ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনাফার বলি

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৯ নভেম্বর ২০১৮

মুনাফার বলি

ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, বিপণনকারী প্রত্যেকেই এক একজন খুনী। রোগীর মৃত্যুর দায় তাদেরও নিতে হবে। ওষুধে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে বা রোগ না সারলে চিকিৎসককেই দোষারোপ করা হয়। অথচ চিকিৎসার মূল ভিত্তি হচ্ছে রোগ নির্ণয় এবং ওষুধের সমন্বয় সাধন। ভেজাল ওষুধ চেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে তো অসম্ভবই তেমনি চিকিৎসকের পক্ষেও সম্ভব নয়। দেখা গেল, চিকিৎসক রোগ বুঝে সঠিক ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। কিন্তু রোগী পড়লেন ভেজাল ওষুধের কব্জায়। সবাই চিকিৎসককেই দোষারোপ করবেন। গালমন্দ করবেন। ভেজাল ওষুধের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ মারা যেতে পারেন। মামুলি রোগে ভোগা কেউ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে অজানা থাকতে পারে পেছনের ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের কারসাজি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভেজাল ওষুধ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও ভেজাল ওষুধের কারণে এমনটা হয়েছে তাও খুব সহজে ধরা পড়ে না বা প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। ভেজাল ওষুধ কতটা বিধ্বংসী হতে পারে তা ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দেখেছে। সে সময় ক্ষতিকর প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের হিসেবে সংখ্যাটা দুই হাজারের বেশি। সাধারণ জ্বর সারানোর জন্য বাবা-মা এই শিশুদের দিয়েছিলেন সেই বিষাক্ত প্যারাসিটামল। ওষুধ না খাওয়ালেও যেই জ্বর সপ্তাহান্তে ভাল হয়ে যেত সেই জ্বরের ওষুধ নিষ্পাপ শিশুদের মৃত্যু ডেকে আনে। অসাধু ব্যবসায়ীদের লালসার বলি হয় শিশুরা। সেই সময়ে ভেজাল প্যারাসিটামল খাওয়ানোর ফলে সঙ্গে সঙ্গে বমি করা শুরু করে শিশুরা। এরপর দু-তিন দিনের মাথায় কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। এই ভেজাল ওষুধ চোরা বাজারে গোপনে তৈরি করা হয়নি। কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি প্রকাশ্যেই এগুলো তৈরি এবং বিপণন করেছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকলে ওষুধ প্রশাসন সিরাপগুলো পরীক্ষা করে। তাতে ধরা পড়ে ক্ষতিকারক ড্রাই-ইথিলিন গ্লাইকল নামের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি। যা সেবনে কিডনি অকেজো হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে ওষুধের বিশাল বাজার ও আইনের আওতায় আসার ভয় কম থাকায় নামী-দামী ওষুধ কোম্পানির মোড়কে নকল ওষুধ তৈরির রমরমা বাণিজ্য চলছে। এগুলো সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস। কিছুদিন পর পর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর র‌্যাবের সহায়তায় অভিযান চালালেও নকল ওষুধ সরবরাহ বন্ধে তেমন সাড়া ফেলে না। কারণ দেশব্যাপী বৃহৎ পরিসরে অভিযান চালানো হয় না। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রথম দিকে মানসম্মত ওষুধ প্রস্তুত করে লাইসেন্স নিলেও পরে তারাও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুত করে। প্রশাসনের যথাযথ নজরদারির অভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে তার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করা হয় না। ওষুধ কোম্পানিগুলো বাড়তি মুনাফার লোভে ওষুধের অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ করায় ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতের হার বাড়ছে। ওষুধের বাজার কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তা শুধু রাজধানীর মিটফোর্ডে অভিযান চালালেই ফুটে ওঠে। ওষুধ শিল্প সমিতিও ভেজাল ওষুধ বন্ধে কোন কর্মসূচী নেয় না। বাংলাদেশ বর্তমানে ওষুধ শিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার হার বাড়ছে। ন্যূনতম নজরদারি না থাকায় গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার অপরাধীদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ দেশীয় ওষুধের প্রতি আস্থা হারাবে। ঝুঁকে পড়বে আমদানিকৃত বিদেশী ওষুধের দিকে। মুখ থুবড়ে পড়বে দেশীয় ওষুধ শিল্প। তাই জীবন বাঁচাতে, দেশ সাজাতে সরকারকেই এসব নিয়ে ভাবতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ঢাকা থেকে
×