ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাদার অব হিউম্যানিটি পদক

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

মাদার অব হিউম্যানিটি পদক

মানবতা মানুষের জীবনের পরম ধর্ম বলা যায়। মানবিক আচরণ মানুষকে সম্পন্ন মানুষে উন্নীত করার সহায়ক বৈকি। মানবজীবন গড়ে ওঠে মানুষের মাঝেই। মানবসমাজ যূথবদ্ধ সমাজ। পারস্পরিক সহানুভূতি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা নিয়েই মানবজাতির বেড়ে ওঠার মূলমন্ত্র। কিন্তু অনেক মানুষই এসব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অমানবিকতার আবডালে হিংস্রতর হয়ে ওঠে। দানব চরিত্র ধারণ করে মানুষ মানুষকেই নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ করে। বঞ্চনার নিগড়ে বাঁধা পড়া মানুষের জীবনকে করে তোলে বিভীষিকাময়। আদিম হিংস্র অমানবিকতার আড়ালে এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। মানুষ মানুষকে হত্যা করে ধর্মের নামে। বর্ণের নামে, ভাষার নামে। মানুষের হাত রক্তাক্ত হয়ে ওঠে মানুষেরই রক্তে। অমানবিকতা মানুষকে নিজ দেশেই পরবাসী করে তোলে। আবার এই মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড মানুষকে পৈতৃক ভিটেমাটি তথা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। নিপীড়নের মাত্রা এতই তীব্র যে, চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি সম্পদ ছেড়ে মানুষকে পালাতে হয়। নারকীয় বিভীষিকার শিকার হয়ে মানুষ হয় দেশছাড়া, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ দখল করে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নাশকতাসহ সব ধরনের অপরাধ কর্মে জড়িত ছিল। তাদের সহযোগী হিসেবে বাঙালী বংশোদ্ভূত ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও পাকিস্তানী জান্তা শাসকের অনুগতরা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর; আল শামস ইত্যাদি বাহিনী গড়ে তোলে। এই দুই শক্তি মিলে কোটি বাঙালীকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। প্রতিবেশী ভারত তাদের আশ্রয় দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ রসদ ও উপকরণ সহায়তা দেয়। শরণার্থীদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে। কোটি মানুষের এই জীবন ছিল মানবেতর। তথাপি হানাদারের নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন শুধু নয়, খাদ্য, রসদও সরবরাহ করেছিলেন। ধাত্রী হিসেবে তিনি বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধে এসে মানবতার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমারের রাখাইনে সেদেশের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলানো হয়। মিয়ানমারের সেনা, পুলিশ ও বিবিবির নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এর আগে অতীতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতনের মুখে এদেশে এসে আশ্রয় নেয়। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতকে বাংলাদেশ অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এদের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ, খাদ্য সাহায্যও প্রদান করে আসছে। কক্সবাজার অঞ্চলের বন উজাড় করে এরা বসবাস করছে। বিশ্ববাসী এই বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় ও সাহায্য প্রদান করায় বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে আসছেন। এত মানুষের ভার বইবার মতো অবস্থা বাংলাদেশের না থাকলেও শেখ হাসিনা মানবতার খাতিরে মানবিক বোধ থেকে এদের আশ্রয় দিয়েছেন। গত বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘চ্যানেল ফোর’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অভিধায় ভূষিত করে। যা বিশ্বজনের কাছে সমাদৃত হয়েছে যথাযথ উপাধি হিসেবে। এই নামেই সরকার সমাজকল্যাণ পদক চালু করতে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি সমাজকল্যাণে পদক নীতিমালা-২০১৮ অনুমোদিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনাকে যে মাদার অব হিউম্যানিটির স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তারই প্রতিফলন হিসেবে এই পদক চালু করা হচ্ছে। পাঁচটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পাঁচ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পদক প্রদান করা হবে। অন্যান্য জাতীয় পুরস্কারের মতোই এই পুরস্কারের নীতিমালা করা হয়েছে। প্রতিবছর দুই জানুয়ারি সমাজকল্যাণ দিবসে এই পদক দেয়া হবে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের ১৮ ক্যারেট মানের ২৫ গ্রাম সোনার তৈরি একটি পদক, মাদার অব হিউম্যানিটি সমাজকল্যাণ পদকের রেপ্লিকা, দুই লাখ টাকার চেক এবং সম্মাননা সনদ দেয়া হবে। এই পুরস্কার একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকের সমমানের। দেশের নারী সমাজের ও প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রদত্ত এই পুরস্কার দেশের জন্য গৌরবের বৈকি। প্রান্তিক, অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই পদক এক উজ্জ্বল নিদর্শন অবশ্যই। এই সিদ্ধান্ত অভিনন্দন ও প্রশংসাযোগ্য।
×