস্থা থাকবে। রাথা হচ্ছে ২২টি পুরুষ এবং ২২টি নারী বেড। সর্বাধুনিক ২০ বেডের একটি আইসিইউ থাকবে। থাকবে ১০টি মড্যিলার অটি। সাধারণ অটি থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা হবে। আগুনে পোড়া রোগীর বেলায় ইনফেকশনে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এখানে ইনফেকশনের হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পোড়া রোগীর জন্য চামড়া খুব জরুরী। এ জন্য ইনস্টিটিউটে থাকছে একটি স্কিন ব্যাংক। দেশে প্রথমবারের মতো এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কিনে আনা হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি। আমেরিকা, জার্মানি থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আসছে। এসবের বাইরে আলাদা করে বলতে হয় হেলিপ্যাডের কথা। হেলিপ্যাড ঠিক কেন? জানতে চাইলে ডাঃ সামন্ত লাল বলেন, বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে আনতে এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রোগীকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনা সম্ভব হলে অঙ্গহানী ঠেকানো যায়। কিন্তু যোগাযোগের সমস্যার কারণে সেটি সবসময় সম্ভব হয় না। এ কারণেই হেলিকপ্টার অবতরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাটা হাত, আঙুল, পা জোড়া দেয়ার জন্য এখানে মাইক্রো সার্জারির আলাদা বিভাগ থাকবে বলেও জানান তিনি। এসবের বাইরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চের কাজ হবে ইনস্টিটিউটে। সে কথা জানিয়ে সামন্ত লাল সেন বলেন, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে। ওখান থেকে ডাক্তাররা আসবেন। আমাদের এখান থেকে তরুণ ডাক্তার সেখানে যাবেন। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে রিসার্চ চুক্তি হয়েছে। ওইসব দেশের সঙ্গেও যৌথ গবেষণা, প্রযুক্তি বিনিময় হবে আমাদের। কিন্তু একজন সামন্ত লাল যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আগলে রাখছেন, সামনের দিনগুলোতে এমন চিকিৎসক কি পাওয়া যাবে? ইনস্টিটিউটের ভবিষ্যত নিয়ে ভেবেছেন? এমন প্রশ্নে প্রবীণ চিকিৎসক কিছুটা সময় নেন। বলেন, আমার তো সময় শেষ। চুক্তিতে আছি। একদিন তো চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন নতুনদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি আরও কিছু ডাক্তার তৈরি করার। নতুন ছেলেমেয়রা অনেক মেধাবী। আমার বিশ্বাস, আমি তাদের তৈরি করতে পারব। এবার শুরুতে যে প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে ফেরা যাক। একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ভবিষ্যতের জন্য ভাল চিকিৎসক তৈরি করছেন। তা তিনিও পারবেনও। কিন্তু রাজনীতির লোকেরা? মানুষের জন্য যে রাজনীতি, সে রাজনীতিতে কি আদৌ ফিরতে পারবেন তারা?
×