ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনোনয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রার্থীরা ॥ অপেক্ষার শেষ কখন ?

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

মনোনয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রার্থীরা ॥  অপেক্ষার শেষ কখন ?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা পর্ব শেষ। প্রার্থীদের সাক্ষাতকারের আনুষ্ঠানিকতাও শেষ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এখন বিভিন্ন দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীসহ সমর্থকদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। প্রতীক্ষা। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সময় যত যাচ্ছে বাড়ছে টেনশন। শঙ্কা। গলা শুকাচ্ছে বারবার। বাতাসে ভাসা গুজব মাঝে মাঝে শক্ত নাড়া দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোন খবরই নিশ্চিত নয়। দরকার আসল খবরের। অর্থাৎ সবুজ সঙ্কেত। আরও স্পষ্ট করে বললে, মনোনয়নের চূড়ান্ত খবর। এই বার্তার জন্য সবাই তাকিয়ে আছেন কেন্দ্রের দিকে। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ২৮ নবেম্বর। অর্থাৎ হাতে সময় মাত্র তিনদিন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সোমবারের মধ্যে মহাজোটের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হতে পারে। প্রাথমিকভাবে প্রার্থীদের মোবাইলে এসএমএস যাবে। তারপর চূড়ান্তভাবে দেয়া হবে চিঠি। আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী তালিকার খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। আজকের মধ্যে তা পাঠানো হবে তারেক রহমানের কাছে। তিনি চূড়ান্ত করে গ্রীন সিগন্যাল দেয়ার পর দলের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ করা হবে। এতে সময় লাগতে পারে আরও অন্তত দুদিন। শনিবার রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভিড় লেগেই আছে। দেশের তিনটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয় ধানমন্ডি এলাকায়। গুলশান-২ এ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় ও বনানীতে রয়েছে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকেই দু’ভাগে বিভক্ত। একটি পক্ষ ধানমন্ডি ৩/এ কার্যালয়ের সমানে। অনেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনেও যাচ্ছেন তদবিরের জন্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থী জানিয়েছেন, কোন আসনে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না এলেও নেতাদের কাছে এ বিষয়ে তথ্য রয়েছে। তাই যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন এই ভাবনা থেকে তারা শেষ মুহূর্তের তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার জন্য আরজি জানাচ্ছেন দল প্রধানের কাছে। ধর্ণা দিচ্ছেন ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেও। যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি। কেউ আশ্বাস পাচ্ছেন। কেউবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফের বাড়ি ফিরছেন। জোর লবিংয়ের কারণে কয়েকটি আসনে গত দুই দিনে প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা গেছে। মনোনয়নের টিকেট চূড়ান্ত করতে অনেক প্রার্থী ঢাকায় এসেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকজন গুজবে জেনেছেন প্রার্থী হিসেবে তার নাম চূড়ান্ত। খুশি আর খুশি। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তাই নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে ফিরেছেন এলাকায়। সেখানে বাদ্য-বাজনা নিয়ে আনন্দ মিছিল। হাঠাৎ বিপত্তি। খবর গেল পেয়েছেন আরেকজন। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। দিশেহারা সেই প্রার্থী ফের ঢাকায় আসেন। সোনার হরিণ টিকেটের খবর নিশ্চিত করতে যাচ্ছেন নেতাদের বাসায় বাসায়। আবার মহাজোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে আছে সমালোচনাও। জানা গেছে, সাতক্ষীরা-৪ আসনে ক্লিন ইমেজধারী বর্তমান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জগলুল হায়দার এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না। এই আসনে যুক্তফ্রন্ট থেকে বিকল্পধারার প্রার্থী দেয়া হচ্ছে। যিনি নৌকার হয়ে নির্বাচন করবেন। এ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। তারা চান বর্তমান সাংসদকে মনোনয়ন দেয়া না হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অন্য কোন প্রার্থীকে দেয়া হোক। এছাড়া গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে নেত্রকোনা-২ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে মনোনয়ন দেয়ার খবর রটেছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হলেও নেত্রকোনা সদরের রাজনীতি ও মাটি মানুষের সঙ্গে তার তেমন একটা সম্পর্ক নেই। আহমদ হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা নিয়ে-৫ আসনে। যেখানে বর্তমান এমপি রয়েছেন, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। তাছাড়া সদরের এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে ২৪ জন মনোনয়ন কিনেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেতারা জানিয়েছেন, সদর থেকে আহমদ হোসেনকে মনোনয়ন দেয়া হলে আসনটি হাতছাড়া হতে পারে আওয়ামী লীগের। তাই সদরে যারা জরিপে এগিয়ে আছেন তাদের মধ্যে মনোনয়ন দেয়ার দাবি সকলের। নেত্রকোনা-১ আসন অর্থাৎ দুর্গাপুর এলাকায় মানু মজুমদারকে মনোনয়ন দেয়া হলে আসনটি হারানোর কথা বলছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ময়মনসিংহ-৪ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। জেলায় জাতীয় পার্টির অবস্থান খুবই নাজুক। একেবারেই বেহাল বলছেন নিজ দলের নেতাকর্মীরাই। গত দুই বারের নির্বাচনে এই আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন রওশন। তাই এবারে স্থানীয় নেতাদের দাবি ছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হোক। তাহলে বিজয় হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি কমে আসবে। ময়মনসিংহ-১ আসনে বর্তমান এমপি জুয়েল আরেং মনোনয়ন পাবেন এমন খবরের আশা নিয়ে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে আছেন অনেক নেতাকর্মী। তারা প্রত্যেকেই সকাল-বিকেল এখানে আসেন। অনুপ হাদিমা জানান, আমাদের অপেক্ষা প্রহর শেষ হচ্ছে না। আশায় আছি। আমাদের নেতা মনোনয়ন পাবেন। তারপর চিঠি নিয়ে এলাকায় গিয়ে দলের পক্ষে কাজ করব। সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত প্রমোদ মানকিনের পুত্র জুয়েল আরেং। প্রমোদ মানকিনের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে বিজয়ী হন জুয়েল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মনোনয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি। যা রটেছে তা মিডিয়ার কারণে। অর্থাৎ মিডিয়া মনোনয়ন দিয়েছে, আওয়ামী লীগ দেয়নি। তিনি বলেন, আগামী এক থেকে দুই দিনের মধ্যে মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীরা এক হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করবেন তাই প্রত্যাশা। তফসিল ঘোষণার পর টানা চারদিন মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। চার দিনে ৪ হাজার ২৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি ফরমের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার দিনে ১২ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মোট ২ হাজার ৬০৮ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। এদিকে বিএনপি থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে। নেতারা প্রতিদিন ধর্ণা দিচ্ছেন খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে। যাচ্ছেন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছেও। আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সহযোগিতা চাইছেন কেউ কেউ। এর কারণ হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জানিয়েছেন, এবার জোটের পরিধি বাড়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে অনেকেই মনোনয়ন বঞ্চিত হতে পারেন। তবে কবে নাগাদ বিএনপির মনোনয়ন চূড়ান্ত ও ঘোষণা এখন পর্যন্ত বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি। আজকের মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে তালিকা যাবে লন্ডনে তারেক রহমানের টেবিলে। তিনি চূড়ান্ত করার পর প্রার্থীদের সবুজ সঙ্কেত দেয়া হবে। সঙ্কেত পাবেন জোটের শরিক নেতারাও। জানা গেছে, বিএনপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার পর আজ রবিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে দলটি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রাত্যাশী ৪ হাজার ৫৮০ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিল। তবে গত ১৮ থেকে ২১ নবেম্বর প্রার্থী হতে আগ্রহী আড়াই হাজারের মতো মনোনয়ন প্রত্যাশী সাক্ষাতকার দিয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২৮ নবেম্বর। প্রার্থিতা যাচাই-বাছাই ২ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে জাতীয় পার্টি এবারের নির্বাচনেও একটি বড় ফ্যাক্টর। দফায় দফায় দলটির সঙ্গে বৈঠক করছে মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ। মূলত আসন বণ্টন নিয়ে এই বৈঠক। শুক্রবার রাতে এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগেও জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। শনিবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ৭০ আসন দাবি করা হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল মহাজোটের শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৭০ আসন ছাড় দেয়া হবে। এতে জাপাসহ ১৪ দলের শরিক যুক্তফ্রন্ট, নাজমুল হুদার জোট, ইসলামিক ঐক্যজোট ও ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্স রয়েছে। জানা গেছে, জাতীয় পার্টিকে সর্বোচ্চ ৪০ আসন ছাড় দেয়া হতে পারে। এছাড়া বাকি ৩০ আসন অন্য শরিকদের মধ্যে বণ্টন হবে। জাপা প্রার্থীরাও মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বেশ তৎপর। তারা বারবার যাচ্ছেন এরশাদসহ রওশন এরশাদের কাছে। কখনও বনানী কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে মানুষের জটলা। আর এরশাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তার শরিক ৫৮ দলের নেতারাও। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আর কোন সংসদ নির্বাচনে দুই মার্কার ভিত্তিতে এতটা বিভক্তি দেখা যায়নি। নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক তুলে রেখে বড় দলের পতাকাতলে শামিল হওয়া এমন ঢালাও নজিরও আর নেই। অর্থাৎ জোটের পরিধি বাড়া ও জোট নির্ভর রাজনীতির চর্চার কারণে এই পরিস্থিতি। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অভিন্ন প্রতীক ব্যবহারের যে সুযোগ আইনে রয়েছে, তা কাজে লাগাতে ১৫ নবেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে আবেদন করার সুযোগ ছিল। সেসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে নির্বাচন কমিশন যে তালিকা দিয়েছে, তাতে দেশের ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২২টিই নির্বাচন করতে চায় নৌকা অথবা শীষ প্রতীক নিয়ে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের ১১টি দল ‘নৌকা’ প্রতীক এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ১১টি দল ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানিয়েছে। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হলেও নিজেদের প্রতীক লাঙ্গল নিয়েই ভোট করবে। অভিন্ন প্রতীক ব্যবহারের সুযোগে তাদের এই প্রতীক চেয়েছে আরও দুটি দল। বাকি ১৪টি নিবন্ধিত দল নিজেদের প্রতীকেই ভরসা রাখছে।
×