ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরা খাতুন

মুশফিকের স্বপ্ন আরও বড়

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

মুশফিকের স্বপ্ন আরও বড়

প্রতিটি ভাল কিছুর পর আরও ভাল করার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। মানুষ তাই প্রতিনিয়তই দেখে স্বপ্ন, কারণ বলা হয়ে থাকে ভালর আসলে কোন শেষ নেই। শুরুটা যেমন ছিল, এখন তার চেয়েও পরিণত ক্রিকেটার মুশফিকুর রহীম। এর পেছনে আছে ধারাবাহিকভাবে কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও চেষ্টা। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের যে কোন খেলোয়াড়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি অনুশীলন করেন মুশফিক। আর সে কারণেই ফলটা পাচ্ছেন নিয়মিত। তাই আরও ভাল করার প্রেরণা পাচ্ছেন, দেখছেন বড় কিছুর স্বপ্ন। দীর্ঘদিন ধরেই সব ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মিডলঅর্ডারের অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছেন তিনি ধারাবাহিকভাবে ব্যাট হাতে রান করার সুবাদে। ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ নাম পাওয়া এ ডানহাতি ৩১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান ক্রমেই নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় আসীন করছেন। এবার তিনি দেশের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ডটাও গড়লেন। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান ৫ বছর পর দ্বিতীয়টির দেখা পেয়েছেন সম্প্রতি সফরকারী জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ২১৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে। আর তাতে করে ১৪১ বছরের টেস্ট ইতিহাসে নতুন এক মাইলফলক ছুঁয়েছেন যা অতীতে বা বর্তমানে কোন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান করতে পারেননি। প্রথম উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির অনন্য কীর্তি গড়েছেন মুশফিক। বিরল এই কীর্তি গড়ার পর এখন ট্রিপল সেঞ্চুরিরও স্বপ্ন দেখছেন তিন ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিলিয়ে ১০ হাজার রান করা এ ব্যাটসম্যান। ২০ হাজার আন্তর্জাতিক রান ও ব্যাটিং গড় ৫০-এ নিয়ে যেতে চান তিনি। এই মুহুর্তে ৬৫ টেস্ট খেলে ৩৫.৩২ গড়ে ৩৯৯২ রান করে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রাহক বাংলাদেশের। আর মাত্র ৮ রান করতে পারলে তামিম ইকবালের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ৪ হাজার টেস্ট রানের মাইলফলক স্পর্শ করবেন। আর দেশসেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হতে মাত্র ৫৮ রান প্রয়োজন। তাহলেই তামিমের ৫৬ টেস্টে করা ৪০৪৯ রান টপকে বাংলাদেশের সর্বাধিক রানের রেকর্ডে শীর্ষস্থান দখল করবেন মুশফিক। তবে মুশফিকের স্বপ্নটা আরও বড়। সেই বড় স্বপ্নের কথাই বলা হবে- মুশফিক পৌঁছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তিনিই দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির মালিক হয়েছেন। দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটিই ছিল তার নিজের প্রথম দ্বি-শতক। ২০১৩ সালের মার্চে গল টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কাঁটায় কাঁটায় করেছিলেন ২০০। এবার দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত টেস্ট ইনিংস উপহার দিলেন। গত বছর জানুয়ারিতে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের ২১৭ রান ছিল এতদিন দেশসরা। এখন সবার ওপরে মুশফিক। তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘতম ইনিংস খেলার রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বল খেলার রেকর্ডও গড়েছেন। এর আগে ৫৩৫ মিনিট খেলে দেশের দীর্ঘতম ইনিংস ছিল বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে (নবেম্বর, ২০০০) ১৪৫ রান করা আমিনুল ইসলাম বুলবুলের। সবচেয়ে বেশি বল খেলেছিলেন ২০১৩ সালে গল টেস্টে ৪১৭ বল খেলে ১৯০ রান করা মোহাম্মদ আশরাফুল। আর মুশফিকের ব্যক্তিগত দীর্ঘতম ইনিংস ছিল ৪৩৭ বল ও ৩২১ মিনিটের। এই ডাবল সেঞ্চুরির আগে মুশফিকের ৯টি ইনিংস খুব বাজে কেটেছিল। ৩১ বছর বয়সী এ ব্যাটসম্যান মাত্র ১৫.০০ গড়ে করেছিলেন ১৩৫ রান, সর্বোচ্চ ছিল ৩১! এরও আগে বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হতে ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে চরম ব্যর্থ ছিলেন মিডলঅর্ডারের এ নির্ভরতা। ১৯ ইনিংসে মাত্র ২টি ফিফটিসহ ২২.৯৪ গড়ে করেছিলেন সে সময় মাত্র ৪১৩ রান। একই সঙ্গে টেস্ট নেতৃত্ব, উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব ও ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্বের চাপ থেকে মুক্তি দিতে তাকে ১২ টেস্টে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো থেকে। কিন্তু উইকেটরক্ষক হিসেবেই এবার বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রতিটা দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সমধারায় প্রবাহিত হয় না- কারণ জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ। উত্থান আর পতন থাকে প্রতি মুহূর্তেই। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বলা হয়- ফর্ম ক্ষণস্থায়ী। ব্যাট হাতে ধারাবাহিক উত্থান দেখিয়ে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ পরিচিতি পেলেও, নিজের ছন্দ পতনও দেখেছেন মুশফিক। তাই চাপ কমাতে মাঝে তাকে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব থেকে কয়েক টেস্টে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছিল। যদিও মুশফিকের দাবি, ‘কিপিংয়ে থাকলে আমি দেখতে পারি উইকেটে কী হচ্ছে। ব্যাটিংয়ে অনেক কাজে লাগে সেটা। কিপিং করে চারে খেলাটা একটু কঠিন। আমার পছন্দের জায়গা সব সময় পাঁচ।’ সেটার প্রমাণও দিয়েছেন অনেকবার। আর এবার উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বরেকর্ডই গড়লেন। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪১ বছরের ইতিহাসে প্রথম উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল কীর্তি গড়েছেন। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২১৯ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিক। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি এটি দেশের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসও। দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ৫৮৯ মিনিট ও সর্বাধিক ৪২১ বল খেলার নতুন রেকর্ডও গড়েছেন মুশফিক এদিন। টেস্টে আগে ৫টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ছিল না কোন সেঞ্চুরি। সেই আক্ষেপ তিনি ভুলেছেন মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। টেস্ট ইতিহাসে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে এ নিয়ে মাত্র ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি দেখা গেছে। কিন্তু ইতিহাসের প্রথম উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন তিনি। এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ১৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। দলের ইনিংস গুটিয়ে যাওয়াতে তার সেই ডাবল সেঞ্চুরিটি হয়নি, নাহলে তারও থাকত রেকর্ডটি। নিজ দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড দুইবার গড়ে মুশফিক ঢুকে গেছেন ছোট্ট এক তালিকায়। টেস্ট ইতিহাসে এই কীর্তি গড়তে পেরেছেন আগে কেবল পাঁচজন- অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হ্যাডলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, ভারতের ভিনু মানকড় ও বীরেন্দর শেবাগ। এসবের পেছনে আছে তার দীর্ঘ সময় ধরে নিবিড় অনুশীলন। মুশফিকই বললেন সে কথা, ‘দলের অনুশীলনে নির্দিষ্টভাবে সব কাজ করার সুযোগ কম। দেড়-দুই ঘণ্টার অনুশীলনে একজনের জন্য বরাদ্দ আধা ঘণ্টা বা দশ-পনেরো মিনিট। সেই দশ-পনেরো-বিশ মিনিটে ভাল ফলাফল পাওয়া কঠিন। কার সঙ্গে খেলা হচ্ছে বা কোন বোলারের বিপক্ষে ব্যাট করতে হবে, তারা আমাকে কীভাবে আউট করার চেষ্টা করতে পারে, সেগুলো ভেবে ওভাবেই আমি আমার ব্যক্তিগত অনুশীলনটা সাজানোর চেষ্টা করি।’ বাংলাদেশের পক্ষে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরমেট মিলিয়ে ১০ হাজার রান পেরিয়েছেন মুশফিক। সেটার স্বীকৃতিও পেয়েছেন ক্রিকেট বোর্ড থেকে। কিন্তু এখুনি থামতে চান না মুশফিক। তার দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তামিম যদিও ১২ হাজারে পৌঁছে গেছে মনে হয়, তারপরও বোর্ড যেভাবে স্বীকৃতি দিল, সেটা খুব ভাল লেগেছে। আমার ইচ্ছা, ১৫ হাজার ক্লাব বা ২০ হাজারের ক্লাবে যেন পৌঁছাতে পারি। যখন খেলা শেষ করব, তখন যেন পঞ্চাশের কাছাকাছি গড়ে শেষ করতে পারি। চার-পাঁচ বছর ধরে যে রকম খেলছি, আশা করছি অসম্ভব হবে না এটা।’ এই মুহুর্তে টেস্টে তামিমের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ৪ হাজার রান (আর ৮ রান প্রয়োজন) ও তামিমকে টপকে (প্রয়োজন ৫৮) রান করার দিক থেকে সেরা হওয়ার দ্বারপ্রান্তে মুশফিক। এসব পেছনে ফেলে তার দৃষ্টি যে আরও উঁচুতে সেটাই স্পষ্ট করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এই মুহুর্তে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩৪৭৮ রান করে তালিকায় আছেন ১০ নম্বরে। এ তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান এডাম গিলক্রিস্ট ৯৬ টেস্টে ৫৫৭০ রান করে সবার ওপরে। মুশফিকের যে নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও নিবেদন তাতে করে হয়তো সবাইকে হটিয়ে দারুন এক উচ্চতায় উঠেই ক্যারিয়ার শেষ করতে পারবেন।
×