ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাম্পাসে ‘র‌্যাগ ডে’

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

ক্যাম্পাসে ‘র‌্যাগ ডে’

আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পাসে শিক্ষাজীবনের শেষ দিন। দীর্ঘ চার বছরের ক্লাস-পরীক্ষার ইতি ঘটিয়ে মিলিত হয় সবাই। পাশাপাশি সমাপ্তি ঘটে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, একসঙ্গে খেতে যাওয়া, হঠাৎ করে ঘুরতে যাওয়ার মতো সোনালি দিনগুলোর। নতুনভাবে জীবনের পসরা সাজাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এই সময়ে নিতে হয়। তাই একদিকে যেমন থাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ় প্রত্যয়, তেমনি অন্যদিকে থাকে সেই লক্ষ্য অর্জনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকি। সেই ঝুঁকিকে জয় করার দৃঢ় বিশ্বাস বুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন শিক্ষার্থীরা। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নের পর শেষের সময়টিকে স্মরণীয় করে রাখতে অনেকে উদযাপন করে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, বর্ণাঢ্য আয়োজনে। রঙের ছটা, টি-শার্ট, র‌্যালি, নাচ, গান আর ব্যান্ডদলের বাদ্যযন্ত্রের সুরে এদিন মুখরিত হয় পুরো ক্যাম্পাস। দীর্ঘ চারটি বছর বন্ধুদের সঙ্গে অতিবাহিত করে যে স্মৃতিগুলো জমা হয়; সেই স্মৃতির রোমন্থন হয় মার্কারের কালিতে বন্ধুদের টি-শার্টে। সেই অনুষ্ঠানে বিভাগের শিক্ষক আর জুনিয়র শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নের পর শিক্ষাসমাপনী অনুষ্ঠান ‘র‌্যাগ ডে’র চিত্র সাধারণত এরকমই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘র‌্যাগ ডে’তে তাদের নানা আয়োজন, চার বছরের ক্যাম্পাস জীবনের শেষে আবেগ, অনুভূতি ও সোনালি দিনগুলোর কথা। জানা যায় সামনের দিনগুলোতে, সমাজ, দেশ এবং জাতি গঠনে তাদের পরিকল্পনার কথা। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩-১৪ সেশনের মোট ২৮টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নের পর গেল অক্টোবর ও চলতি নবেম্বরে শিক্ষাসমাপনী অনুষ্ঠান ‘র‌্যাগ ডে’ উদযাপন করে। এর মধ্যে বাংলা বিভাগের ‘র‌্যাগ ডে’ ছিল গত ৪ অক্টোবর। রঙের খেলা, টি-শার্ট, র‌্যালি, নাচ, গান আর ব্যান্ডদলের বাদ্যযন্ত্রের সুরে এদিন মুখরিত ছিল পুরো ক্যাম্পাস। প্রথমে কেক কেটে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নের এই দিনের উদ্বোধন করা হয়। পরে বিভাগের সকল গ্র্যাজুয়েটসহ সকল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বের হয় বর্ণাঢ্য র‌্যালি। রাতে ছিল শহরের এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে ডিনার। পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল সেই ডিনারে। গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থী তাহনিম তাবাসসুম সামা বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘ চার বছর কাটিয়েছি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সঙ্গে খেতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা, ক্লাস-পরীক্ষার পড়াশোনাসহ কত রোমাঞ্চকর স্মৃতি আছে, যা কোনদিন ভোলার নয়। এখন নতুন জীবনের যাত্রা শুরু। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীদের দুই দিনব্যাপী ‘র‌্যাগ ডে’ ছিল ১৫ ও ১৬ নবেম্বর। প্রথম দিন রং খেলা আর র‌্যালির পাশাপাশি দ্বিতীয়দিন ছিল ডিনার ও ডিজে পার্টি। বিভাগের সকল শিক্ষার্থী সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আনন্দ আড্ডায় মেতে উঠেছিল। এই বিভাগের শিক্ষার্থী এসএম মিয়া আরাফ বলেন, অত্যন্ত রোমাঞ্চিত দিন কাটিয়েছে বিগত পাঁচটি বছর। সেশন জটের কারণে একটি বছর বেশি লেগেছে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন হতে। একসময় খারাপ লাগত সেশন জটের কারণে। এখন চলে যেতে হবে ভেবে খারাপ লাগছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পালি এ্যান্ড বুদ্ধিস্ট বিভাগের ১০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থীদের দুই দিনব্যাপী ‘র‌্যাগ ডে’ অনুষ্ঠান ছিল গত ১৯ ও ২০ নবেম্বর। এই বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন বলেন, প্রথমদিন ছিল রঙের খেলা, র‌্যালি, পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে নাচ, গান, আড্ডা এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভাগের শিক্ষার্থীদের মনোজ্ঞ পরিবেশনা ছিল। দ্বিতীয় দিন ছিল ডিনার। তবে একটু ব্যতিক্রমভাবে শিক্ষাসমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশে কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ সেশনের এগ্রিকালচার ফেকাল্টির শিক্ষার্থীরা। ১৩, ১৪, ১৪ নবেম্বর তিন দিনব্যাপী তাদের ‘র‌্যাগ ডে’ অনুষ্ঠানের শুরু হয় র‌্যালির মাধ্যমে। প্রথম দিনের আয়োজনের মধ্যে ছিল বারবিকিউ পার্টি, আল্পনা, ক্লাসরুম সাজানো। এই ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থী নাবিল তাহমিদ রুশদ বলেন, আয়োজনের দ্বিতীয় দিন ছেলেরা ফরমাল শার্ট ও মেয়েরা শাড়ি পরে রিক্সা চড়ে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। ঐদিন বিকেলে আমরা নৌকা চড়তে বের হলাম ব্রহ্মপুত্র নদীতে। শেষের দিন ছিল টি-শার্ট পরে রঙের খেলা ও রাতে ডিনার। রুশদ বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাসে চারটি বছর এক সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছি। এটি জীবনের একটি বড় অধ্যায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট থাকায় ঠিক সময়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারেননি বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এমনই একটি বিভাগ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা। এ বিভাগের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ‘র‌্যাগ ডে’ ছিল গত ২২ নবেম্বর। এই বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থী আফরিন আরা বলেন, এখানে সেশন জটের কারণে অনেক দিন থাকতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু রাবির চারুকলা এমন একটি বিভাগ, যেখানে সেশনজটের কথা ভুলেও মনে হবে না। যদিও আমাদের অন্য বিভাগের বন্ধু-বান্ধবীরা অনেকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে, তবুও কষ্ট হয়নি। ভালো ছিলাম প্রাণের চারুকলায়। ‘র‌্যাগ ডে’ হয়ে গেল। হয়তো খুব বেশিদিন এখানে আমরা আর থাকব না। সেশন জটের কারণে নির্ধারিত সময়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পারেননি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থীরাও। তাদের ‘র‌্যাগ ডে’ ছিল ৮ নবেম্বর। ৪৭তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থীরা ৪৭টি ফানুস উড্ডয়নের মাধ্যমে তাদের ‘র‌্যাগ ডে’র উদ্বোধন করেন। এ বিভাগের থেকে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী জাহেদ আউয়াল বলেন, আমাদের ‘র‌্যাগ ডে’র আয়োজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বিভাগের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছেন অনুষ্ঠানে। আমরা একসঙ্গে কেক কেটেছি, ফানুস উড়িয়েছি, ফ্লাশমব করেছি। ক্যাম্পাসে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, হলে থাকার সুবাদে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাসের সুবাদে সম্পর্ক একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বন্ধু-বান্ধদের সঙ্গে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি, আড্ডা দিয়েছি, ভাল সময় কাটিয়েছি, যা সারাজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে বিভিন্ন বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীরা ‘র‌্যাগ ডে’ উদযাপন করলেও একইসাথে সকল বিভাগের সমন্বয়ে ‘গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি’ উদযাপান করেছে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। দুই দিনব্যাপী বর্ণিল সাজসজ্জা ও আয়োজনে মেতেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। গত ১৩ ও ১৪ অক্টোবর দুদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি আয়োজন করেছিল ‘গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি’। ‘আরক্তিম’ নামক ব্যাচটির মূলমন্ত্র ছিল ‘অথৈ সম্ভাবনায় ছিড়ে ফেলি ঊর্নাজাল’। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসিমুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসে শিক্ষাসমাপনী অনুষ্ঠান ‘র‌্যাগ ডে’ নামে না হয়ে গ্রাজুয়েশন সিরিমনি’ নামে হয়। ‘র‌্যাগ ডে’র মাধ্যমে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবনের পথচলার ইতি ঘটে অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নের পর কেউ উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে আত্মনিবেশ করেন। আবার কেউ চাকরি জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে হাল ধরেন নিজ পরিবারের। কর্মজীবনে প্রবেশের মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত হন তারা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী মেহেদী কবির বলেন, রাষ্ট্র আমাদের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করে থাকে। একটি রাষ্ট্রের মূল সম্পদ হলো তার শিক্ষিত তরুণ সমাজ। তাই আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া সকল শিক্ষার্থীরই উচিত কর্মজীবনে প্রবেশের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে, দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করা।
×