ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মঠ

সম্প্রীতির বন্ধনে সেবা, লক্ষ্য মানুষের সুখ শান্তি কামনা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৮

সম্প্রীতির বন্ধনে সেবা, লক্ষ্য মানুষের সুখ শান্তি কামনা

সমুদ্র হক ॥ মানুষের আত্মার শান্তি ও জগতের কল্যাণ কামনায় সম্প্রীতির বন্ধনে বগুড়ায় স্থাপিত হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম ও মঠ। ভারতের কলকাতার বেলুড় মঠের কার্যক্রমকে অনুসরণ করে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বগুড়ার এই আশ্রম পরিচালিত হবে। আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আতিয়া কান্তি বর্মণ জানালেন, বগুড়ার এই আশ্রমটি কার্যত ভারতের বেলুড় মঠের শাখা। যেখানে মানব কল্যাণের সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গত ২২ নবেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে বগুড়ায় আধুনিক নির্মাণশৈলীতে গড়া দৃষ্টিনন্দন এই আশ্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও উৎসর্গ অনুষ্ঠানের কার্যসম্পন্ন করেন ভারতের রামকৃষ্ণ মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুড় মঠের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বামী সুহিতানন্দনজী মহারাজ। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গ-গ্রাম এলাকায় এই রামকৃষ্ণ আশ্রমের অবস্থান। সংস্কৃত ভাষায় ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আশ্রমের মূলমন্ত্র। যার অর্থ আত্মার শান্তি ও জগতের কল্যাণ সাধন। প্রকৃতি ও বিশ^ ব্রহ্মা-ের যা কিছু আছে তার মঙ্গল কামনার সঙ্গে মানবের হিংসা বিদ্বেষের উর্ধে উঠার সাধনা এবং পৃথিবীর সব মানুষের সুখ ও শান্তি কামনাই এই আশ্রম ও মঠের প্রধান লক্ষ্য। যেখানে সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে। সকলেই নিজের পরিবারের ও মানুষের আত্মার শান্তি মঙ্গল কামনায় ধ্যানে বসতে পারবেন। তাদের জন্য পৃথক সুপরিসর ঘরের ব্যবস্থা থাকছে। এমনই শৈল্পিক নৈপুণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে আশ্রমের অবকাঠামো। সুদৃশ্য সীমানা প্রাচীরের ভিতরে গেরুয়া রঙের মন্দির ভবন। যাতে আছে তিনটি চূড়া। তার পাশে তিনটি কুড়েঘরের আদলে অবকাঠামো। আশ্রমে শিক্ষায়তন, ছাত্রাবাস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাধু নিবাস, সুপরিসর বারান্দা, চিকিৎসালয়, অফিস কক্ষ, উপাসনালয়, ধ্যান ও আরাধনা কক্ষ, পূজা অর্চনার নির্ধারিত স্থান। পুরো চত্বর সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। আশ্রমের সভাপতি ডাঃ বিপ্লব কুমার বর্মণ জানালেন, নিত্য পূজা, বিশেষ পূজা, দীক্ষাদান, কথা অমৃত পাঠ, অনাথ আর্তদের মধ্যে অন্ন বস্ত্র বিতরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায়দের মধ্যে সহযোগিতা এবং দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবাসহ বেলুড় মঠের সব কার্যক্রম থাকবে এই আশ্রমে। প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি ৬ তলার। শীঘ্রই বহুতল ভবনের কাজ শুরু হবে। যেখানে থাকবে পাঠাগার, কনভেনশন সেন্টার, আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প। বিশেষ করে কম্পিউটারসহ ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যক্রম। অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের দিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে ডিজিটাল প্রযুক্তির যাবতীয় বিষয়ে প্রশিক্ষন দিয়ে একুশ শতকের প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী ‘এক হাতে কর্ম কর আরেক হাতে ইশ^রকে ধর শিবজ্ঞানে জীব সেবা’, স্বামী বিবেকানন্দের অমর বাণী ‘মানুষের পরিচয় মানুষ’ শ্রীমা সারদার বাণী ‘ভাঙতে সবাই পারে গড়তে পারে কজনে’ এমন বাণীর দীক্ষায় পরিচালিত হবে আশ্রম। সব মিলিয়ে বেলুড় মঠ ও রামকৃষ্ণের ভাবধারায় ছড়িয়ে দেয়া হবে। আশ্রমের কর্তৃপক্ষ জানালেন, হাতেগোনা কজন ভক্তের উদ্যোগে ৩১ বছর আগে বগুড়ায় রামকৃষ্ণ মিশনের ভাবধারার প্রচার কাজ শুরু হয়। ১৯৯২ সালে বগুড়ার ১২ জন ভক্ত দিনাজপুরের আশ্রম থেকে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করে। পরের বছর অধ্যক্ষ স্বামী অমৃতানন্দজীর প্রেরণায় বগুড়ায় শ্রীমা সারদা সেবা সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৪ সালে নাম পরিবর্তন করে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা সেবা সংঘ নামকরণ করা হয়। তখন বগুড়া নগরীর জলেশ^রিতলায় কালি মন্দিরের একটি কক্ষে রামকৃষ্ণের পট স্থাপন করে কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে সেউজগাড়ির নারয়ণ চন্দ্র ম-ল রামকৃষ্ণ আশ্রম বগুড়ার নামে অর্ধ নির্মিত পাকা বাড়িসহ ৫ শতাংশ জমি দান করেন। ওই সময় নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নামকরণ ‘শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বগুড়া’ করা হয়। একই সঙ্গে যা একটি মঠ। আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক জানান, স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ ও ভাবধারার বিশাল কর্মযজ্ঞ ছোট্ট জায়গায় সঙ্কুলান না হওয়ায় নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়। দিনে দিনে কর্মপরিধি বেড়ে যাবে সুদূরপ্রসারি ভাবনায় এই জমি বিক্রি করা হয়। বিক্রীত অর্থের সঙ্গে ভক্তদের দান এবং অনুদানের অর্থে ২০০২ সালে শাহাজানপুর উপজেলার গ-গ্রামে জমি কেনা হয়। এই জমিতে ২০০৩ সালের ২৭ জুন আশ্রম প্রতিষ্ঠা কাজের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী অক্ষরানন্দজী মহারাজ (প্রয়াত)। এরপর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বহুতল ভবনের কাঠামোয় আশ্রম নির্মিত হয়ে আংশিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রামকৃষ্ণ আশ্রমের উদ্বোধনকে ঘিরে ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে জলেশ^রিতলা পুরাতন মন্দির হতে শোভাযাত্রাসহ স্বামীজীর পট আনয়ন, নবনির্মিত মন্দির পরিক্রমা ও শুভ উৎসর্গানুষ্ঠান, মন্দিরের উদ্বোধনী নামফলক উন্মোচন, সম্প্রীতি শোভাযাত্রা, নরনায়ণ সেবা, মঙ্গল আরতি ও প্রার্থনা, দীক্ষাদান অনুষ্ঠান, বাস্তু পূজা, পদাবলী কীর্তন, নগর কীর্তন, অধিবাস পূজানুষ্ঠান, বৈদিক শান্তিমন্ত্র পাঠ এবং ভারতের কলকাতা দূরদর্শনের শ্রীরামকৃষ্ণ বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানের সাধক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীসহ সর্বস্তরের মানুষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
×