ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একান্ত সাক্ষাতকারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

জনহিতে নিবেদিত সরকারই আওয়ামী লীগের সাফল্যের মূলে

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

  জনহিতে  নিবেদিত  সরকারই আওয়ামী  লীগের সাফল্যের মূলে

সাক্ষাতকার গ্রহণ : স্বদেশ রায় ॥ দশ বছরে দেশের অর্থনীতির শুধু অবকাঠামো নয়, গুণগত পরিবর্তন এসেছে। একটি শিল্প বান্ধবের পাশাপাশি দেশে বাস্তবায়ন হয়েছে সমাজকল্যাণমূলক অর্থনীতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যার হাত ধরে বিকাশ ঘটেছে, কল্যাণ এসেছে তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই দশ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে জনকণ্ঠ তার সাক্ষাতকার ছেপেছে। দশ বছরের শেষ প্রান্তে এসে এবারও নেয়া হয়েছে তার সাক্ষাতকার। যেখানে তুলে ধরেছেন যে অর্থনীতি তিনি রেখে যাচ্ছেন তার মূল লিটারেচার। যার ভেতর দিয়ে বোঝা যাবে দেশের অর্থনীতির পরিবর্তিত ও বিকশিত রূপটি। প্রশ্ন : আপনি যে অর্থনীতিটা রেখে যাচ্ছেন, সংক্ষেপে তার আকারটি বলবেন? উত্তর : আমার সবসময় মনে হতো, বিশেষ করে আফ্রিকায় গেলে পরে মনে হতো আমাদের জিডিপি’র হিসাব অনেক কনজারভেটিভ। আফ্রিকার অনেক দেশ যাদের মাথা পিছু আয় তখন আমাদের থেকে বেশি দেখা যেত, সেগুলো বাস্তবে আমাদের থেকে অনেক গরিব দেশ। হতে পারে আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোÑ আফ্রিকার অনেক দেশের থেকে বেশি অগ্রসরও ছিল। তার ফলে তারা যে পরিসংখ্যান দিত সেটা যথাযথ ও আফ্রিকার দেশের তুলনায় তখন অনেক কম হতো। এছাড়াও আমি নিজে দেখেছি আমাদের দেশে যে দারিদ্র্য ছিল তা বস্তুত আফ্রিকার থেকে কম ছিল। আমি আফ্রিকার অনেক জায়গায় যখন খেতে বসেছি তখন দেখেছি একটা বড় পাত্রে অনেক রান্না হতো। এবং সেখানকার প্রচুর লোক এই পাত্র থেকে খাবার নিত। অর্থাৎ ওখানকার ক্ষুধার্তের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আমার তাতে মনে হলো যে, আমাদের দেশে আমরা মানিটাইজড ইকোনমিকে বেশি প্রাধান্য দেই। এবং মানিটাইজড ইকোনমিক হিসাবে বেশি মনে করি। আমাদের দেশে যে সাবটিটাইজিং ইকোনমি ছিল, তা আমাদের পরিসংখ্যানে প্রাধান্য পেত না। এই বিষয়টি নিয়ে আমি প্রায় চিন্তা করতাম। বিশেষ করে সত্তর এবং আশির দশকে। যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন সুখকর ছিল না। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন আসতে শুরু করে আশির দশকের শেষ প্রান্তে। কাকতালীয়ভাবে বলা যেতে পারে যে, সামরিক শাসনের অবসানের পরে আমাদের দেশের উন্নয়নের ধারা ব্যাপকভাবে বদলে যায়। আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে দুর্ভাগ্যবশত প্রথম পাঁচ বছর বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও অশিক্ষিত। তা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির উর্ধগতি সেই সময়ে সূচিত হয়। নব্বইয়ের দশকে শেষ চার বছর এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল এবং তখনই বাংলাদেশের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের সাফল্যের মূল কারণ ছিল ওই সরকারটি একান্তভাবে জনহিতে নিবেদিত ছিল। চুরিচামারি অর্থাৎ দুর্নীতি যে হয়নি তা বলব না- তবে সেখানে জনকল্যাণ সবসময়ই বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখনই এ দেশের হাল ধরেন এবং বর্তমানেও তিনি হাল ধরে আছেন। ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা অবশ্য ২০১০ সাল বা তাঁর পরবর্তী সময়ের শেখ হাসিনার সমমানের ছিলেন না। তাঁর পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব ও পরবর্তী সাত বছরের বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব তাঁকে অনেক পাকাপোক্ত করে তোলে। এই দেশের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা তাঁকে অনেক উচ্চমার্গীয় করে তোলে। বর্তমানে এই উচ্চমার্গ অনেক অনেক অনেক উর্ধে। বলা যেতে পারে পূর্বতন যে মালভূমিতে দেশটি অবস্থান করত, এখন তার থেকে অনেক অনেক উঁচু মালভূমিতে দেশটি অবস্থিত। আরেকটি বিষয়ের দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গত দশ বছরের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা, উপর্যুপরি দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়া দেশের জন্য ব্যাপক অর্জন নিয়ে এসেছে। আমরা যেমন অনেক কার্যক্রম শুরু করেছি এবং সেটা শেষ করতেও সফল হয়েছি। এ রকম কার্যক্রমের ফল খ-িত কার্যক্রম ও বাধাপ্রাপ্ত কার্যক্রম থেকে অনেক উত্তম হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি বিষয়ের দিকে নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরী। তাঁর জনকল্যাণে নিবেদন, জনকল্যাণ যখন প্রাধান্য পায় তখন দুর্নীতি যা কিছু হোক না কেন, মানুষের জন্য যে জীবনটি গড়ে ওঠে, সেটা হয় অনেক উন্নতমানের। একই সঙ্গে আমি আরেকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবÑ আর সেখানেই আমার প্রারম্ভিক বক্তব্য শেষ হবে। এই বিষয়টি হলো উন্নয়নের ছোঁয়া দেশের সর্বত্র পৌঁছে দেয়া। যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম যে সুবিধা পায়, মহানগর না হোক অন্তত ছোটখাটো শহর প্রায় সমান সুযোগই পায়। আমাদের সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের দেশ একটি একীভূত অঞ্চল হয়ে গেছে। সেটা হয়েছে শুধু একটি কারণে নয়, যে একটি কারণের কথা বলছি সেটি হলো মোবাইল ফোনের রাজত্ব। ১৬৫ মিলিয়ন মানুষের হাতে আছে ১৩০ মিলিয়নের মতো মোবাইল ফোন। এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারও আছে প্রায় ষাট শতাংশ ফোনের। এই দুটি মাধ্যম অবশ্যই অর্থনীতির একীভূতকরণ সহজ করে দিয়েছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জের একটি আমবাগানের লোক ভাল করে জানে তার আমটি কী দামে ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে উৎপাদক সে কৃষিশিল্প অথবা সেবার, যারাই হোক না কেন, সে মোটামুটি তার ফসল বা জ্ঞানের বাজারমূল্য কি তা সহজে জানে। এই যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমি কথা বললাম তা দেশব্যাপী উন্নয়ন উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করতে পারি আমাদের এলজিডির কল্যাণে এখন প্রত্যন্ত এলাকা আর বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি জেলায় যে সড়ক সংযোগ আছে সেটা সারা দেশকে আবৃত করে। সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে এই একীভূত অগ্রগতি ব্যাপকভাবে কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে দারিদ্র্য রয়েছে সেখানে দরিদ্র লোকটির অনুপাত ২০ ভাগের একভাগ। যদিও তাতে দরিদ্রের সংখ্যা বেশ বড়। দরিদ্রের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির মতো হয়ে যায়। এখানে আমার প্রাথমিক বক্তব্য শেষ হয়ে গেল। এখন মূল প্রশ্নে আসি- এখন কী অবস্থায় আছে। প্রথমে বর্তমান অবস্থার একটা খতিয়ান দিয়ে শুরু করি- মোদ্দা কথাটা হচ্ছে যে, এখন দেশে দরিদ্রদের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। দেশের বাজারটি এ মুহূর্তে বেশ বড়। যেখানে প্রায় ষাট শতাংশ লোক স্বাচ্ছন্দ্যে অংশগ্রহণ করছে। এরা সহজে বাজারটাকে অনবরত বাড়াতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছে গেলে বাজার সম্প্রসারণ কমে যায়। এবং তার কারণটাও আমরা জানি। তার কারণ হলো, এমন অবস্থায় পৌঁছে গেলে দারিদ্র্য দূরীকরণে আর সবিশেষ নজর দেয়া হয় না। এরকম একটি দেশের কথা চিন্তা করলে সহজে মেক্সিকোর কথা মনে পড়ে। মেক্সিকোর বিপ্লব সে দেশের ত্রিশ শতাংশ লোক জানে না। তাদের কথা সে দেশ এক হিসেবে ভুলে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যেটা আমরা করতে চেষ্টা করেছি- আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রাকে আমরা একটি বিষয়ে নিবদ্ধ করি- সেটা দারিদ্র্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য প্রশমন নয়। অন্ততপক্ষে আমি এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। এবং সেজন্য যাকে কৃতিত্ব দিতে হবে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ তিনি সবসময় জনকল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। আপনারা জানেন কিবরিয়া সাহেব যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, সে সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সমাজকল্যাণের জন্য কিছু কাজ শুরু করেন। খুব বড় কিছু নয়, যৎসামান্য। তবে অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ। তাদের সরকার প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্ক ভাতা, অন্তঃসত্ত্বা মাতৃভাতা, শিশুসন্তান ভাতা- এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করে। ভাতার পরিমাণ সামান্য ছিল কিন্তু উদ্যোগ ছিল মহৎ। উদ্দেশ্য ছিল যে, বঞ্চিত, অবহেলিত গরিব লোকজন যেন বুঝতে পারে সরকার তাদের কথাও মনে রাখে। আমাকে প্রধানমন্ত্রী প্রায় বলতেন, আপনি ভাতা বাড়ানোর দিকে তত আগ্রহী হবেন না- ভাতা যারা পায় তাদের সংখ্যা বেশি করে বাড়ান। দু’বছর আগে আমরা একটি সমাজকল্যাণ নীতিমালা গ্রহণ করেছি। সেখানে আমরা বলেছি যে, সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকজনকে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেজন্য সমাজকল্যাণ খাতে বাজেট বরাদ্দ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের মোট বাজেট অত্যন্ত ছোট আকারের। আমাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ১৭-১৮ শতাংশ- এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ হলো ঘাটতি আর দশ-বারো শতাংশ হলো জাতীয় সঞ্চয়। জাতীয় সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে একটি নিকৃষ্ট জাতি। আমাদের চেয়ে কম ধনী অনেক দেশে জাতীয় সঞ্চয়ের হার অনেক বেশি। তার মানে হচ্ছে, আমরা সঞ্চয়ে আগ্রহী নই। একটি উন্নত দেশ হলে বলতে পারতাম আমরা একটি বিশেষভাবে কনজুমার সোসাইটি, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির প্রভাবটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মোটেই শুভ নয়। আমাদের বাজেট বেশি বাড়ানো যায় না। তার কারণ হলো আমাদের সঞ্চয় অত্যন্ত কম। এর ফলে আমাদের সরকার যে সমস্ত সেবা লোকজনকে দিতে পারে, সেখানেও তত উদার হতে পারে না। আমি আমার গত দশ বছরে বাজেটের আয়তন বাড়াতে খুবই সচেষ্ট ছিলাম- কিন্তু জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসাবে তাতে তেমন সক্ষম হইনি। আমি চেয়েছিলাম জাতীয় সঞ্চয়ের হারটি দশ শতাংশ থেকে ১৪-১৫ শতাংশে নিয়ে যাব। আমার মনে হয়, অর্জন হয়েছে সেই তুলনায় খুব কম। হয়ত দুই-আড়াই শতাংশ। এই সমীকরণটিকে পরিবর্তন করা হবে ভবিষ্যতের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তবে আমার বাজেটে আমি গ্রামগুলোকে অনেক সামনে নিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় এখন সড়ক পথে যাওয়া যায়। এবং আমাদের গ্রামের অবস্থা, ছোটখাটো শহর বিশেষ করে উপজেলা শহর অথবা পৌরসভা শহর সেগুলো থেকে ভিন্ন হলেও খুব বেশি ভিন্ন নয়। এই উদ্যোগটা আগামীতেও বহাল রাখতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হবে গ্রামের নগরায়ন অর্থাৎ নাগরিক সুবিধা গ্রামেও পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের যে জনসংখ্যার ঘনত্ব আছে সেটা এক্ষেত্রে সহায়ক। দেশে তত পরিকল্পনা করে গ্রোথ সেন্টার বানাতে হয় না। আপনা আপনি অনেক হাটবাজার শহরের মতো হয়ে ওঠে, সেখানে নাগরিক সুবিধা গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াটিকে আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এক্ষেত্রে আমরা সুইজারল্যান্ডের কথা চিন্তা করতে পারি। সুইজারল্যান্ডে গ্রাম এবং শহরের সুযোগ-সুবিধার দৃষ্টিকোণ থেকে খুব পার্থক্য দেখি না। আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থাটি আমরা করতে সচেষ্ট থাকতে পারি। আমার উন্নয়ন কৌশলে আমি গত দশ বছর চেষ্টা করেছি- অভ্যন্তরীণ যে অর্থনৈতিক চাহিদা আছে সেটাকে অনবরত বৃদ্ধি করতে। রফতানি বৃদ্ধির কৌশল আমরা অনেকদিন যাবৎ চেষ্টা করছি। আমি তার সঙ্গে যোগ করি আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারটিকেও বর্ধিত করার জন্য। আর আমাদের মৌলিক যে লক্ষ্যমাত্রা তাতেই সেটা করা সম্ভব হবে। আমি যদি একটি এলাকার দুই শতাংশ লোককে দারিদ্র্যসীমা থেকে ওপরে ওঠাতে পারি তা হলে তো সেই এলাকার অর্থনৈতিক চাহিদা বেড়ে যাবে। এই সময়ের কিছু সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদা সৃষ্টিতে মূল্যবান অবদান রেখেছি। শুধু রফতানির চাহিদাই, সেটা পুরোপুরি বৃদ্ধি করেনি। আমরা গত দশ বছরে আরেকটি বিষয়ে নজর দিয়েছিÑ আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখলাম আমাদের কৃতিত্বের একটি এলাকা হলো বিভিন্ন পণ্যে ভ্যালু এডিশন। আমরা যেমন সু হাবস আমদানি করে নিয়ে আসি সেগুলোকে জুতো বানিয়ে রফতানি করি। এ রকম আরও অনেক পণ্য আছে যেগুলো অর্ধনির্মিত অবস্থায় নিয়ে আসি এবং সেটা ফিনিশড গুডসে পরিণত করি। এক সময়ে আমরা এটা পোশাক শিল্পে খুবই ব্যবহার করেছি। আমরা বিদেশ থেকে কাপড়, সুতা, বোতাম এনে সেটাকে যুক্ত করে পরিপূর্ণ পণ্যতে পরিণত করি। এর ফলে এখন এই খাতে কী হয়েছে সেটা একটু অনুধাবন করুন; এখন আমরা এই খাতে শুধু তুলা আর ম্যান মেড স্ট্যাপল আমদানি করি। বাকি সবকিছু আমরা দেশে উৎপাদন করি। কাপড়, বোতাম, সুতা সবই আমরা উৎপাদন করি। শুধু যে সেলাই করি তা নয়। আমরা বলতে পারি যে, উৎপাদনের ভূমন্ডলায়ন আমাদের খুবই সাহায্য করেছে। অর্থাৎ গ্লোবালাইজেশন আমাদের জন্য একটি আশীর্বাদ। গ্লোবালাইজেশনের মজাটা হলো ডিভিশন অব লেবার। জার্মানির একটি গাড়ি উৎপাদিত হচ্ছে, যে গাড়িটিতে হাজার রকম পার্টস আছে। কোথা থেকে কোন্ পার্টস আসছে তা একমাত্র উৎপাদকই বলতে পারেন, যারা গাড়ি ব্যবহার করেন তারা জানেন না। সেই গাড়িতে আমাদের পাট যে কোথায় ব্যবহার হচ্ছে বা আমাদের রেক্সিন বা চামড়া কোথায় ব্যবহার হচ্ছে সেই খবর বেশিরভাগ মানুষই জানে না। আমাদের সম্পদ আছে-শুধু মাটি ও মানুষ। এবং বঙ্গবন্ধু এটা নিয়ে সব সময় গর্ববোধ করতেন। মাটিতে যত ধরনের ফসল হতে পারে- আমরা সব ধরনের ফসল উৎপাদন করি। সেটা শস্য তো আছেই- কিন্তু তার সঙ্গে আছে ফল-মূল, সবজি ইত্যাদি। আর আমাদের মানুষ তারা বিশ্ব উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটুআধটু অবদান রেখে নানা পণ্যের দামকে অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাকে একটা বিক্রিযোগ্য পরিপূর্ণ পণ্যে পরিণত করছে। সমাজের মানুষ তত লেখাপড়া জানে না- সেটা আমাদের দুর্বলতা। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, তাদের বুদ্ধি অতি উচ্চমানের। একবার যদি তাকে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে কীভাবে একটা উৎপাদনযজ্ঞ পরিচালনা করা যায়, সেটা সে সহজে আয়ত্ত করে নেয়। এই দশ বছরে আমি দেখেছি যে গ্রামে কীভাবে অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত লোক নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে। ধানের ক্ষেত থেকে কী করে আগাছা নির্মূল করতে হয়, কীভাবে সার প্রদান করতে হয়, কীভাবে পানি সেচ দিতে হয় -সেই সব বিষয়ে একেবারে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে আমাদের কত চাষী, খামারি ও অতি সাধারণ লোকজন। তাই আমাদের দেশে সত্যিকারভাবে মাটি এবং মানুষ আমাদের সম্পদ। এখানে আমার বলা প্রয়োজন যে, সবক্ষেত্রে, সব দেশেই মানুষের যে স্বাভাবিক বুদ্ধি সেটা এমন পর্যায়ে বিকাশ হচ্ছে যে, এখন সময় হয়েছে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। যাকে বলা যেতে পারে তাদের মধ্যে স্কিলড ফরমেশনে পরিবর্তন হচ্ছে। ২০১১ সালে আমরা সরকারে বসেছি। সেই সময়ে আমার অর্থ সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক আমাকে জানালেন যে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে চায়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো স্কিল ফরমেশন। আমরা সেই প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা করলাম। শেষ প্রশ্ন হলো, এই প্রকল্পটাকে বাস্তবায়নের জন্য কার হাতে দিতে হবে। আমি তাকে বললাম, এটা তো লেবার ও প্রযুক্তি যারা বিবেচনা করে, তাদের হাতে দেয়া দরকার। তিনি বললেন, এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ে রাখতে হবে। অন্যত্র তত কার্যকর হবে না। প্রশ্ন : এটা বর্তমান অর্থনীতির একটি লিটারেচার যা আপনি বললেন। এখন কি বর্তমান অর্থনীতির পরিসংখ্যাগত আকারটি বলবেন? প্রথমেই বলতে পারি এখন এটা প্রায় ২৪০০,০০০ (চব্বিশ লাখ) কোটি টাকার গ্রোস ডমেস্টিক প্রডাক্ট (জাতীয় সম্পদ) বাজেটের আকার=৬ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা রফতানি- ৩৬ লাখ ৯০ হাজার ৭২ কোটি টাকা আমদানি- ৪৮ লাখ ৩২ হাজার ৮২ কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী- ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সম্পদ (বিদেশী সাহায্য)- ৫৪০০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি- ৭১০০০ কোটি টাকা প্রশ্ন : অর্থনীতির এই আকারে আসার পেছনে প্রথম থেকে কী কী মৌলিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন? উত্তর : আমার প্রথম উদ্যোগ ছিল বাজেটের আকার বাড়ানো যাতে সেবা বেশি দিতে পারব। প্রশ্ন : সঞ্চয়ের দিক থেকে নিকৃষ্ট?- এখন ব্যাংকে ডিপোজিট সুদের হার কম। সঞ্চয় বাড়ার ক্ষেত্রে এটি কি প্রতিবন্ধকতা নয়? উত্তর : না- এটা ইনফ্লেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সঞ্চয় প্রবৃদ্ধি কম, তার কারণ আমরা কনজুমারিস্ট-আমরা সঞ্চয়ী নই। এটা হ্যাবিটের বিষয়। আমাদের অভ্যাসের ভেতর সঞ্চয়ী হবার অভ্যাস কম। আমাদের ধনীরা ট্যাক্স দিতে রাজি হয় না। প্রশ্ন : এই অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে কি সরকারের ধারাবাহিকতা দরকার? উত্তর : মোস্ট ইমপোর্টেন্ট- এবং বর্তমান পলিসির কন্টিনিউয়েশন রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে এটা হয়ে যাবে। অন্যথায় বাধাগ্রস্ত হবে। প্রশ্ন : আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে? উত্তর : আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে। এবং তখন এটা এমন একটা ভিত্তি পাবে, যা আর নষ্ট করা সম্ভব হবে না।
×