ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

শেখ হাসিনা ॥ আস্থার অবিচল ঠিকানা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৬ নভেম্বর ২০১৮

 শেখ হাসিনা ॥ আস্থার  অবিচল ঠিকানা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় নিরন্তর আত্ম-প্রত্যয়ের সৃজন-সৌন্দর্যের উদ্ধৃতি নিবন্ধের শিরোনামকে পরিপূর্ণতাদানের উদ্দেশ্যই যেন নিবেদিত ছিল- ‘আমি নইলে মিথ্যা হতো সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যা হতো কাননে ফুল ফোটা।’ এই ধরিত্রীর কল্যাণকর সবকিছুই মানুষের জন্য। মহান স্রষ্টার অপরিসীম কৃপায় বৈশ্বিক সকল প্রপঞ্চ এবং মানবভাবনা এই বিশ্বকে করেছে অর্থবহ জীবনযাপনের উর্বর লীলাভূমি। কখনও বেদনা, যন্ত্রণা-শোষণ-বঞ্চনা অথবা হাসি-কান্নার সরব বা নীরব বহির্প্রকাশ সভ্যতার আদি থেকে অদ্যাবদী জীবনপ্রবাহকে করেছে নানা মাত্রিকতায় নান্দনিক ও সৃজনশীল। বস্তুতপক্ষে মানুষের ধীশক্তির বিকাশ ও বিস্তার প্রসারমানতা অগ্রসরমাণ হয় নিজস্ব চিন্তা-চেতনার ইতিবাচক সুস্থ প্রবাহে। এর পেছনে থাকে ঐতিহ্য-কৃষ্টি-পরিবার এবং সর্বোপরি মননশীল সামাজিকীকরণের পরিক্রমা। বিশ্ব ইতিহাসের মহান নায়ক আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা যেন সেই অবিনশ্বর কীর্তিগাথার অবিনাশী শাণিত চেতনা। দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে বিশ্বমানবতার জয়গানে উদ্বেলিত প্রাণস্পন্দন সঞ্চারণে মহীয়সী নেত্রীর অভিনব মর্যাদায় বিশ্বপরিমন্ডলে সমাদৃত আমাদেরই প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বব্যাপী সকল বাঙালীর কণ্ঠে আজ নতুন করে ধ্বনিত হচ্ছে কবি সুকান্তের সেই অমিয় কবিতা-বার্তা- ‘শাবাশ বাংলাদেশ এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারকার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার মন্ত্রে শোভিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর করে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার অপূরণীয় বিসর্জনে এর সার্থক রূপায়ণে উপহার দেন আজকের এই প্রিয় মাতৃভূমি। এই মহান নেতাই সেই সর্বপ্রথম বাঙালী যিনি বিশ্ব দরবারে তথা জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষাকে করেছেন বিশ্বজনীন ও নন্দিত। দ্বিতীয়বার আবারও একই জায়গায় মাতৃভাষায় ভাষণ দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতিকে করেছেন সুমহান মর্যদায় সমাসীন। এমন প্রজ্ঞা, মেধা, সততা, দক্ষতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বনেতৃত্বে গৌরবদীপ্ত হওয়ার উদাহরণ আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে খুবই বিরল। সর্বগুণে গুণান্বিত এই নেতৃত্বের সাম্প্রতিক অর্জন ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড’। বাংলাদেশ এবং এশিয়া ও এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে নারী শিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তার বিকাশমানতার জন্য এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই প্রচন্ড আবেগ ও শক্তিমত্তায় দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে বঙ্গবন্ধু দেশকে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারে নতুন করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন সেই সময় দেশকে বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই কুৎসিত চরিত্রের কলঙ্কিত ও নিন্দিত কথিত নেতাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বা অকার্যকর বাংলাদেশ চরিতার্থ করার হীনমানসিকতার যে পরাজয় ঘটেছে তা সর্বজনবিধিত। ইতোমধ্যেই প্রায় মধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের মহাসড়কে বাংলাদেশর পদার্পণ বিশ্বস্বীকৃত। ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের সমমানে দেশকে উন্নীত করার কৌশলপত্র বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির বাংলাদেশকে উন্নয়ন বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মহান কান্ডারি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা। ১৪০০ সালকে অবগাহন করার জন্য রবিঠাকুর যেমন ১৩০০ সালে লিখেছিলেন ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে’, একইভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ২১০০ সালে দেশের জন্য বাস্তবসম্মত রূপকল্প উপস্থাপন এবং তার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের রোডম্যাপ পরিচালনা করছেন তা আজ কোন স্বপ্ন নয়, সময় ও যুগের দাবির প্রেক্ষিতে উৎকৃষ্ট দূরদর্শিতার প্রজ্বলিত বাতিঘর। এই সময়ের বিশ্বনন্দিত ও বরেণ্য সফল রাষ্ট্রনায়কের আসনে সমাসীন শেখ হাসিনাকে শত বছর পরে বাংলাদেশকে দেখার চিত্রায়ণে গভীর আবেগে রবিঠাকুরের আসনে কিঞ্চিৎ তাঁকে বসিয়ে দিলে দোষটা কোথায়? ডিসেম্বর মাস বাঙালী জাতির বিজয় ও গৌরবের। আগামী ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে এরই মধ্যে দেশের জনগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে এই নির্বাচনে সরাসরি দুইটি প্রধান প্রতিপক্ষ রয়েছে- একটি পক্ষ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আত্মবিশ্বাসী যাঁর নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ হাসিনা। অপরপক্ষে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের কথিত গণতন্ত্র সুরক্ষার উদ্দেশ্য বা এজেন্ডা সচেতন মহলের কাছে অতি সুস্পষ্ট। এদেশের আপামর জনগোষ্ঠী তাঁদের ভালভাবেই চেনে। তাঁদের আদর্শিক চিন্তা-চেতনা, অতীত কর্মকা-, পরিচিতি, নষ্টামি, ইতিহাস বিকৃতি, জঙ্গী উৎপাদন, দেশ-জাতি-রাষ্ট্র বিধ্বংসী অপকর্ম এবং অব্যাহত অপচেষ্টা সম্পর্কে জনগণের সম্যক ধারণা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁদের দল বদল, সুবিধাভোগ, অর্থ ও ক্ষমতা লোলুপতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্য বরাবরই জনগণের কাছে ধিকৃত। দেশ ও দেশের আপামর জনসাধারণের সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে পশ্চাৎপদ রাখা এবং দেশের অবারিত সম্পদ, সম্ভাবনাকে দেশবিরোধী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী- স্বার্থান্বেষী দেশ ও সরকারের কাছে দেশকে তুলে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে অনৈতিক পন্থা অবলম্বনে তাঁরা যে সিদ্ধহস্ত এটি সকলেরই জানা। তাঁদের অতীত ইতিহাস বারবার দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতে কেউ যেন আজ আর কুণ্ঠাবোধ করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনধিকৃত ও নিন্দিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পঙ্গুত্বদানকারী এই পাঁচমিশালী নেতৃত্বের কুঅঙ্গীকার বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, অন্ধকার ও সাম্প্রদায়িকতার পূঁজারি, জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ও আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক বাহিনী, অনৈতিকভাবে ক্ষমতা দখল, দুর্নীতির অভয়ারণ্যে দেশকে পরিণত করে নতুন জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ বিপথগামীদের নিয়ে উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাবাহিকতাকে রুদ্ধ করার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গভীর ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়নে তাঁদের অপচেষ্টা দেশবাসী নিঃসন্দেহে নিগূঢ়ভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। আজ দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে প্রাগ্রসরতা ন্যূনতম বিবেকপ্রসূত ব্যক্তির কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার সফল বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ যে অব্যাহত এবং অদম্য পন্থায় এগোচ্ছে তার ধারাবাহিকতা একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রায় পাঁচ কোটি ছিয়াত্তর লাখ তথা দেশের ৩২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অমিত সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ ও কার্যকর করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম, তথ্যপ্রযুক্তি, কারিগরি দক্ষতায় উৎকর্ষতা অর্জন এবং যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা অবশ্যই দলীয় অঙ্গীকারে বিশেষভাবে অধিকতর প্রাধান্যের দাবি রাখে। বিভিন্ন সূত্রমতে দুই কোটি ত্রিশ লাখ তরুণ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে প্রথমবারের মতো। এদের সংখ্যা কিন্তু এবার ভোটে জয়-পরাজয়ের নির্ধারণী নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে নিশ্চিতভাবে সেটি বলা যায়। অতএব, অত্যন্ত তাৎপর্যসহকারে তরুণদের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধানে যথার্থ অর্থে পন্থা উদ্ভাবন ও উপস্থাপন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বাপর দিনবদলের সনদের ভিত্তিতে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে যেভাবে সফল বাস্তবায়ন এবং অব্যাহত রাখা হয়েছে, শুধু তরুণ জনগোষ্ঠী নয়, দেশের সার্বিক কল্যাণে অবশ্যই এটি প্রশংসনীয় সফল এবং গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ। এরই ফলে সকল কর্মযজ্ঞ প্রায় সুসম্পন্ন করে দেশমাতৃকার চিত্রপট নতুন সাজে চিত্রিত হয়েছে এবং সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব সরকারে রূপান্তরের যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তদ্রুপ আগামী দিনেও এই সফলতাকে আরও বেগবান করে মেধা ও মননে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে বিশ্ব পরিম-লে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শেখ হাসিনার নির্ভীক সাহসিকতা ও নান্দনিকতা দিয়ে যে বলিষ্ঠ উচ্চারণ ‘আমরাও পারি’ পুরো বাংলাদেশকে নতুন সৃজন-শক্তিতে বলীয়ান করেছে এর ভিত্তিতে ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের মাধ্যমে ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশকে পৌঁছানোর পথকে সুগম করতে হবে। গত ক’দিন আগে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের সন্নিকটে দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত দ্বীপ ‘সন্দীপে’ বিদ্যুত বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকারকে নিধন করে পুরো দ্বীপে আলোর প্রজ্বালন ঘটানো হয়েছে, পুরো দেশকে সেভাবেই শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণসহ সকল ক্ষেত্রে যা কিছু অবশিষ্ট আছে, সময়ের পরিবর্তনে এবং জনসংখ্যার আধিক্য অনুসারে টেকসই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ করে সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রজন্মের সন্তানদের জন্য যথার্থ নিরাপদ বাসযোগ্য সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের কাছে শেখ হাসিনা ছাড়া আস্থার অবিচল আর কোন ঠিকানা আছে কিনা জানা নেই। দেশের সকল সচেতন ভোটারদের কাছে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করা ছাড়া আমাদের মতো ক্ষুদ্র এবং সাধারণ নাগরিকদের আর কিই বা করার আছে। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×