ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে হাইকোর্ট

প্রার্থী হতে পারবেন না ॥ খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা আটকে গেল

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

প্রার্থী হতে পারবেন না ॥ খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা আটকে গেল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে বিচারিক আদালতে কোন ব্যক্তির দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদে সাজা হলে ওই দ-ের বিরুদ্ধে আপীল চলাকালে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আপীলে সেই দ- বাতিল বা স্থগিত হলেই কেবল সাজাপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন বলেও জানিয়েছে আদালত। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানসহ পাঁচ জনের বিচারিক আদালতের দেয়া দ- ও সাজা স্থগিত চেয়ে আবেদন খারিজ করে আদালত উক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করে। অপর চার জন হলেন ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভুঁইয়া, আব্দুল ওহাব ও ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম এই পর্যবেক্ষণ দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬ (২) (ঘ) অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দ- হলে সেই সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। যতক্ষণ না, আপীল বিভাগ ওই রায় বাতিল স্থগিত করে জামিন না দেয়। এদিকে হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন আপীল করেছেন। আজ বুধবার আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানির জন্য ৪ নং আইটেমে বিষয়টি রাখা হয়েছে। আদালতের এ আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোঃ খুরশীদ আলম খন্দকার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুই মামলায় আপীলে খালাস পেলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না। আমি আদালতে বলেছিলাম, ফৌজদারি আদালত, বিশেষ করে ফৌজদারি আপীল আদালত তাদের সাজা (সেনটেন্স) স্থগিত করতে পারেন। কিন্তু কনভিকশন করে তাকে যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সেটাকে স্থগিত করার কোন সুযোগ নেই। আর বিশেষ করে আমি সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) উল্লেখ করে বলেছিলাম, ‘এই সমস্ত ব্যক্তিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা সংসদ সদস্য হিসেবেও থাকতে পারবেন না।’ যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কারণে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং মুক্তি লাভের পরে পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত না হয়। যেই ব্যক্তিরা দরখাস্ত করেছেন তারা সবাই দ-িত। এরা তাদের দ- থেকে এখনও মুক্তি লাভ করেননি এবং তাদের ৫ বছর সময় অতিবাহিত হয়নি। এমতাবস্থায় যদি তাদের দ- স্থগিত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয় তবে তা হবে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও মোফাজ্জল চৌধুরী মায়ার ১০ বছর করে দ- হয়েছিল। কিন্তু তারা নির্বাচন করেছেন, মন্ত্রী হয়েছেন এবং বহাল থেকেছেন। আর এরশাদ কারাগার থেকে নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এ্যাটর্নি বলেন, ‘এরশাদের বিষয়ে তো আমাদের সুপ্রীমকোর্টেরই রায় আছে। তার যে পদ সেটা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। আর মহিউদ্দিন খান আলমগীর বা মায়া এদের বিষয়ে সেই সময় এই সাবমিশনগুলো রাখা হয়েছিল কি না, এটা আমি বলতে পারব না।’ সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাখ্যায় এখন আমি যাব না। আমার সামনে যে মামলাগুলো আছে এসব মামলায় আমার বক্তব্য হচ্ছে এটি। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত থেকে সম্পূর্ণ খালাস বা সাজা বাতিল না হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। এই রায়ের আলোকে বেগম খালেদা জিয়ারও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, একদম থাকছে না। একথা তো আমি আগেও বলেছি। উনি সম্পূর্ণ খালাস পেলে অথবা সেনটেন্সড বাতিল করে দিলে, তখন উনি পারবেন। আজকের আদেশে এটা আরও পরিষ্কার হলো। এই আদেশটা সবার ওপরে বাধ্যতামূলক। বিচারিক আদালতে কারও বিরুদ্ধে দুই বছরের বেশি সাজা বা দ- হলে সেই দ- বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। যতক্ষণ না, আপীল বিভাগ ওই রায় বাতিল বা স্থগিত করে জামিন না দেয়। আপীল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় পাঁচটি দরখাস্তের শুনানি হয়েছে। ওইসব দরখাস্তের মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল সেনটেন্সড সাসপেন্ড করার। সেটা গত দুদিন শুনানি হয়েছে। আজকে (মঙ্গলবার) আদালত আদেশ দিয়ে আবেদনগুলো খারিজ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘মূলত একটাই কারণ, সেটা হলো সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) ধারায় যে বিধান দেয়া আছে আদালত বলেছেন যে, এটা সুপ্রীম ল অব দ্য কান্ট্রি। কাজেই ফৌজদারি কার্যবিধিতে কনভিকশন স্টে করার কোন বিধান নাই। সাসপেন্ডের বিধান থাক আর না থাক, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে প্রাধান্য পাবে।’ ‘সুতরাং অনুচ্ছেদ ৬৬ (২) (ঘ)-এর অনুযায়ী উনারা নির্বাচন করার যোগ্য নন এবং সেনটেন্সড সাসপেন্ড চাওয়ার জন্য কোন এখতিয়ার রাখে না। এই কারণে উনাদের দরখাস্ত খারিজ করে দিয়েছে।’ ‘এ ছাড়াও আদালত অনেক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, মূল রায় পেলে হয়ত আমরা জানতে পারব। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে এ্যাটেন্ড করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া আদালত এগুলো ডিসকারেজ করেছে। আদালত বলেছেন, দুর্নীতি এমন একটা বিষয় যে, এ বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকা উচিত। কাজেই কনভিকশন মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া সংবিধানের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় যাই থাকুক না কেন, সংবিধানের সবার ওপরে প্রযোজ্য। এক প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য বাইন্ডিং। আজকে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আইনে নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত (কনভিকশন এ্যান্ড সেনটেন্স) বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমানসহ পাঁচ নেতার দ- স্থগিত চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। আদালতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম। ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আহসানুল করীম ও খায়রুল আলম চৌধুরী। ওয়াদুদ ভুঁইয়া ও আব্দুল ওহাবের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, ও ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম। মশিউর রহমানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোঃ খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। এর আগে সোমবার পাঁচ নেতার দ- স্থগিত চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হয়। মামলার বিবরণে জানা যায়, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, তথ্য গোপন ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ২৯ হাজার ৩৫৪ টাকার সম্পদ অর্জন করায় ওয়াদুদ ভুঁইয়াকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মোট ২০ বছরের সশ্রম কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন। তিনি এ বিষয়ে আপীল করে ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২০০৯ সালে জামিন লাভ করেন। এছাড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৯৩ লাখ ৩৬৯ টাকার সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপন করে মোঃ আবদুল ওহাবকে যশোর স্পেশাল জজ গত বছরের ৩০ অক্টোবর ৮ বছরের সশ্রম কারাদ- ও ত্রিশ হাজার টাকার জরিমানা দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে আপীল করে ৬ ডিসেম্বর জামিন নিয়েছেন। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত প্রায় ১০ কোটি ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ টাকার অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুষ্টিয়ার তৎকালীন সহকারী পরিচালক মোশরফ হোসেন মৃধা মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ঝিনাইদহ-২ (সদর ও হরিণাকু-ু) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে পৃথক ধারায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। একই সঙ্গে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা ও ১০ কোটি ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩০ টাকার সম্পদ বাজেয়াফতের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পরবর্তীতে তিনি আপীল করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। ২০০৮ সালের ২৫ মে দুর্নীতির মামলায় মোট ১৩ বছরের দ- দেন বিচারিক আদালত। এর বিরুদ্ধে আপীল করে হাইকোর্ট থেকে পরে তিনি জামিন নেন। আমান উল্লাহ আমানকে দুর্নীতির মামলায় ২০০৭ সালের ২১ জুন বিচারিক আদালত ১৩ বছরের সাজ দেন। পরে তিনি আপীল করে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন বলে জানান আমিন উদ্দিন মানিক।
×