ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

আসছে বিজয়ের ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

 আসছে বিজয়ের ডিসেম্বর

নবেম্বরের একুশ তারিখে যখন সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত হয় তখনই পুরো জাতি একাত্তরের বিজয়ের স্মৃতিতে আপ্লুত হয়। এবারও এই দিনটির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। আমি বুঝি, পুরো জাতির মনে পড়ে যায় আমরা সেদিন আমাদের জাতীয় সামরিক বাহিনী গড়ে তুলি। বস্তুত পুরো একাত্তর জুড়েই তো ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথে যাত্রা আমাদের। সেই ২৬ মার্চের পর মুজিবনগর সরকার গড়ে তোলা এবং তারপর মুক্তিফৌজ, মুজিব বাহিনীর জন্ম থেকে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা ১৬ ডিসেম্বরের দিকে ধাবিত হয়েছি। যার জীবনে একাত্তর ছিল তার পক্ষেও সেই সময়টাকে কলমে উপস্থাপন করা কঠিন। অন্তত এখনও আমি আমার নিজের অনুভবকে প্রকাশ করতে পারিনি। কেউ সেভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলেও মনে হয় না। আমি নিশ্চিতভাবেই এটি বিশ্বাস করি, আমরা আমাদের একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মকে কেবল একাত্তর নয়, একাত্তর যেসব সিঁড়ি বেয়ে তৈরি হয়েছে, যেমন ৪৮, ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৮ বা ৭০-এর বিবরণও তুলে ধরতে পারিনি। এসবের খ- খন্ড চিত্রই কেবল হয়ত আমরা উপস্থাপন করতে পেরেছি। এজন্য আমি আমাদের নতুন প্রজন্মকে কেবল বলতে পারি যে, নিজের দেশের ঐ নয় মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যা যা বর্ণিত হবে সেটাই পড়বে, দেখবে, শুনবে ও জানবে। বাঙালীর জীবনে এমন সময় এর আগে কখনও আসেনি, আগামীতেও আসবে না। ২১ নবেম্বর সশস্ত্র দিবসের দিনটি ঠিক সেভাবে প্রচারিত হয়নি এবং আমাদের সন্তানদের কাছে সেটির গুরুত্ব তেমনভাবে তুলে ধরা হয়নি বলে সেটি সেনানিবাসের ভেতরেই সীমিত থেকে যায়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম ও তার গুরুত্বটা আমাদের নতুন প্রজন্মের আরও বিস্তারিত জানা দরকার। কেবল তাই নয়, আমাদের নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার আগের মাসের উত্তাপটা অনুভবই করতে পারে না। বস্তুত সাধারণ মানুষ ডিসেম্বরের ৬ তারিখটিতেই বাঙালীর বিজয়ের আনুষ্ঠানিক উদযাপনের প্রথম স্মৃতিটা খুঁজে পায়। সেদিন স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় বিজয়ের বিপুল আনন্দ অনুভব করি আমরা। অন্যদিকে নবেম্বরেই বাংলাদেশের সুনিশ্চিত বিজয়ের আভাস পাওয়া গেলেও দেশটিতে ডিসেম্বরের শুরুতেই মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠা শুরু করে। কিছু এলাকা ১৬ ডিসেম্বরের পর শত্রুমুক্ত হলেও বস্তুত ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পুরো দেশটা প্রায় হানাদারমুক্ত হয়। নবেম্বরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক জন্ম, মুক্তিবাহিনী-মুজিব বাহিনীর তীব্র গেরিলা হামলা ও ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতের অংশগ্রহণ পাকিস্তানী হানাদারদের মনোবল গুঁড়িয়ে দেয়। বস্তুত ডিসেম্বর মাসটির সূচনার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অনেক এলাকা শত্রুমুক্তও হতে থাকে। ফলে প্রতিটি দিনই আমার মতো লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত স্মৃতি অনেক বেশি জেগে ওঠে। আমরা অনুভব করি জীবনের সেই শ্রেষ্ঠতম সময় এই জীবনে আর কখনও ফিরে আসবে না। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় যে, জাতির এত বড় একটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। কৈশোর-তারুণ্য থেকে স্বাধীন বাংলার স্বপ্নের লড়াই, স্বাধীন বাংলাদেশ ধারণা ও বাঙালী জাতিসত্তার জন্মের লড়াই এবং একাত্তরের মার্চ থেকে সশস্ত্র লড়াই ও জীবন নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলো দেখে এই ডিসেম্বর মাসে আনন্দ, শঙ্কা আর ভয় নিয়ে কাটছিল পুরো জাতির সময়। ৭১ সালে আমাদের মতো বিশের কোঠা অতিক্রমকারী যুবকদের জন্য সময়গুলো ছিল টান টান উত্তেজনা আর নানামুখী ঘটনায় ভরা। আমার রাজনীতির সূচনা ৬৬ সালে। ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে একদিকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করি, অন্যদিকে রাজনীতিতে যোগ দিই। যারা সেই সময় ঢাকা কলেজে পড়েছেন তারা জানেন যে, সরকারী সেই কলেজটিতে রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। কলেজের অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদ আমাদের কলেজের ভেতরে একটি লিফলেটও বিতরণ করতে দেননি। ৬৭ সালে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। আমরা সেই বছর থেকে নিজেদের একটু বেশি শক্তিশালী ভাবতে থাকি। ধীরে ধীরে দেশের অবস্থাও বদলাতে থাকে। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের শাখা থাকলেও আমরা কলেজের ভেতরে কোন রাজনীতি করতে পারতাম না। ’৬৮ সালে যেদিন ঢাকার রাজপথে প্রথম স্লোগান দিয়েছিলাম বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, সেদিন থেকেই ভাল কিছুর জন্য লড়াই করছি, ভাল কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি। বড় কিছুর জন্য লড়াই করছি, বড় কিছু করার চেষ্টা করছি। একাত্তরে বিজয়ের জন্য লড়াই করেছি। বস্তুত একাত্তরের আগেও বিজয়ের জন্য লড়াই করেছি। বিজয়ের জন্য সেটিই সম্ভবত প্রথম বড় লড়াই। ’৭০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ তৈরির প্রথম লড়াইটা ছিল নির্বাচনকে ঘিরে। একাত্তরের পরও বিজয়ের জন্য লড়াই করছি। ব্যক্তিগতভাবে এই লড়াই আমার জীবনব্যাপী লড়াই। এবার ১৮ সালেও সেই ৭০-এর মতো একটি নির্বাচনী লড়াই উপস্থিত হয়েছে। ’৮৮ সালের বিজয় দিবসে বিজয় বাংলা কীবোর্ড প্রকাশ করেছি। সেই বিজয়ের এবার তিন দশক পার হচ্ছে। ২০০৮ সালের ৬ ডিসেম্বরই আমি আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসের দোতলায় বসে দিন বদলের ইশতেহারের রূপকল্প ২০২১ সংবলিত নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের শব্দটি লিখেছিলাম। ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ সেটি আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির অনুমোদন পেয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ আমি এসোসিওর হংকং সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করেছিলাম। তার আগের বছর স্বাধীনতা দিবসে ডিজিটাল বাংলাদেশ নামক একটি নিবন্ধ প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। মাসিক কম্পিউটার জগৎ পত্রিকার এপ্রিল সংখ্যায়ও সেই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ জননেত্রী শেখ হাসিনা সেটি ঘোষণা করেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক প্রথম সেমিনার করেছিলাম। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ আমি প্রথম আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ দেশের প্রথম ডিজিটাল স্কুল চালু করি। এই মাসে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি আরও অনেক বড়। ৯ ডিসেম্বর আমি প্রথম বাবা হই। আমার বড় মেয়ে সাবরিনা শারমিনের জন্ম সেদিন। প্রতি বছর যখন ডিসেম্বর মাস আসে তখন আমার ছেলে, যার নাম বিজয়, সে প্রায় প্রতিদিন তার বাবা-মার সঙ্গে ইতিহাস নিয়ে কথা বলে। কয়েক বছর আগে সে মায়ের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে গিয়েছিল। তার মা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে মুজিব বাহিনীর অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমিও গিয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। ওখানে সে তার বাবা-মায়ের বন্ধুদের কাছে গল্প শুনেছে তার ১৮ বছর বয়সী মা কেমন করে বাঞ্ছারামপুরের গ্রাম থেকে পালিয়ে ভারত গিয়েছিল, কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এবং তারও পরে দেশে ফিরে কেমন করে রাজনীতি করেছে। বাবার কথা বেশি শুনেছে সাংবাদিক হিসেবে। বাবার যুদ্ধক্ষেত্রটা হাওড়ে এবং সেখানে সে প্রায় যায়ইনি বলে বাবার যুদ্ধের কথা সে খুব একটা জানে না। এখন সে প্রায় প্রতিদিনই প্রশ্ন করে, তোমরা কেমন করে মার্চ মাস তৈরি করলে, কি করলে তখন, নয় মাসে তোমাদের কি কি অভিজ্ঞতা রয়েছে এসব নিয়ে। এতদিন তার মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোন কৌতূহল ছিল না, পাকিস্তান কেন ভাঙ্গা হলো এবং পাকিস্তানের জাতীয়তার সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয়তার কি কি পার্থক্য আছে, মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও মৌলবাদ কেন আমাদের চালিকাশক্তি হতে পারে না এসব বিষয় নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ। আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখলাম সে নিজেই বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বর্তমান নিয়ে একটি তূলনামূলক চিত্র তৈরি করেছে। পাকিস্তানে জঙ্গীবাদের বিকাশ, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ত, মৌলবাদ এবং ক্রমশ পেছনে পড়ার বিষয়টি এখন সে মিডিয়ায় পায়। কদিন আগে এক টক শোতে একজন পাকিস্তানী যখন পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বানানোর কথা বলেছে তখন সে নিজেই গর্র্বিত হয়েছে। আমার কাছে ওর যে বাক্যটি সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটি হলো- তোমরা পাকিস্তান ভেঙ্গে আমাদের একটি জগদ্দল পাথরের নিচ থেকে রক্ষা করেছ। যদি তোমরা তা না করতে তবে আমরা এখন তালেবান থাকতাম এবং সারা দুনিয়ায় মুখ দেখাতে পারতাম না। সে তার মাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছে বাংলাদেশ কোন্ কোন্ সূচকে পাকিস্তানের চাইতে এগিয়ে আছে। ওদের মাঝে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা লক্ষ্য করেছি সেটি হলো, কাজটি কেন এখনই হচ্ছে না। তাতে অস্থিরতা কাজ করে। ইন্টারনেটের গতি নেই কেন বা দাম কেন বেশি সেটি যেমন করে ওদেরকে ভাবায়, তেমনি করে পেপাল নেই কেন বা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে সচিবালয় এখনও এনালগ কেন, সেটিও এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বিশাল প্রশ্ন। আমি মাত্র কদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেয়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকটি আমার ছেলেকে বলছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম বাংলাদেশের নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক তথ্যগুলো। আমাদের মেয়েরা যে বিশ্বের অন্যতম সেরা ওয়ার্কফোর্স সেটি ওকে বোঝাতে হলো না। আমাদের মা ও শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক অগ্রগতি ছাড়াও কৃষক, প্রবাসী বাংলাদেশী ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের অর্জন নিয়ে ওকে নিজেকেই গর্ববোধ করতে দেখলাম। স্বাধীনতার পরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির গল্পটা সে জানে। সে এটিও জানে যে, মাত্র ৭০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু এবং এখন আমরা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বাজেটের মাঝে পৌঁছেছি। ওর নিজের কাছে অবাক লেগেছে যে, হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি খালের জন্য বরাদ্দ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হতে পারে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয়যাত্রা থেকে শুরু করে আউটসোর্সিংয়ে ওর প্রজন্মের সফলতাসহ আমাদের সকল অর্জনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখে। নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাতে পারি এজন্য গর্ব করে। ২০০৮ সালে ৫৫০ ডলারের মাথাপিছু আয় ১৭৫৩ ডলার হয়েছে এটি ওর কাছে বিস্ময় মনে হয়। যেদিন আমাদের সন্তান এমন সব বাক্য উচ্চারণ করেছে সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা একাত্তরে ভুল করিনি এবং মুক্তিযুদ্ধ করেও কোন ভুল করিনি। স্বাধীনতার এত বছর পর যাদের জন্য বাংলাদেশ গড়েছিলাম তাদের মাঝে আশার আলো দেখলে ভাল লাগে। এটিও ভাবতে ভাল লাগে যে, কেবল একটি দক্ষ, দুর্নীতিহীন প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো মীমাংসা করা গেলে সামনের এক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি সেরা দেশে পরিণত হতে পারে। আর সেই লক্ষ্যটি পূর্ণ হবে যখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারব এবং এর পরের স্তরে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ব। আমার বিশ্বাস ১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে ওরা আমাদের ৭০-এর বিজয়ের মতো বাংলাদেশকে বিপুলভাবে বিজয়ী করবে। ঢাকা, ২৩ নবেম্বর ১৮ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক
×