ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলু আবাদের কঠিন কাজ সহজ হয়েছে বহুমুখী পাওয়ার টিলারে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

 আলু আবাদের কঠিন কাজ সহজ হয়েছে বহুমুখী পাওয়ার টিলারে

সমুদ্র হক ॥ প্রধান খাদ্যশস্যের তালিকায় আলু এখনও দ্বিতীয় অবস্থানে আসেনি। তবে কৃষি প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রায় সুদূর প্রসারী ভাবনায় দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গমের ওপরে উঠতে যাচ্ছে আলু। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত পাওয়ার টিলারকে আলু আবাদের বহুমূখীকরণ করা হয়েছে। আগে আলু আবাদ ছিল কষ্টসাধ্য। জমিতে আলু বীজ রোপণের জন্য বিশেষ ধরনের বেড তৈরি করতে হতো। শ্রমিক, খরচ ও সময় বেশি লাগত। প্রযুক্তির নতুন উদ্ভাবনে পাওয়ার টিলারের সঙ্গে একটি কম্পোনেন্ট বা ইউনিট যোগ করে বেড তৈরি ও বীজ রোপণ করা হচ্ছে। এরপর পর আলু উত্তোলনের সময় আরেকটি ইউনিট যুক্ত করে যন্ত্রে হারভেস্ট (উত্তোলন) করা যাবে। এছাড়া জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার তো থাকছেই। প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রায় এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ফার্ম মেশিনারি এ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট প্রসেস (এফএমপি) ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়ার টিলারকে বহুমুখী করা হয়েছে। প্রকল্পের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান গবেষক (যিনি এই উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত) ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক জানান, এই বহুমূখী প্রযুক্তি আলু আবাদের জমিতে একবারই লাইন তৈরি করে দেয়। তারপর লাইনের নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ রোপণের পর মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। আবাদের পুরো প্রক্রিয়াটি করে এই টিলার। সারাদেশে আলুর আবাদ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম আলু উৎপাদন এলাকা বগুড়ায় আলু উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বগুড়ার আলুর বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলো : অন্যন্য জাতের আলুর সঙ্গে বগুড়ার হাগরাই আলু (সুস্বাদের আঠালো আলু) দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। আলু আবাদ করা অন্যান্য আবাদের মতো সহজ নয়। ধান পাট সবজিসহ সকল ধরনের আবাদ সমতল ভূমিতে চাষ দিয়ে করা যায়। আলু আবাদের জন্য শুধু লাঙ্গল চাষেই যথেষ্ট নয়। বীজ রোপণের জন্য ভূমিকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় রেখে সমান্তরাল লাইন বানিয়ে বেড তৈরি করতে হয়। এই বেডে নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপণ করতে হয় বীজ। প্রকল্পটির বিজ্ঞানীরা আলু চাষের জন্য প্রচলিত পাওয়ার টিলারকে বিশেষায়িত করে তুলছেন। পাওয়ার টিলার দিয়ে জমিকে সমতল করে চাষের পর আলু আবাদের বেড তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য পাওয়ার টিলারের সঙ্গে প্রযুক্তির একটি কম্পোনেন্ট যুক্ত করা হয়েছে। এই টিলার স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রথমে আলু বীজ রোপণের জন্য মাটিকে সামান্য উচ্চতায় নিয়ে কয়েকটি লাইন বানায়। তারপর এই বেডের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে আলু বীজ রোপণ করে দেয়। রোপণের পর যন্ত্রই বীজকে ঢেকে দেয়। আলুর ফলনের পর এই টিলারে আরেকটি কম্পোনেন্ট যুক্ত করে মাঠেই আলু তুলে বস্তায় ভরে দেয়া হয়। এভাবে আলু আবাদের প্রতিটি কাজেই এখন ব্যবহার হচ্ছে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি। এতে সময় ও খরচ অনেক সাশ্রয় হয়েছে। পুরানো পদ্ধতিতে আলু আবাদে কৃষি শ্রমিকের দরকার হতো ২৪ জন। প্রযুক্তির উদ্ভাবনে এখন প্রতি হেক্টর আলু আবাদের জমিতে বেড বানিয়ে বীজ রোপণে দরকার হয় মাত্র ৩ জন শ্রমিক। অনেক কৃষক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। বগুড়ার গাবতলির চকসদু গ্রামের কৃষক মিলন আগাম আমন ঘরে তোলার পর আলুর চাষ শুরু করেছেন। বললেন, আগে ধান কাটার পর আলু আবাদে অনেকটা কষ্ট হতো। দ্রুত কাজ সারা যেত না। তাছাড়া আলুর জমি হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে বেড বানাতে অনেক শ্রমিকের দরকার হতো। খরচ বেড়ে যেত। সময়ও লাগত। উদ্ভাবিত পারওয়ার টিলারের বহুমুখী করনে আলু চাষ অনেক সহজ হয়েছে। তিনি জানালেন, আগে আলু আবাদে প্রতি হেক্টরে খরচ হতো প্রায় ১৭ হাজার টাকা। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে প্রতি হেক্টরে খরচ হচ্ছে ৪ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। এতে আলু আবাদে খরচ কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। এই বহুমূখী টিলার দিয়ে দিনে ৭ থেকে ১০ বিঘা জমিতে বেড তৈরি করা যায়। প্রতি ঘণ্টায় খরচ হয় দেড় লিটার ডিজেল। বগুড়ার কান্দাল ফসল গবেষণা উপ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার বললেন, বাংলাদেশের গবেষকগণই কৃষি যন্ত্রের আধুনিকীকরণ করছে। প্রচলিত যন্ত্রের সঙ্গেই নতুন প্রযুক্তি যোগ করে কৃষির সার্বিক ব্যবহারে মানুষের শ্রম, সময় ও ফসল উৎপাদনে ব্যয় অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। এই প্রযুক্তি প্রকল্পের বিজ্ঞানী গবেষক ড. এরশাদ জানালেন, বর্তমানে একটি পাওয়ার টিলারের দাম এক লাখ টাকা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আলু বীজ রোপণের জন্য ৫৫ হাজার টাকা ও আলু উত্তোলনের জন্য ৪৫ হাজার টাকার দুইটি ইউনিট কিনে বসালে একটি টিলারে তিনটি কাজ করবে। পাওয়ার টিলারকে বহুমুখীকরণের কাজ করছে চুয়াডাঙ্গার একটি প্রতিষ্ঠান। শীঘ্রই তা দেশের বিভিন্ন স্থানে চালু করা হবে। এছাড়া ও বহুমূখী পাওয়ার টিলার দেশের প্রতিটি স্থানে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছে এই প্রকল্প।
×