ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশবীণার পর আসছে হংসবলাকা

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২৭ নভেম্বর ২০১৮

আকাশবীণার পর আসছে হংসবলাকা

আজাদ সুলায়মান ॥ স্বপ্নের উড়োজাহাজ, তাই নাম তার ড্রিমলাইনার। উর্ধাকাশে যতই ছুটুন, ক্ষণিকের জন্যও হারাবেন না আপনজনের সীমানা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, নেটওয়ার্ক আপনাকে জড়িয়ে রাখে আপন ভুবনে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অহঙ্কার ও গৌরব বলতে এখন একমাত্র এই ড্রিমলাইনার। মাস তিনেক আগে আসা আকাশবীণার পর শনিবার আসছে হংসবলাকা। এর আগে ১৯ আগস্ট বিমানের প্রথম ড্রিমলাইনার আকাশবীণা ঢাকায় আসে। হংসবলাকা বিমানের বহরে যুক্ত হলে এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫টিতে। বোয়িং কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বিশ্বের অত্যাধুনিক এই ড্রিমলাইনার ঘণ্টায় ৬৫০ কিলোমিটার বেগে উড়তে সক্ষম। এর ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানি জেনারেল ইলেক্ট্রিক (জিই)। ড্রিমলাইনারের শব্দ কমাতে ইঞ্জিনের সঙ্গে শেভরন প্রযুক্তি যুক্ত রয়েছে। উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ হবে ইলেক্ট্রিক ফ্লাইট সিস্টেমে। কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হওয়ায় এই উড়োজাহাজটি ওজনে হালকা। ভূমি থেকে উড়োজাহাজটির উচ্চতা ৫৬ ফুট। দুটি পাখার আয়তন ১৯৭ ফুট। এর মোট ওজন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬১৭ কিলোগ্রাম, যা ২৯টি হাতির সমান। এর ককপিট থেকে টেল (লেজ) পর্যন্ত ২৩ লাখ যন্ত্রাংশ রয়েছে। যা সত্যিই আশ্চর্য্যজনক। ড্রিমলাইনারে আসন সংখ্যা ২৭১টি। এতে বিজনেস ক্লাস ২৪টি আর ২৪৭টি ইকোনমি ক্লাস। বিজনেস ক্লাসের আসনগুলো বানিয়েছে এ্যাসটেলা, ইকোনমি ক্লাসের আসনগুলো হেইকোর বানানো। বিজনেস ক্লাসের আসনগুলো ৬৫ ইঞ্চি পিস, ইকোনমি ক্লাসেরগুলো ৩১ ইঞ্চি পিস। বিজনেস ক্লাসে ২৪টি আসন ১৮০ ডিগ্রী পর্যন্ত সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটবেড হওয়ায় যাত্রীরা আরামদায়কভাবে বিশ্রাম নিতে পারবেন। দু’পাশের প্রত্যেক আসনের পাশে রয়েছে বড় আকারের জানালা। একই সঙ্গে জানালার শাটার বন্ধ করা ও খোলা যাবে বোতাম টিপে। জানালা থেকে শুরু করে কেবিনেও রয়েছে মুড লাইট সিস্টেম। ফলে যাত্রীরা সহজেই পরিবর্তন করতে পারবেন লাইটিং মুড। দীর্ঘ সময় ভ্রমণেও যাত্রীরা যেন ক্লান্তি অনুভব না করেন- সেজন্য এর ভেতরে এয়ার কম্প্রেসার সিস্টেম অন্যান্য উড়োজাহাজের তুলনায় উন্নত। রয়েছে বেডরুমের মতো স্পেশাল মুড সিন। এটির ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট (আইএফই) সেবা দিতে প্যানাসনিক এভিওনিকস কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে বিমান। প্রতিটি আসনের সামনে প্যানাসনিকের এলইডিএস-মনিটর রয়েছে। মনিটরে বিবিসি, সিএনএনসহ ৯টি টিভি চ্যানেল দেখা যাবে। একই সঙ্গে ড্রিমলাইনারের ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমে (আইএফই) থাকবে ১০০টির বেশি ক্লাসিক থেকে ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র। এছাড়া রয়েছে বিমানের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত গেমস। অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩ হাজার ফুট দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও ওয়াইফাই সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। এছাড়া মোবাইল ফোনে রোমিং সুবিধা থাকলে আকাশে উড্ডয়নের সময় কল করতে পারবেন যাত্রীরা। এজন্য ২৫টি স্যাটেলাইটের সঙ্গে করা হয়েছে চুক্তি। উড়োজাহাজটি যে স্থানের ওপর দিয়ে যাবে, যাত্রীদের সামনে তখন স্ক্রিনে দেখা যাবে থ্রিডি ম্যাপ। একই সঙ্গে উঠে আসবে সেই স্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। ড্রিমলাইনারের ককপিটে রয়েছে নতুনত্ব। সেখানে থাকছে হেডআপ ডিসপ্লে। যার মাধ্যমে চোখের সামনের প্রয়োজনীয় তথ্য দেখতে পারবেন পাইলটরা। সর্বক্ষণিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঢাকায় বিমানের ফ্লাইট অপারেশন রুমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, ককপিট, ফুয়েল, নেভিগেশনসহ সব তথ্য জানতে পারবেন ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তারা। যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে তারা অপারেশন রুম থেকে পাইলটকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবেন। এজন্য বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সার্ভার স্থাপন করা হয়েছে। ফ্লাইট শেষে দেশে ফেরার আগেই ড্রিমলাইনারের কোন সমস্যা আছে কি না তা জানতে পারবেন প্রকৌশলীরা। তাই ত্রুটি পেলে উড়োজাহাজটি দেশে পৌঁছানোর আগেই প্রস্তুতি নিতে পারবেন তারা। ফলে যে কোন সময় ককপিট থেকে ফ্লাইট অপারেশন রুমের সহায়তা নিতে পারবেন পাইলটরা। একই সঙ্গে আকাশে ওড়ার সময় আইপ্যাড ও ট্যাব ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্য নিতে পারবেন তারা। আরও থাকছে যাত্রীদের প্রতিটি মুহূর্তের মুভমেন্ট নজরদারি করার উপায়। আজ মঙ্গলবার তাকে আনতে ঢাকা থেকে সিয়াটল যাচ্ছে বিমানের বিশাল এক টিম। সবকিছু ঠিক থাকলে হংসবলাকার প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট হবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা-লন্ডন রুটে। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী কোম্পানি বোয়িং কর্তৃপক্ষ বিমান প্রতিনিধিদের কাছে দ্বিতীয় হংসবলাকা হস্তান্তর করবে আগামী শুক্রবার। যা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরের পেনফিল্ড বিমানবন্দর থেকে টানা প্রায় ১৬ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছবে রবিবার। আসার পর হংসবলাকার অন্য প্রক্রিয়া যেমন রেজিস্ট্রেশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সব প্রক্রিয়া শেষ হতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। তারপর হবে প্রোভেন ফ্লাইট। সেটা সন্তোষজনক হলে হংসবলাকা উড্ডয়নযোগ্য হবে। বিমান জানিয়েছে, দ্বিতীয় ড্রিমলাইনার দিয়ে ঢাকা-লন্ডন রুটে সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি হংসবলাকা উড়বে ঢাকা-দাম্মাম ও ঢাকা-ব্যাঙ্কক রুটে। দাম্মাম রুটে সপ্তাহে ৪টি এবং ব্যাঙ্কক রুটে হংসবলাকা দিয়ে ৩টি ফ্লাইট পরিচালিত হবে। বিমানের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন- হংসবলাকার যাত্রীরা এসব রুটে পাবেন আরামদায়ক ভ্রমণের নিশ্চয়তা। বিদ্যমান রুটগুলোতে ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়বে। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এএম মোসাদ্দিক আহমেদ হংসবলাকা নিয়ে বেশ আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ড্রিমলাইনার যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিমান নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। দ্বিতীয় ড্রিমলাইনার যুক্ত হওয়ার পর লন্ডন, দাম্মাম ও ব্যাঙ্কক রুটে এ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। যাত্রীদের নিরাপদ ও আরামদায়ক সেবা দিতে বিমান সচেষ্ট। অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নতুন উড়োজাহাজ বিমানকে সহায়তা করবে। টানা ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম ড্রিমলাইনার চালাতে অন্যান্য বিমানের তুলনায় ২০ শতাংশ কম জ্বালানি লাগে।
×