ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুহিয়া খানম

অনন্য উচ্চতায় সাকিব

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

অনন্য উচ্চতায় সাকিব

দেশের সেরা অলরাউন্ডার তিনি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারও। তিনি বাংলাদেশের গর্ব সাকিব আল হাসান। যিনি শুধু দেশের হয়েই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। এবারই যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে যখন ৪ উইকেট নিলেন, তখনই টেস্ট ক্যারিয়ারে ২০০ উইকেট পূরণ করলেন। এ কৃতিত্ব গড়ে তিন হাজার রান ও ২০০ উইকেট নেয়া গ্রেট ক্রিকেটারদেরও পেছনে ফেলেন। ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খান, গ্যারি সোবার্সদের ছাড়িয়ে যান সাকিব। সবচেয়ে কম ম্যাচ (৫৪ টেস্ট) খেলে ২০০ উইকেট (২০১ উইকেট) ও তিন হাজার রান (৩৭২৭ রান) করার গৌরব অর্জন করলেন। অথচ আঙ্গুলের ইনজুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের আগেরদিনও তার খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি খেললেন। জয়ও করলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তার নেতৃত্বে দল হারালো ৬৪ রানে। সিরিজেও এগিয়ে গেল। আবার সাকিবও ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম যুক্ত করে নিলেন। শুধু ব্যক্তিগতভাবেই নয়, নেতৃত্বেও সাকিব উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে চলেছেন। জিম্বাবুইয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই বেশি জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৬টি টেস্ট জয় মিলেছে। সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো গেছে তিন টেস্টে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাকে একটি করে টেস্টে হারানো গেছে। সাকিবের নেতৃত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এর আগে ২০০৯ সালে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। এবার দেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জিতে নিয়েছে। ২০০৯ সালের সিরিজে মাশরাফি বিন মর্তুজাই অধিনায়ক ছিলেন। কিন্তু প্রথম টেস্টের শুরুতেই তিনি ইনজুরিতে ছিটকে পড়েন। সেই টেস্টে সাকিবই নেতৃত্ব দিয়ে জেতান। পরের টেস্টেও সাকিবই নেতৃত্ব দেন। এবারও সাকিবের নেতৃত্বেই জিতল বাংলাদেশ। নেতৃত্বেও সফলতা অর্জন করছেন সাকিব। বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে স্পিনার হিসেবে সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্যের সামনে আসলে কোন অলরাউন্ডার নেই। সাকিব শুধু ছুটছেনই। স্পিনার হিসেবে সাকিবের ঠিক পেছনে আছেন শুধু অশ্বিন। তিনি উইকেটের (৩৩৬ উইকেট) দিক দিয়ে সাকিবের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও রানের দিক দিয়ে (২৩৩১ রান) পিছিয়েই আছেন। সাকিবের সামনে দেশের কোন অলরাউন্ডারও নেই। ধারে কাছেও কেউ নেই। তিনি সবার ওপরে। টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। রানের দিক দিয়ে সাকিব আছেন তিন নম্বর স্থানে। তামিম ইকবাল (৪০৪৯ রান) ও মুশফিকুর রহীমের (৩৯৯৩ রান) চেয়ে পিছিয়ে সাকিব। তবে অলরাউন্ড নৈপুণ্যে একাই সাকিব শীর্ষস্থানটি দখল করে রেখেছেন। সাকিব অবশ্য এসব অর্জন নিয়ে তেমন ভাবেন না। তার ভাবনা, ‘২০০ উইকেট পাওয়ার পরও অনুভূতিটা ভাল হতো না, যদি না জিততাম। যেহেতু জিতেছি এখন অনুভূতিটা অনেক ভাল।’ বোথামকে ছাড়িয়ে ২০০ উইকেট ও তিনহাজার রান করায় সবার ওপরে যাওয়াতেও সাকিবের অনুভূতিতে বিশেষ কিছু নেই। এ নিয়ে জানান, ‘নাহ, আসলে আমি জানি না, হয়তো লাগে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না আসলে। যখন ম্যাচটা জিতে যাই তখন খুশিটা একটু বেশি লাগে। কিন্তু ম্যাচ না জিতলে, টিম যদি ভাল রেজাল্ট না করে তখন এই অর্জনগুলো ওইভাবে প্রকাশ করা যায় না। এখন এসব নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে, তখন হারের ব্যাখ্যা নিয়েই প্রশ্ন আসতো। অনুভূতিগুলো আসলে সম্বন্ধযুক্ত একটার সঙ্গে আরেকটা। যখন দল ভাল করার সঙ্গে ব্যক্তিগত অর্জন আসে, তখন ভাল লাগে। কিন্তু উল্টোটা হলে তখন খুব একটা মিনিং থাকে না। এই কারণেই আমি বলি যতবেশি দল জিততে থাকবে, আমি যদি অবদান রাখতে পারি, তাহলে এই অর্জনগুলো এমনিতেই আমার সামনে চলে আসবে।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট নিয়ে নিজের টেস্ট শিকারসংখ্যা ১৯৯ করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আরও দুই উইকেট শিকারে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়েছেন। ৫৪ টেস্টে এখন তার ব্যাট হাতে ৩৭২৭ রান ও ২০১ উইকেট। টেস্ট ইতিহাসে এমন অলরাউন্ড মাইলস্টোন তিনি ছুঁয়েছেন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। দ্রুততম ৩ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের রেকর্ড ছিল ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথামের। ৫৫ টেস্টে ওই কীর্তি গড়া বোথামকে তার জন্মদিনেই ছাড়িয়ে এখন এই ক্লাবের শীর্ষে সাকিব। বাংলাদেশের হয়ে ১০০ টেস্ট উইকেট আছে সাকিব ছাড়া আর কেবল বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের। দেশের হয়ে সবার আগে ২০০ ছুঁলেন সাকিব। অথচ প্রথম টেস্ট উইকেটের জন্য তার অপেক্ষা করতে হয়েছে চতুর্থ টেস্ট পর্যন্ত। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ওয়েলিংটন টেস্টে ক্রেইগ কামিংকে ফিরিয়ে শুরু করেন উইকেট শিকার অভিযান। প্রথম ৬ টেস্ট শেষেও কেবল উইকেট ছিল ৩টি। তারপর নিজেকে দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য স্পিনারে পরিণত করা সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫০তম উইকেটও ছিল এই মাঠে। ভারতের ভিভিএস লক্ষণকে আউট করে ৫০ ছুঁয়েছিলেন ১৫তম টেস্টে। উইকেটের সেঞ্চুরি হয় ২৮তম টেস্টে, খুলনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্যারেন সামিকে ফিরিয়ে। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচে সাকিব দেখা পান ১৫০ উইকেটের। ক্যারিয়ারে সেটি তার ৪৩তম টেস্ট, জো রুট ছিলেন দেড়শ’তম শিকার। দেড় শ’ থেকে দুই শ’ আসতে লাগল মাত্র ১১ টেস্ট। ৫৪ টেস্টে ছুঁলেন দুই শ’। সাকিবের চেয়ে কম ম্যাচ খেলে দুই শ’ উইকেট ছুঁয়েছেন টেস্ট ইতিহাসের ৪৫ জন বোলার। তবে বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে তারচেয়ে দ্রুততম কেবল দুইজন। ৪৭ টেস্টে দুই শ’ ছুঁয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ, ৫১ টেস্টে ভারতের বিষেণ সিং বেদি। নিজের ফিরে আসার ম্যাচে অন্যরকম এক উচ্চতায়ই আসীন হলেন সাকিব। রেকর্ড গড়ে প্রমাণ দিলেন টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তিনি। অনন্য উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেলেন।
×