ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সারতাজ আলীম

ব্রিটিশ অর্থনীতি পৌঁছে গিয়েছিল ধ্বংসের কাছাকাছি

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

 ব্রিটিশ অর্থনীতি পৌঁছে গিয়েছিল ধ্বংসের কাছাকাছি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পূর্ব ইউরোপে নাৎসিদের বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছে ব্রিটেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কাগজের এক অস্ত্র প্রয়োগের পরিকল্পনা করে জার্মানি। যুদ্ধের পূর্বেই ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মান অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান আরথার নেব নকল পাউন্ড ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন। প্রপাগান্ডা ছড়ানোর দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী গোয়েবলস একে অদ্ভুত সুন্দর পরিকল্পনা বলে আখ্যা দেন। জার্মান অর্থমন্ত্রী ওয়াল্টার ফাঙ্ক পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হননি। কিন্তু হিটলারের সম্মতি পাবার পর নেবের উর্ধতন কর্মকর্তা রেইনহার্ড পুরোদমে জাল পাউন্ড তৈরির কাজে লেগে পড়েন। ১৯৪০ সালে বার্লিনে Sicherheitsdienst বিভাগের আওতায় প্রথম টাকা জালিয়াতি ইউনিট স্থাপিত হয়। এই বিভাগ অনেকটা গোয়েন্দা বিভাগের মতো কাজ করতো যার দেখভাল করতেন স্বয়ং হেনরিক হিমলার। জার্মানির সেরা গণিতবিদ, ব্যাংকার এবং বিশেষজ্ঞদের এনে জড়ো করা হয়। পাসপোর্ট, দলিল, সিল নকল করলেও দলটির মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ নোটকে নিখুঁতভাবে নকল করা। বিগত ২০ বছরে প্রিন্ট করা নোট বিশ্লেষণ শুরু করে তারা। পাউন্ডের নম্বরের ক্রম বিন্যাস কিভাবে জার্মানরা নির্ণয় করেছিল সেটা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। খোদাই কারকরা ৭ মাস চেষ্টার পর একটি ছাপ দেয়ার প্লেট তৈরি করতে সক্ষম হন যেটা পাউন্ড প্রিন্ট করতে পারবে। তবে প্রিন্ট ছাড়াও আরও কিছু কাজ থাকতো যেমন হাত দিয়ে ঘষেই টাকাকে একটু পুরনো রূপ দেবার চেষ্টা, নিরাপত্তা সুতা যোগ করা। ধারণা করা হয় প্রথম দফার ৩ মিলিয়ন নকল পাউন্ড ছেপেছিল জার্মানরা, নিখুঁত না হওয়ায় খুব কম ব্যাবহার করা হয়েছিল। পরিচালক নওজক্সের উপরে ভরসা হারান হিমলার। দায়িত্ব পান নাজি পার্টির সামরিক শাখা ওয়াফেন এসএস বাহিনীর মেজর বার্নহার্ড ক্রুগারকে। নতুন করে নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন বার্নহার্ড’। ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কয়েক মিলিয়ন ইহুদী তখন অবর্ণনীয় কষ্টকর মৃত্যুর অপেক্ষায়। ক্ষুদা, রোগবালাই, বিস্ফোরণের ক্ষত নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব শ্রম আদায় করে হত্যা করা হতো বন্দীদের। হিটলারের ইহুদী নিধনের অংশ হিসেবে সমাজের সব স্তরের ইহুদীরাই গ্রেফতার হয়েছিল। ক্রুগার একের পর এক ক্যাম্পে ঘুরে খুঁজে বের করতে লাগলেন টাকা, পাসপোর্ট, দলিল জালিয়াতের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সব বন্ধীদের। তাছাড়াও যন্ত্রপাতির নির্ভুল স্কেচ করতে জানা ড্রাফ্টম্যান, খোদাইকর, পেইন্টার এবং ব্যাংকারদের এক করলেন তিনি। ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৬ জন কয়েদিকে ঝধপযংবহযধঁংবহ এ নিয়ে আসেন ক্রুগার। ৪ মাস পর আরও ৮০ জনকে। হিটলারের ওই নরকে কেউই আর ফিরতে চায় না বলে চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেগে পড়ে নকল টাকা তৈরির কাজে। সব মিলে ১৪০ জন বন্দী পালা করে রাতদিন কাজ করতে থাকে। ডিসেম্বরে জালিয়াতির এই ইউনিটটিকে টাকা তৈরির সব যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল দেয়া হয়। কাগজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেল ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কোন দুর্লভ গাছের পাতা ব্যবহার না করে সাধারণ মানের লিনেন থেকে কাগজ বানায়। বেশিরভাগ সময় পুরনো লিনেন আসতো ব্যবহার করা মেইল ব্যাগ থেকে। তবুও হুবুহু কাগজটা পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েদিদের মধ্যে সেরা জালিয়াত ছিলেন সলোমন। তিনি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশরা কাগজে সামান্য পরিমাণে তুরস্কের শন মেশায়। ব্রঞ্চউইগের একটা কাগজ কারখানায় জলছাপসহ বিশেষ ধরনের কটন পেপার উৎপাদন শুরু হয়। এবার কালি নিয়ে বিপাকে পড়ে জার্মানরা। কালি কাগজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় খানিকটা চুয়িয়ে পরে অস্পষ্ট একটা ভাব তৈরি করত। কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ নোটের কালির উপাদানগুলোও বের করে ফেলতে সক্ষম হয় তারা। সর্বশেষ বাঁধা নোটের নম্বরের অ্যালগোরিদমও বের করে ফেলে গণিতবিদরা। প্রাথমিকভাবে ১২০০০ পেপারশিটে কাজ শুরু হয় যেটার প্রত্যেকটায় ৪টা করে নোট প্রিন্ট করা যেত। ১ বছরের মাথায় এই দলটি প্রথম জাল নোট বানাতে সক্ষম হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে যখন ইউরোপের একেবারেই টালমাটাল অবস্থা তখন একটি দেশ দুই পক্ষেরই বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা ছিল। অস্থিতিশীল সময়ে নিজের শেষ সম্বলটুকু নিরাপদে রাখতে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর দারস্থ হতে শুরু করে দু’পক্ষের লোকজনই। জার্মানরা কিছু নকল নোট সুইস ব্যাংকগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। নগদ অর্থ গ্রহণের আগে খুব কড়াভাবে নোটগুলো যাচাই করতো সুইসরা। জার্মানরা বোকা বানাতে সক্ষম হয় সুইসদের। গ্রাহকের সন্তুষ্টি সুইসদের কাছে সবার আগে। কিন্তু জাল টাকা ছড়িয়ে গেলে অর্থনীতির সর্বনাশ হয় কিভাবে? দেখে নেয়া যাক। প্রথমত একটা দেশ প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা ছাপায় না। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত স্বর্ণের মজুদের ওপর ভিত্তি করে টাকা ছাপালেও বর্তমানে মোট জিডিপির ২-৩% অর্থ ছাপানো হয়। বাড়তি টাকা অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ডেকে আনবে। টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলেও পণ্য সরবারহ থাকবে আগের মতোই ফলে যার হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে সেই ভোগ করতে পারবে। দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ। অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে এটাই যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত টাকা তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। হঠাৎ করেই যখন কেউ আবিষ্কার করবে তার লকারে থাকা সব অর্থ জাল সে তখন রাতারাতি নিঃস্বে পরিণত হবে। সম্পদ হারানোর ভয়ে ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধই হয়ে যাবে। অর্থনীতি আবার ফিরে যাবে আদিম বিনিময় যুগে। ১৯৪৩ সাল নাগাদ ৬টা প্রিন্টিং মেশিনে ৬৩০০০ জাল নোট ছাপায় জার্মানরা। পরবর্তী ২ বছরে ১৩৪ মিলিয়ন নকল পাউন্ড জার্মানরা প্রিন্ট করেছে যার বর্তমান মূল্য ৩ বিলিয়ন পাউন্ডের কাছাকাছি। এর কতটা বাজারে ছড়িয়ে গিয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। কাগজ তৈরি থেকে শুরু করে ব্যাংকে ছড়িয়ে দেবার জন্য ধাপে ধাপে প্রচুর এজেন্ট কাজ করতো। এদের এক দু’জনকে গ্রেফতাররের পরপরই বার্নহার্ডের কথা আর চাপা থাকে না। ১৯৪৩ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ১০ পাউন্ডের উপরে সব নোট তৈরি করা বন্ধই করে দেয়। পরের বছর থেকে ৫ পাউন্ডের নোট বদলে শুরু করে তারা। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজারে থাকা সব পাউন্ড পরিক্ষা শুরু করে। ধারণা করা হয় ১৯৫৫ সালে রঙিন নোট না আসা পর্যন্ত নকল নোটের কিছু রয়ে গিয়েছিল। জার্মানরা পাউন্ডের পর এবার ডলার তৈরি করার নির্দেশ দেয়। ক্রুগারের ততদিনে সরকারের উঁচু পর্যায়ের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক। বন্দীরা উপলব্ধি করেছিল নকল ডলার তৈরি করতে পারলে নাৎসিদের আর তাদের প্রয়োজন হবে না। তখন সুস্বাদু খাবারের বদলে গুলি জুটবে। তাই ইচ্ছা করেই ধীর গতিতে ডলারের কাজ করতে থাকে তারা। কিন্তু ক্রুগার বিষয়টি ধরে ফেলেন। হত্যার হুমকি এবং বিবেকের দংশনের পরেও তারা ডলার তৈরিতে হাত দেয়। ডলারের নম্বরের অ্যালগরিগম ভাঙ্গতে সক্ষম না হওয়ায় ২০টি নম্বরবিহীন ডলার তৈরি করে পরীক্ষার জন্য ব্যাংকারদের কাছে পাঠায় তারা। এদিকে স্তালিনগ্রাডে পরাজয়ের পর সোভিয়েতরা জার্মানদের প্রতিদিনই ধাওয়া করে বার্লিনের দিকে এগিয়ে আসছিল। কয়েকবার জায়গা বদল করে এক পাহাড়ে গুহায় শেষবারের মতো স্থায়ী হয় দলটি। পরাজয় যখন নিশ্চিত সব রেকর্ড এবং যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে পালিয়ে যায় নাৎসি বাহিনী। বার্লিনের পতনের পর অনেক সামরিক অফিসার মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড নিয়ে আটক হন। বার্নহার্ডের গভীরতা আঁচ করতে পেরে মিত্রবাহিনী বেশ ব্যাপকমাত্রায় অনুসন্ধান শুরু করে। ২০০০ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে অভিযান চালানো সাবমেরিন দিয়ে কিছু জাল নোট উদ্ধার করা হয়। যুদ্ধের ময়দানে নকল অর্থ ছড়িয়ে দেবার ঘটনা কিন্তু এই একটা নয়। আমেরিকা যখন স্বাধীন হবার জন্য লড়ছে তখনই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম নকল অর্থ ছড়ানোর কথা শোনা যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা বেশ বড় পরিমাণ জাল নোট উত্তর ভিয়েতনামে ছেড়েছিল। ভারত সরকার প্রায়ই খুব জোর দিয়ে অভিযোগ করে থাকে যে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভারতে জাল রুপী ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। নোট নকল করতে পারলেও জার্মানরা শেষ পর্যন্ত ব্যাপক আকারে নকল নোট ছড়িয়ে দিতে পারেনি ঠিকই তবে এটা ঠিক তারা খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। অপারেশন বার্নহার্ড দিনশেষে ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেতই দিয়ে যায়। সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ
×