ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

তিনি বিএনপি-জামায়াতের ওকালতনামায় সই করেছেন

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

তিনি বিএনপি-জামায়াতের ওকালতনামায় সই করেছেন

আগে দাবি ছিল, সরকার ও সরকারপ্রধান পরিবর্তন। অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় হাসিনা সরকার কেয়ারটেকার সরকার হিসেবেও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। একটি অদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এখনও এই দাবিটি রয়ে গেছে। যারা দাবিটি জানিয়েছিলেন বা এখনও জানাচ্ছেন, তারা হাসিনা সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যোগ দিতে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন। দেশের মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। এখন আবার দুই জোটই যখন নিজেদের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত, তখন দাবি উঠেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ বিএনপির। সিইসির বিরুদ্ধেও। কিন্তু সিইসিকে তার পদ থেকে সরাতে হবে এটা বিএনপি-জামায়াতের মনের কথা হলেও মুখ ফুটে বলেনি। তারা নতুন সরকার গঠনের মতো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছে বলে মনে হয়। এটা বিএনপির দাবি। কিন্তু ড. কামাল হোসেনেরও দাবি, তা আগে জানতাম না। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হওয়ার পর তিনি ফ্রন্টের হয়ে যদি দাবিটি জানাতেন তার একটা অর্থ বুঝতাম। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ড. কামাল এই দাবিটি তুলেছেন, তা গণফোরামের নামে ডাকা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের নামে সংবাদ সম্মেলনটি ডাকা হলো না কেন? কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, ড. কামাল এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা হলেও তিনি যে তাদের সব দাবির সঙ্গে একমত নন, তা বোঝাবার জন্য, অর্থাৎ তিনি বিএনপি-জামায়াতের ক্রীড়নক নন, এটা সকলকে জানানোর জন্য আলাদাভাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন এবং গোটা নির্বাচন কমিশন বদল করার পরিবর্তে কেবল প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অব্যাহতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এই অনুমানটি যথার্থ কি? কামাল সাহেব একজন আইনজ্ঞ। কিন্তু গণফোরামের সংবাদ সম্মেলনে তিনি কথার মারপ্যাঁচে একদিকে বিএনপি-জামায়াতকে খুশি করার এবং অন্যদিকে এই দাবি যে তার মনের কথা নয় তা আড়াল করার চতুর চেষ্টা করেছেন কি-না সে প্রশ্ন যে কেউ তুলতে পারেন। সংবাদ সম্মেলনে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ‘আপনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পরিবর্তন না পদত্যাগ চান? তিনি উত্তরে বলেছেন, “আমরা তার পদত্যাগ বহু আগে চেয়েছি। আমরা তাকে রিমুভ নয়, রিপ্লেস করতে চাইছি।’’ বিজ্ঞ পাঠক, আপনারই বলুন, এটা কি কথায় মারপ্যাঁচের খেলা নয়? এখানে রিমুভ এবং রিপ্লেস কথাটির মধ্যে পার্থক্য কি? আভিধানিক পার্থক্য নয়, প্রয়োগজাত পার্থক্য। তারপর একই নিঃশ্বাসে তিনি বলেছেন, ‘‘সিইসিকে সময় দিতে আমাদের আপত্তি নেই।” কিসের জন্য সময় দেবেন? জানা গেল, সিইসিকে তার বর্তমান ভূমিকা পরিবর্তনের জন্য সময় দেবেন। ড. কামাল বলেছেন, ‘সিইসির ভূমিকা পরিবর্তন করলে (অর্থাৎ তাদের কথামতো চললে) তার সম্পর্কে আমরা আমাদের মত পরিবর্তন করতে পারি।’ এখানেও অর্থ সিইসি তাদের পছন্দসই কাজ করলে তাকে রিমুভ বা রিপ্লেস করার দাবি তারা তুলে নিতে পারেন। সিইসিকে ধমক দিয়ে তিনি বলেছেন, “আগে যাই করে থাকুন, আজ থেকে আপনি নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা রাখুন।’’ এটা একটা ধমক। এই রকম ধমক তিনি সিইসিকে আগেও দিয়েছেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচন পেছানোর দাবি নিয়ে তিনি যখন ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলসহ সিইসির সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন সিইসিই তাকে বলেছিলেন, ‘সংবিধান মেনে চলতে হলে আরেক দফা নির্বাচন পেছানো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়।’ তার জবাবে সিইসিকে ধমক দিয়ে ড. কামাল বলেছেন, “আমি সংবিধানের রচয়িতা, আপনি আমাকে সংবিধান শেখান?” সিইসি ভদ্র স্বভাবের মানুষ। তিনি একজন প্রবীণ আইনজীবীর কাছ থেকে এই ধরনের অশোভন আচরণকে উপেক্ষা করেছেন। আমলে নেননি। নিকট অতীতে আমাদের এ্যাটর্নি জেনারেলও ড. কামালের কাছ থেকে অভদ্র গালি শুনেও কোনরকম রিএ্যাক্ট করেননি। সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল সিইসির বিরুদ্ধে এমন কোন গুরুতর অভিযোগ তুলতে পারেননি, যাতে সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশন বদল বা নতুনভাবে গঠনের দরকার হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মহা দোষ হলো তিনি বলেছেন, পুলিশ অসঙ্গত কারণে কাউকে গ্রেফতার করছে না। এটা সিইসির পর্যবেক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণ ভুল হলে ড. কামালের মতো বিচক্ষণ আইনজীবী আদালতে গিয়ে পুলিশ অসঙ্গত কারণে গ্রেফতার করে থাকলে তা তুলে ধরছেন না কেন? ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের গ্রেফতার যদি অসঙ্গত কারণে হয়ে থাকে, তিনি তো তারও প্রতিবাদ করে কোন বিবৃতি দিতে গোড়ায় রাজি হননি। একটা ব্যাপার এখন পরিষ্কার। ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব গ্রহণের নামে ড. কামাল এখন বিএনপি-জামায়াতের ওকালতনামায় সই করেছেন। বি মুভির অভিনেতা রোনাল্ড রেগান যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন, তখন তার আচরণ দেখে ও কথাবার্তা শুনে অনেকে বলতে শুরু করেছিলেন, রেগান যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তা বুঝতে পারছেন না। তিনি ভাবছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় বুঝি অভিনয় করছেন। বাংলাদেশে এখন ড. কামাল হোসেনের কথাবার্তা শুনেও মনে হয়, তিনি যে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা হয়েছেন তা বুঝতে পারছেন না। হয়ত ভাবছেন তাকে বিএনপি-জামায়াত তাদের ওকালতনামায় সই করিয়ে তাদের পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত করেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি এখন যেসব কথাবার্তা বলছেন, তার সবই বিএনপি-জামায়াতের দাবি। তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল আজ যা বলেন, কাল ড. কামাল তার পুনরুক্তি করেন। মির্জা ফখরুল নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে দু’দিন আগে অভিযোগ তুলেছেন। দু’দিন পর ড. কামাল সংবাদ সম্মেলন ডেকে সিইসিকে সরাবার দাবি করেছেন। তবে এখানে একটু চালাকি করেছেন। সিইসি যেন একজন শিশু, ধমক দিলেই ভয় পাবেন, সম্ভবত এটা ভেবেই ধমক দিয়ে বলেছেন, সিইসি ভাল ছেলে হয়ে গেলে (অর্থাৎ তাদের কথামতো চললে) তার আর ভয় নেই। আর এরকম একটি বালসুলভ দাবি জানানোর জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। আমার পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে যখন ঐক্য প্রক্রিয়া নামে প্রাথমিক জোট গঠনের প্রচেষ্টা চলছে, তখন ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, কয়েকটি বড় কমন দাবির ভিত্তিতে বিএনপিকে ঐক্য প্রক্রিয়ায় আনা যেতে পারে। তবে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি তারা করবেন না। অর্থাৎ ওটা বিএনপির দলীয় দাবি থাকুক। এখন একজন আইনজ্ঞ হয়েও ড. কামাল তার প্রত্যেক বক্তৃতায় খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। আসম আবদুর রব তো এখন মঞ্চ কাঁপিয়ে বেগম খালেদার মুক্তি দাবিতে সেøাগান দেন। কাদের সিদ্দিকী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, খালেদা জিয়া প্রথম মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা তোলার সুযোগ দেননি। শুনে সেই বাংলা প্রবাদটি মনে পড়ে, ‘পাগলে কিনা কয়, ছাগলে কি না খায়।’ আমার সহৃদয় পাঠকেরা একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, লন্ডনে বসে অতি সম্প্রতি হাসিনা সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়ে তারেক যেসব কথা বলেছেন, তার প্রায় হুবহু প্রতিধ্বনি রয়েছে ড. কামাল হোসেনের সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরামের নামে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের ছবিতে দেখলাম, ড. কামালের পার্শ্বচর বদল হয়ে গেছে। আগে দেখেছিলাম, তার একপাশে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আরেকবার সম্ভবত দেখেছি, তার একপাশে কাদের সিদ্দিকী এবং অন্যপাশে সম্ভবত আসম রব। এবার দেখছি, তার একপাশে শহীদ শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। অন্যপাশে সম্ভবত সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমসা আমিন। (ছবিটা স্পষ্ট নয়)। ছবিটা দেখে মনে হলো এবারের নির্বাচন দু’ব্যক্তির ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এই দু’ব্যক্তি হলেন জেনারেল এরশাদ ও ড. কামাল হোসেন। জে. এরশাদকে একবার টাইটেল দেয়া হয়েছিল ‘বিশ্ব বেহায়া’। এখন এই টাইটেলটি এদের দু’জনের কার প্রাপ্য, তা নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। বলছিলাম, তাদের ভাগ্য ফেরার কথা। যে এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টিতে বহুকাল কেবল ভাঙ্গনের সুর শুনেছি, এবার একদল সাবেক সেনাকর্তা তার দলে ঠিক নির্বাচনের আগে আগে এসে যোগ দিয়েছেন। জে. এরশাদের দলের পাশাপাশি ড. কামালের দলেও এসে যোগ দিয়েছেন অনেকে। তাদের মধ্যে আছেন শাহ কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমসা আমিন এবং একুশে টিভির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। এরা ড. কামালের মতোই হতাশ রাজনীতিক। দেখা যাক, এত বিড়ালের ভাগ্যে এখন এক সঙ্গে শিঁকা ছিঁড়ে কিনা! নির্বাচনের রাজনীতির পাশাপাশি চক্রান্তের রাজনীতি এখনও শেষ হয়নি। নির্বাচনে সুবিধা করা যাবে না, এটা বুঝতে পারলে বিএনপি-জামায়াত শেষ মুহূর্তেও যে কোন অজুহাতে একটা বড় গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সরকারকে এজন্যে কথায় ও কাজকর্মে খুবই সতর্ক হতে হবে। কথায় বলে “না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’ বিএনপি-জামায়াত জোট তথা ঐক্যফ্রন্টের চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়ন ও তা ঘোষিত না হওয়া পর্যন্তও কোন কিছু বিশ্বাস করা কঠিন। [লন্ডন, ২৭ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৮]
×