ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে কোন দিন খুলে দেয়া হতে পারে

আড়ালে থাকা তোশাখানা পেল জাদুঘরের মর্যাদা, সবার দেখার সুযোগ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৬ নভেম্বর ২০১৮

আড়ালে থাকা তোশাখানা পেল জাদুঘরের মর্যাদা, সবার দেখার সুযোগ

মোরসালিন মিজান ॥ মূল উপস্থাপনা ভবনের ভেতরে। ভেতরটাই দেখার। কিন্তু বাইরে থেকে চোখ আটকে যায়। কী যে সুন্দর একটি ভবন! অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলী। মডার্ন ফর্ম। এই আন্তর্জাতিক মান সৃষ্টিশীলতা একই ধরনের অজ বিল্ডিং দেখার ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়। বিশেষ ভাললাগা নিয়ে প্রবেশ করা যায় ভেতরবাড়িতে। না, বাড়ি এটি নয়। জাদুঘর। তোশাখানা জাদুঘর। সম্প্রতি রাজধানীর বিজয় সরণিতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে জায়গাটিতে সামরিক জাদুঘর, তার ঠিক পাশেই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছে নতুন সুরম্য ভবন। বহিরাঙ্গনের মতো অভ্যন্তরভাগেও চমক। ভবনের উপবৃত্তাকার শেইপ ক্রমে স্পষ্ট হয়। দারুণ আকর্ষণ করে। নতুন একটা ফিল পাওয়া যায়। নিদর্শন, আলোকচিত্র ইত্যাদি দিয়ে সাজানো জাদুঘরের প্রায় সব কাজই সম্পন্ন হয়েছে। এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার অপেক্ষা। যে কোন দিন খুলে দেয়া হতে পারে দ্বার। জাদুঘরটি, বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশেষ বৈশিষ্ট্যের। এখানে রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় সংরক্ষিত নিদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্থানান্তর করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় তোশাখানা হচ্ছে সেই সংরক্ষণাগার যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রী পুরস্কার স্মারক ইত্যাদি মজুদ করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনে তোশাখানা নির্মাণ করেছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। এখনও সেটি আছে। তবে সাধারণের দেখার কোন সুযোগ ছিল না। নেই। দেখার ব্যবস্থাটি করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব সময় আড়ালে থাকা, আলোচনার বাইরে থাকা তোশাখানাকে সামনে এনেছেন তিনি। বিজয় সরণীতে স্বতন্ত্র জাদুঘরের মর্যাদায় একে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পুরনোটি রাষ্ট্রীয় তোশাখানা হিসেবেই রয়ে গেছে। নতুনটির নাম তোশাখানা জাদুঘর। ৫০ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর তোশাখানা ভবনটি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায়। ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। তোশাখানার তত্ত্ববধানের দায়িত্ব পেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ভবনটি, আগেই বলা হয়েছে, উপবৃত্তাকার। সেভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য জাদুঘরের মতো অনেকগুলো খোপ বা কক্ষ করে সেখানে নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়নি। বরং বিশাল খোলা উন্মুক্ত গ্যালারি। প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন ১০ হাজার স্কয়ার ফিট। পাঁচতলা ভবনের প্রথম তলায় পা রাখতেই ভেতরে একটা আলোড়ন তুলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। ভবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ১২ফিট উঁচু বেদি। তার ওপর আবক্ষ ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। মূল ভাস্কর্যটিও ১২ফিট উঁচু। ব্রোঞ্জ মাধ্যমে চমৎকার কাজ করেছেন সুদীপ্ত। জাদুঘরের একেবারে উপরের অংশে একটি কাঁচের ডোম ব্যবহার করা হয়েছে। ফাইবার গ্লাসে ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকার একটি পেইন্টিং। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো অনায়াসে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। জাদুঘরটিকে তখন আর বদ্ধ ঘর বলে মনে হয় না। এছাড়া গ্যালারিগুলোতে অসংখ্য লাইট ব্যবহার করা হয়েছে। সবই অত্যাধুনিক। জাদুঘরে ব্যবহারের জন্য বিশেষ উপযোগী। জাদুঘরের প্রথম তলায় প্রবেশের মুহূর্তে চোখে পড়ে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র। বাইরের দেয়ালে স্থাপন করা কাঠের মানচিত্রে ভৌগোলিক অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা। ভেতরের একাংশে বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণী। অন্য অংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অগ্রগতির নানা চিত্র। এখানে ৯৩টির মতো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। উন্নয়নের একটি রেখাচিত্র তৈরি করে দেখানো হয়েছে। আর মেঝেতে গ্লাস শোকেস। সেখানে নানা নিদর্শন। হাতির দাঁতের নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি রাখা হয়েছে। আছে কাঠের কাজ করা হাতির মস্তক, বাঘ। পিতলের টিউবওয়েল আছে। টাচস্ক্রীন কিয়ক্স থেকে জানা যাবে আরও অনেক তথ্য। দ্বিতীয় তলাটি খুব স্পেশাল। এখানে বঙ্গন্ধু গ্যালারি। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতার বহুবিধ উপস্থাপনা। সবগুলো ছবির ফ্রেম কালো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তো ফ্রেমে বাঁধা যায় না। এই বোধ থেকে কিছু ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করা হয়নি। এখানে বঙ্গবন্ধুর পাওয়া ৩০টি উপহার সামগ্রী। নীল আর্মস্ট্রং বঙ্গবন্ধুকে দুর্লভ চাঁদের মাটি উপহার দিয়েছিল। এখানে সেটি রাখা হয়েছে। এখানেও অনেকগুলো নৌকা। গ্যালারির দক্ষিণ অংশে বিদেশ থেকে পাওয়া উপহার। উত্তরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রী। তৃতীয় তলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাওয়া উপহার সামগ্রী। ক্রেস্ট ছবি সনদ ইত্যাদি। আরব দেশ থেকে পাওয়া খেজুর গাছের মডেল, সোনার খেজুর, ঘোড়া ইত্যাদি রাখা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া চন্দন কাঠের বাক্স আছে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে এসেছে দামি কলম। কয়েন। ইন্দোনেশিয়া থেকে রূপার কাজ করা ছবি। ওই দেশের শিল্পীর গাছের ও ফলের রস দিয়ে আঁকা ছবি সাজানো হয়েছে দেয়ালে। একেবারে নিচে বেজমেন্ট ২। এখানে অন্যান্য নিদর্শন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বেজমেন্ট ১ এ চারজন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পাওয়া নিদর্শন। জিল্লুর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আবু সাইদ চৌধুরীর পাওয়া উপহার সামগ্রী আছে এখানে। ছোটদের জন্য রাখা হয়েছে কিয়ক্স সেন্টার। বাচ্চাদের জন্য নানা ডিজিটাল গেম রাখা হয়েছে। বড়দের জন্য আছে আরেকটি কিয়ক্স সেন্টার। এখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাবে। জানা যায়, গ্যালারির ভেতরের অতিরিক্ত আর্দ্রতা বা ময়েশ্চার শুষে নিতে ব্যবহার করা হয়েছে ডিহিউমিডিফায়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনায় এ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানা যায়। প্রকল্প পরিচালক লেঃ কর্নেল মোঃ মাহবুবুল ইসলাম জানান, জাদুঘর ভবনের বাইরে কিছু কাজ হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কাজ শেষ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এর পর যে কোনদিন তারা দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর খুলে দিতে পারবেন।
×