ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুল ইসলাম সুমন

স্মরণ ॥ মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

স্মরণ ॥ মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের আজ দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। চার শ’ বছরের প্রাচীন শহর রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগাসিটি। সেই শহরের গৌরবের অপর নাম মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহধন্য। ১৯৪৪ সালে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধনী’ নামে ডাকত। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে ওঠেন মোহাম্মদ হানিফ। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আলহাজ মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। পুত্র আলহাজ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দেয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রিপাড়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবারে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার বাসায় অবস্থান নেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব ¯েœহ ও বিশ্বাস করতেন। মোহাম্মদ হানিফ মুজিব পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালের বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকা কালীন ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে তিনি রাজপথে সংগ্রামের প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া ঢাকা ১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের মহান দায়িত্ব পালন করেন। সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর এই মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ। মোহাম্মদ হানিফের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যের নির্মম হত্যাকা-। এই হত্যাকা- কোনদিন মেনে নিতে পারেননি মোহাম্মদ হানিফ। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের হত্যাকা- মোহাম্মদ হানিফকে বেদনার গভীর সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে লন্ডনে একসঙ্গে সফরে থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুই আমার রাসেলকে দেখবি’। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে করত মোহাম্মদ হানিফ। তাই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের পর মোহাম্মদ হানিফের কণ্ঠে ছিল শুধুই স্লোগান ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম মুজিব হত্যার বদলা নেব, রাসেল হত্যার বদলা নেব’ ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিকভাবে পিতা মুজিব হত্যার বদলা নেয়া এবং হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়েছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাথ উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানম-ি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলী বাতি স্থাপন, নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচী, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসাতেও কোন ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ। ২০০৬ এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্পিøন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা শেষে ২৮ নবেম্বর ’০৬ দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অবশেষে চির অবসান ঘটে তার কর্মময় রাজনৈতিক জীবনের। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন
×