ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অদম্য ইচ্ছায় প্রতিবন্ধিতা জয়

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 অদম্য ইচ্ছায় প্রতিবন্ধিতা জয়

সমাজের প্রচলিত ধারণায় প্রতিবন্ধী মানুষ মানেই বোঝা, দয়ার পাত্র। কিন্তু এমন নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিয়েছে উত্তরের নীলফামারীর প্রতিবন্ধী মানুষগুলো। অদম্য ইচ্ছায় প্রতিবন্ধিতার সকল বাধা উপেক্ষা করে তারা সক্ষম হয়েছেন কৃষি, মৎস্য ও বিভিন্ন কঠিন কাজে নিয়োজিত থেকে। গ্রামীণ জনপদের এসব মানুষ এখন দেখছেন বড় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন। তাই কৃষিসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা অবদান রাখছে। অবিশ্বাসও হলেও এটি এখন বাস্তবতা।সেই অবিশ্বাস্যকে জয় করছে। তারা কৃষিনির্ভর বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে নিজের এবং পরিবারের সহায়ক হয়ে উঠেছে। এতে করে তারা সমাজের সকল নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। প্রতিবন্ধীতাকে জয় করে মেধা ও শ্রম দিয়ে কৃষি জমিতে ফসল ফলিয়ে অর্জন করেছেন সুনাম। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে জেলার সদর উপজেলার পলাশবাড়ী গ্রামের নরেশ চন্দ্র রায় (৫০) একজন। জন্ম থেকেই তার দুই পা ছোট। নিজে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে না পারলেও কারও কাঁধে বোঝা হয়ে বেঁচে নেই তিনি। নিজ হাতে বিভিন্ন ফসল ফলাচ্ছেন জমিতে। ওই কৃষির আয়ে ফিরিয়ে এনেছেন সংসারের স্বচ্ছলতা। তিনি বলেন, আমরা অবহেলিত পরিবার এবং সমাজে। সকলেই আমাদের অক্ষমতাকেই দেখেন বড় করে। সেই অক্ষমতার সকল বাধা জয় করে আমি নিজেকে জড়িয়েছি কৃষিকাজে। সেটিতে সফল হওয়ায় আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে সকলের কাছে। সংসারেও স্বচ্ছলতা আনতে পেরেছি। জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম বড়ভিটা গ্রামের এনামুল হকের (৫৫) দুই পা শক্তিহীন। রেশম গুঁটিপোকার সফল চাষি তিনি। পশ্চিম বড়ভিটা গ্রামের খামেদুল ইসলাম (৩৫) পা হারান পাওয়ার টিলার দুর্ঘটনায়। ১৫ বছর আগের সে দুর্ঘটনা দমাতে পারেনি তাকে। তিনি এখন একজন সফল মৎস্য চাষি।জেলা সদরের খলিশাপচা গ্রামের ধলু রাম রায় (৩৮)। ২৭ বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় দুটি পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনি। কিন্তু পঙ্গুত্বের সে বাধা অতিক্রম করে কৃত্রিম পা লাগিয়ে নিজ হাতে করছেন শাক-সবজির চাষ। জেলায় এমন প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা অনেক। কেউ জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী, কেউ প্রতিবন্ধী হয়েছে কোন দুর্ঘটনায় পড়ে। আর কেউ পঙ্গত্ববরণ করেছেন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে। তাদের মধ্যে ডিমলা উপজেলার রফিকুল ইসলাম (৫৫) একজন। কুষ্ট রোগের চিকিৎসা শেষে নিজেকে জড়িয়েছেন কৃষি কাজে। এ ছাড়া এমন অনেকে বিভিন্ন কর্মে নিজেকে জড়িয়েছে। সমাজে এক সময়ে ধারণা ছিল কুষ্ঠ মারাত্মক একটি ব্যাধি। আক্রান্ত রোগীকে পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতো অনেকে। সমাজের মানুষের ধারণা ছিল রোগটি ছোঁয়াছে। কিন্তু সেসব প্রচলিত ধারণা ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। প্রমাণ করেছে কুষ্ঠ ভাল হয় নিয়মিত চিকিৎসায়। তারা পরিবার এবং সমাজে ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু ওই রোগ আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীকে গ্রহণ করতে হয় প্রতিবন্ধিতা। তারাই সমাজে পরিচিত কুষ্ঠ প্রতিবন্ধী হিসেবে। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারানো এসব মানুষ পরিবারে হয়ে পড়ে অবহেলার পাত্র। এবার সেই প্রতিবন্ধিতাকে জয় করেছেন জেলার কুষ্ঠ প্রতিবন্ধীরা। তারা কৃষি, ক্ষুদ্রব্যবসাসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মে। তাদের মধ্যে সৈয়দপুর উপজেলার বাঙালীপুর গ্রামের ইসলাম খান (৫৫) একজন। ১৯৮৪ সালে সালে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় ভাল হয় ১৯৯০ সালে। তিনি বলেন, সমাজের মানুষ আগে ভালভাবে আমাদের গ্রহণ না করলেও ধীরে ধীরে সেটি কেটে যায়। এখন আমি নিজেকে কৃষিরসঙ্গে জড়িয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছি। ওই কৃষিই আমার পরিবারের প্রধান জীবিকা। তারমতো কর্মে ফিরেছেন কিশোরীগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের তাঁতীপাড়া গ্রামের আবু বক্কর (৫০)। সকলকে নিয়ে পরিবারে বসবাস করছেন তিনি। নিজেকে জড়িয়েছেন কৃষির সঙ্গে। বাড়ির ভিটেয় যেটুকু জমি আছে তাতে ফলাচ্ছেন শাকসবজি। ওই উপজেলার একই গ্রামের কুষ্ঠ প্রতিবন্ধী আলেফ উদ্দিন (৪৫) করছেন মৎস্য চাষ। সেটিই এখন তার জীবনের প্রধান জীবিকা। তিনি বলেন, এক সময়ে সমাজের মানুষের কাছে আমারা ছিলাম ঘৃণিত। কেউ মিশতে চাইত না আমাদের সঙ্গে। এখন সে ধারণা কাটিয়ে আমরা ফিরেছি কর্মক্ষেত্রে। জেলায় কুষ্ঠ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে দ্যা লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা, মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিরূপ ধারণা কাটানো এবং সমাজের মূল ধারায় তাদেরকে ফিরিয়ে কর্মক্ষেতে প্রতিষ্ঠত করতে গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগ। দ্যা লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, জেলায় আড়াই হাজারের উপরে কুষ্ঠ প্রতিবন্ধী রয়েছে। বিভিন্ন গ্রামে সমিতি গঠন করে তাদেরকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়েও তাদের সংগঠন আছে। এসব সদস্যের সঞ্চয় এক কোটি টাকার উর্ধে। সঞ্চিত অর্থ তারা নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করছেন। তিনি বলেন, কুষ্ঠ রোগের বিরূপ ধারণা এখন কেটে গেছে। আমরা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে ফেরাতে দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। কৃষিক্ষেত্রেও তারা অনেকে প্রবেশ করছেন। অপরদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম আজাদ বলেন, এখনও পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। তবে ওই চাষিরা প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক হয়, সে ক্ষেত্রে প্রণোদনার আওতায় সংযোগ হতে পারে। আর তাদের যদি জমি থাকে প্রদর্শনী দেওয়ার মাধ্যমেও কৃষি কাজের সঙ্গে আমরা তাদেরকে সম্প্রক্ত করা যেতে পারে। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×