ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেকর্ড গড়ে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 রেকর্ড গড়ে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন

রুমেল খান ॥ জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গোল মিস, গোল, লাথি, ঘুষি, মারামারি, গালাগালি, লালকার্ড, অপর্যাপ্ত পুলিশী নিরাপত্তা, মাঠে বৃষ্টির মতো জলের বোতল নিক্ষেপ, গ্যালারির বেষ্টনি টপকে মাঠে পঙ্গপালের মতো হাজার দর্শকের ঢুকে পড়া... সবমিলিয়ে কোন ঘটনা আর বাদ থাকেনি শুক্রবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওয়ালটন ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে। যাতে ঢাকা আবাহনী লিমিটেড মুখোমুখি হয়েছিল বসুন্ধরা কিংসের। শ্বাসরুদ্ধকর এই ফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে পড়েও অসাধারণ খেলে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয় ‘দ্য স্কাই ব্লু ব্রিগেড’ খ্যাত আবাহনী। তারা জেতে ৩-১ গোলে। খেলার প্রথমার্ধে অবশ্য ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল ‘দ্য কিংস’ খ্যাত বসুন্ধরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে একে একে তিন গোল করে বিজয়ীর হাসি হাসে আকাশী-নীল শিবিরই। সেই সঙ্গে তারা নিশ্চিত করলো এএফসি কাপে খেলার যোগ্যতাও। ফাইনাল শেষে তাদের হাতে ট্রফি তুলে দেন বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী এমপি। চ্যাম্পিয়ন আবাহনী পাঁচ লাখ এবং রানার্সআপ বসুন্ধরা প্রাইজমানি পায় তিন লাখ টাকা করে। ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন আবাহনীর সানডে চিজোবা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনি। ফাইনালসেরা খেলোয়াড় হন আবাহনীর মিডফিল্ডার সোহেল রানা। শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র লাভ করে ফেয়ার প্লে ট্রফি। এ মৌসুমের সবচেয়ে দামী ও শক্তিশালী দল হিসেবে বসুন্ধরা তাদের অভিষেক আসরেই অপরাজিত শিরোপা জিতবে এমনটাই ধারণা করেছিলেন দলটির সমর্থক-অনুরাগীরা। কিন্তু বিশ্বকাপের খেলোয়াড় দলে থাকলেই যে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না, ফাইনালে হেরে সেটাই যেন প্রমাণ করলো বসুন্ধরা। এর আগে কোন নতুন দলই ফেডারেশন কাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই চ্যাম্পিয়ন হয়নি। সেই অসাধ্য সাধন ও বিরল কৃতিত্ব দেখাতে পারলো না বসুন্ধরা। এটা ছিল ফেডারেশন কাপের ৩০তম আসর। আগের ২৯ আসরের মধ্যে আবাহনীই সর্বাধিক ১৭ বার ফাইনাল খেলেছিল (৭ বার রানার্সআপ)। দ্বিতীয় সর্বাধিক ১৪ বার ফাইনাল (৪ বার রানার্সআপ) খেলেছে মোহামেডান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে শিরোপা সংখ্যাকে ১১-তে উন্নীত করলো জাকারিয়া বাবুর শিষ্যরা। আবাহনীর এই কোচের কথা না বললেই নয়, কোচ হিসেবে এটা তার দ্বিতীয় ফাইনাল হলেও শিরোপা জিতলেন এই প্রথমবারের মতো। ২০১১ সালে এই আসরেই টিম বিজেএমসির কোচ ছিলেন। কিন্তু সেবার ফাইনালে শেখ জামাল ধানম-ির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়েছিলেন বাবু। আর এবার স্বপ্ন পূরণের আনন্দে কেঁদে ভাসালেন বুক। ম্যাচ শেষে তার প্রতিক্রিয়া, ‘জানি না কেন কাঁদছি। এই কান্না আমার আনন্দের। বরাবরই বলছি টিমের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে। গোল হজম করলে গোল পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে আমাদের। বিরতির সময় তাদের বলা হয়েছে যে তোমরা নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ ইনশাআল্লাহ এই ম্যাচ আমরা জয়লাভ করব। শেষ পর্যন্ত আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমার দলে আলাদা কোন খেলোয়াড়ের প্রতি নজর ছিল না। ওরা সবাই আমার ট্রাম্পকার্ড। পুরো দলই আমার শক্তি। আমি বলতে চাই দেশীয় কোচদের শিরোপা জেতানোর সামর্থ্য আছে। শিরোপা জেতা আমার দেশীয় কোচের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আল্লাহর রহমতে সেই চ্যালেঞ্জ আমি জিতেছি।’ খেলা শেষে বসুন্ধরার স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজেন বলেন, ‘আমরা জয়ের জন্যই খেলেছি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে রেফারি আবাহনীর পক্ষে বাঁশি বাজিয়েছেন। রেফারির বিরুদ্ধে আমরা বাফুফের কাছে চিঠি দেব। শেষ ২০ মিনিটে আমরা ভাল খেলিনি। ম্যাচটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এখন এই ফাইনালটা ভুলে যেতে চাই। স্বাধীনতা কাপে আমরা দুর্দান্তভাবে ফিরে আসব।’ ২১ মিনিটে আলমগীর কবির রানার শট দৌড়ে এসে ফিস্ট করেন আবাহনীর গোলরক্ষক-অধিনায়ক শহীদুল আলম সোহেল। ফিরতি বলে বাঁ পায়ের গড়ানো শটে সোহেলকে পরাস্ত করে বসুন্ধরাকে লিড এনে দেন রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা কোস্টারিকান ফরোয়ার্ড ড্যানিয়েল কলিন্ড্রেস (১-০)। এ আসরে এটা তার পঞ্চম গোল। দ্বিতীয়ার্ধে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় আবাহনী। ধার বাড়িয়ে দেয় আক্রমণের। ৫০ মিনিটে বাঁপ্রান্ত থেকে রায়হান হাসানের থ্রোতে আফগান ফরোয়ার্ড মাসিহ সাইঘানি হেড করলেও বলের নাগাল পাননি। বলটি ডান পোস্ট ছেড়ে মাঠের বাইরে চলে যাবার আগ মুহূর্তে ডান পায়ের দারুণ শটে ম্যাচে সমতা এনে উল্লাসে ফেটে পড়েন নাইজিরিয়ান ফরোয়ার্ড সানডে চিজোবা (১-১)। এ সময় পূর্ব গ্যালারিতে বসুন্ধরার সমর্থকদের সঙ্গে আবাহনীর সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ৭৯ মিনিটে ডানপ্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে দারুণ এক ক্রস দেন সোহেল রানা। সুযোগ হাতছাড়া করেননি সানডে। দারুণ শটে বল পাঠিয়ে দেন জালে (২-১)। এটা সানডের ষষ্ঠ গোল, টপকে যান বসুন্ধরার কলিনড্রেসকে। স্বপ্নভঙ্গের আভাস হয়তো পেয়ে যান বসুন্ধরার সমর্থকরা। দ্বিতীয় গোল হজমের পরই বসুন্ধরার তিন দিকের গ্যালারি পরিণত হয় ভাঙ্গা হাটে। ৮২ মিনিটে বসুন্ধরার হারের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় আবাহনী। ওয়ালী ফয়সালের কর্নারে ব্যালফোর্টের নিচু হেড সরাসরি আশ্রয় নেয় জালে (৩-১)। ৮৮ মিনিটে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সানডে। কিন্তু তাকে কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করেন ডিফেন্ডার নাসির উদ্দিন চৌধুরী। মারাত্মক আহত হয়ে মাঠের বাইরে যেতে হয় সানডেকে। এবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দু’দলের ফুটবলারদের মধ্যেও। তার পরিবর্তে মাঠে নামানো হয় নাবিব নেওয়াজ জীবনকে। ইনজুরি টাইম দেয়া হয় ৭ মিনিট। সানডেকে তখন এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই মুহূর্তেই বল ছাড়াই সরাসরি জীবনকে লাথি-ঘুষি মারতে থাকেন বসুন্ধরার সুশান্ত ত্রিপুরা। এর আগে অবশ্য জীবনই সুশান্তকে মেরে তাকে উস্কে দেন। তখন আবাহনীর মামুন মিয়া দৌড়ে এসে লাথি মারেন সুশান্তকে। আবাহনীর জীবন, মামুন মিয়া, বসুন্ধরার অধিনায়ক সবুজ, সুশান্ত ত্রিপুরাকে লালকার্ড দেখান রেফারি মিজানুর রহমান। দেশের ফুটবলে এক ম্যাচে চার লালকার্ডÑ এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না তা গবেষণার বিষয়। এদিকে ম্যাচ শেষে জানা যায় সানডের দাঁত কপাটি লেগে গেছে। তিনি নাকি কাউকেই চিনতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলের জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো নিজেদের ঘরে শিরোপাটা ধরে রাখে ঢাকা আবাহনী। এর আগে ১৯৯৭, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে (১৯৯৮ সালে আসর অনুষ্ঠিত হয়নি)। প্রথমবারের মতো হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল আবাহনী। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের ফাইনালে তারা হারিয়েছিল যথাক্রমে আরামবাগ এবং চট্টগ্রাম আবাহনীকে।
×