ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাইকো দুর্নীতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

নাইকো দুর্নীতি

যতই গলা হাঁকিয়ে বলা হোক বা চেঁচামেচি করা হোক, থলের বেড়াল বেরিয়ে এসে বলছে, মামলা রাজনৈতিক নয়, আদি অকৃত্রিম দুর্নীতিরই। দেশের বিচার বিভাগ শুধু নয়, বিদেশী তদন্তকারী সংস্থাগুলোও অনুসন্ধান শেষে বলেছে, নাইকোকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি হয়েছে। এতে খালেদা জিয়াসহ এগারোজনের নামোল্লেখ রয়েছে। সরকারের শীর্ষাসনে বসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া তার বশংবদদের সঙ্গে নিয়ে আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছিলেন। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে নাইকো থেকে ঘুষ নেয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও কানাডিয়ান পুলিশের প্রতিবেদন বিধৃত করা হয়েছে। অথচ খালেদা এবং তার শিবির থেকে বারংবার বলা হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে তাকে হেয় করার জন্য এই মামলা। মামলা বাতিলের জন্য আদালতে আবেদনও করা হয়েছিল। মামলা দায়ের হয়েছিল খালেদা জিয়া সৃষ্ট তিন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। কানাডায় নিবন্ধিত নাইকো নামক একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কয়েকটি গ্যাসফিল্ড লিজ নেয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। ২০০২ সাল পর্যন্ত পূর্ব ছাতক গ্যাসফিল্ড একটি ‘ভার্জিন’ গ্যাস ফিল্ড অর্থাৎ গ্যাসে পরিপূর্ণ ছিল বলে বাপেক্স এবং আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অভিমত দিয়েছিল। কিন্তু নাইকো নানারকম অসৎ পন্থা অবলম্বন করে বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে হাওয়া ভবনসহ ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে এই পূর্ব ছাতক গ্যাস ফিল্ড গ্রহণ করে এবং একটি পরিত্যক্ত গ্যাস ফিল্ড হিসেবে একে তখন তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে। আসলে এই গ্যাস ফিল্ড কখনও পরিত্যক্ত ছিল না। এই ফিল্ড নেবার জন্য নাইকো যে ঘুষ প্রদান করে সে নিয়ে কানাডায় রয়েল মাউন্টেড পুলিশ ২০০৫ সালে তদন্ত শুরু করে এবং তদন্তে প্রমাণ হয়, কানাডা থেকে ক্রেম্যান আইল্যান্ড হয়ে সুইজারল্যান্ড এবং সেখান থেকে যুক্তরাজ্যে, তারপর বাংলাদেশে আসে নাইকোর টাকা। সেই টাকা ঘুষ দিয়ে গ্যাসে পরিপূর্ণ ফিল্ড পরিত্যক্ত দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে কাজ নেয় নাইকো। এক মন্ত্রীকে দামী গাড়িও ঘুষ দেয়া হয়। এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষতি করা হয়েছে। এই ক্ষতির ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এই ঘটনায় নাইকোকে সহযোগিতা করেছেন। এই কাজে আরও অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। এরা হচ্ছেন, তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী সচিব সিএম ইউসুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব এম শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, সাবেক এমপি এমএএইচ সেলিম এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ। এর মধ্যে চলতি বছর সাবেক সচিব শফিউর রহমান মারা যাওয়ায় এখন আসামি ১০ জন। নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুদকের পক্ষ থেকে ২০০৭ সালের নয় ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে পাঁচ মে এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ এগারোজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র প্রদান করে দুদক। অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় তেরো হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়। মামলা বর্তমানে বিশেষ জজ আদালত-৯-এ বিচারাধীন রয়েছে। কানাডার পুলিশ ও এফবিআই কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদন গত ২২ নবেম্বর আদালতে দাখিল করা হয়েছে। দুই দেশের তিন তদন্ত কর্মকর্তার জবানিতে নাইকো দুর্নীতিতে খালেদা ও তার পুত্র তারেকের সংশ্লিষ্টতার কথা এসেছে। দুটি দেশের তদন্ত রিপোর্ট প্রমাণ ও স্পষ্ট করেছে যে, খালেদা এবং তার বশংবদরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অর্থের লোভে তারা দেশের মূল্যবান সম্পদ বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। নাইকো দুর্নীতির দ্রুত বিচার করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবেÑ এমনটাই দেশবাসীর আশা।
×