ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা

রবিবার ১৮ নবেম্বর সারাদেশে শুরু হয়েছে প্রাইমারী সমাপনী পরীক্ষা। শিশুরা প্রথমবার বোর্ড পরীক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার মুখোমুখি হয়। ভয়, শঙ্কা, মানসিক দুর্বলতা সব মিলিয়ে এক অজানা আতঙ্ক ভেতর থেকে কাজ করে। বয়সের স্বল্পতার কারণে পরীক্ষাভীতির আবর্তে পড়ে যাওয়াও কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর্যায়ে আসে না। বাংলাদেশের রক্ষণশীল, ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রাইমারী শিক্ষায় ঝরে পড়ার হারও লক্ষণীয়। এই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল প্রায় ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ১২৩ জনের। প্রথম পরীক্ষা ছিল ইংরেজী। এই দিনই সারাদেশে ১ লাখ ৬০ হাজার পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। শুধু তাই নয়, এসব ছাত্রছাত্রী মূলত পুরো পরীক্ষাই বর্জন করল। পরীক্ষা না দেয়া ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৬৩ হাজার ৮৩২ জন ছাত্র আর ৫৩ হাজার ৮৭১ জন ছাত্রী। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমেছে। একটি পশ্চাৎপদ সমাজে শিশু কন্যাটিকে গড়ে তোলা হয় প্রচলিত কিছু বিধি নিষেধকে অনুসরণ করে। বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপ এখানে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের গতিধারায় সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে প্রবৃদ্ধির বিভিন্ন সূচকে। শিক্ষা-ব্যবস্থায়ও শিশুদের ছিটকে পড়ার ক্ষেত্রে এখন ছেলেরাই কিছুটা এগিয়ে। বৈষম্যহীন সমাজ তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাত্রা নির্দেশিত হলেও ঝরে পড়ার সংখ্যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ছাত্রদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু অনুন্নত কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতিকেই দায়ী করা হতো। যেখানে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা শক্তি না হয়ে বোঝা হয়ে যায়। বাংলাদেশ এখন সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করে যাচ্ছে। যখন মেয়েদের লেখাপড়া থেকে সরিয়ে আনা হতো বিয়ের জন্য তৈরি করতে। আর ছেলেদের নিয়ে আসা হতো কৃষি ফলন জমিকে বাবার সহযোগী কর্মী হিসেবে। সে অবস্থাও বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান নয়। উন্নত প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের সমস্ত সুযোগ এখন গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। তবে প্রথম সমাপনী পরীক্ষায় এমন ঝরে পড়ার কারণ কি? সেখানে বলা হচ্ছে প্রাইমারী এবং জুনিয়র সমাপনী দুটো পরীক্ষা আর নেয়া হবে না। শুধু অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাই প্রথম বোর্ড পরীক্ষার মোকাবেলা করবে। সামনের বছর থেকে হয়ত এই নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি কার্যকর হবে। অল্প বয়সে বোর্ড পরীক্ষা রীতিমতো একটি চাপ যা কোমলমতি শিশুদের জন্য সুফল বয়ে আনে না। তার ওপর এই প্রথমবার পিএসসি পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু রচনামূলক এবং এক কথায় উত্তর এমন প্রশ্ন হাজির করা হয় শিক্ষার্থীদের সামনে। এটাও প্রভাব ফেলতে পারে এতসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষায় অংশ না নেয়ার বিষয়। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে রেখে এই ঝরে পড়ার ব্যাপারটি যৌক্তিকভাবে আলোচিত হচ্ছে। প্রথমত ইংরেজী ভীতি। বিদেশী ভাষার যথার্থ এবং নিয়মানুগ চর্চা এখনও আমাদের দেশে সেভাবে প্রচলিত হয়নি। বিশেষ করে গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। উপযুক্ত, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরও যথেষ্ট ঘাটতি আছে বলে মনে করা যেতে পারে। যথার্থভাবে শিক্ষার পাঠদানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক যদি নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে না পারে তাহলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে ছোট্ট শিশুদের ওপর। যারা একটি মানসম্মত শিক্ষার্জনের ব্যাপারে শিক্ষকদের ওপরই নির্ভরশীল থাকে। বিষয় হিসেবে শুধু ইংরেজী নয় গণিতের ব্যাপারেও ছাত্র-ছাত্রীদের এক রকম অজানা আতঙ্ক কাজ করে। সেখানেও শিক্ষককেই তার যথার্থ দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিতে হয়। এক্ষেত্রেও অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয় অঙ্কের শিক্ষকের মান নিয়ে। সুতরাং শিক্ষা জীবনের শুরুতেই শিশুরা যেন অবাঞ্ছিত কোন জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রমে বিব্রতকর অবস্থার শিকার না হয় সে ব্যাপারে নজরদারির বিশেষ প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান আর সতর্ক হতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। প্রাথমিক ভিত্তি তৈরিতে মাতৃভাষা তো বটেই, ইংরেজী এবং গণিতের যথার্থ চর্চাই শুধু নয় দরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নিয়মিতভাবে করে যেতে হবে। শিক্ষার হার এগিয়ে যাচ্ছে সেটা যেমন সত্য ঝরে পড়ার আশঙ্কাও কমছে না তাও দৃশ্যমান। শিক্ষা কার্যক্রমকে অবারিত এবং সার্বজনীন করার মহৎ উদ্দেশ্যে ঘাটতির বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে নজর দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও শিক্ষার বিকল্প অন্য কিছু নয়।
×