ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিয়োগ অবৈধ বলে আদেশ দিয়েছে জনপ্রশাসন

বিজেএমসির সেই তিন উপদেষ্টার শেষ রক্ষা হলো না

প্রকাশিত: ০৫:০২, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 বিজেএমসির সেই তিন উপদেষ্টার শেষ রক্ষা হলো না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নানামুখী তদ্বির, অর্থের বিনিময়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সমর্থন আদায় করেও শেষ রক্ষা হলো না পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া সেই বিতর্কিত তিন উপদেষ্টার। বিজেএমসিয়ের প্রভাবশালী চক্রকে ম্যানেজ করে আবার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের সব প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে আদেশ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে পিআরএল থাকা অবস্থায় আইন লঙ্ঘন করে বিজেএমসিতে যোগ দিয়ে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাবাবদ উত্তোলন করা অর্থ সরকারী খাতে ফেরত দিতে হবে। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশের পর সে অনুসারে কাজ শুরু করেছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘পিআরএল ভোগরত একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব), বাবুল চন্দ্র রায়কে (যুগ্ম সচিব) গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪ এর ৫ ধারা মতে দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠান হতে সম্মানী গ্রহণ এবং উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ বৈধ বলে গণ্য করার সুযোগ নেই। কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা হিসেবে কি পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছে তা হিসেব করে আদায়ের পর সরকারী খাতে জমা দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবগত করতে হবে। উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ বৈধ বলে গণ্য করার সুযোগ নেই বিধায় তা বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ তিন কর্মকর্তা অবসরকালীন সরকারী ভাতা গ্রহণ করার পাশাপাশি উপদেষ্টা হিসেবে বিজেএমসি থেকে ভাতা হিসেবে প্রতিমাসে ৮০ হাজার টাকা গ্রহণ করার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে অনুরোধও করা হয়েছিল। এদিকে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে দুুটি সরকারী চাকরিতে থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা শেষ পর্যন্ত সুরাহা হচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পাট ব্যবসায়ী, দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বোচ্চার মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির কর্মকর্তারা। তারা বিজেএমসির এ অনিয়মের বিরুদ্ধে দৈনিক জনকণ্ঠের অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, আজ যে অবস্থান সরকার নিতে পারছে তা কেবল জনকণ্ঠের অব্যাহত প্রতিবেদনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এর আগে ‘বিজেএমসির সেই উপদেষ্টাদের নিয়ে আবার পাঁয়তারা’ শিরোনোমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিজেএমসিতে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া সেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের এবার একই পথে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে পরিচালক পদে বসানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। পিআরএলে থাকা অবস্থায় উপদেষ্টা হওয়ার ঘটনা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে ঠিক তখনই তিন কর্মকর্তার মধ্যে একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলামকে (যুগ্ম সচিব) পরিচালক পদে দু’বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফাইল তোলা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায়ে বিতর্কিত সব তথ্য এড়িয়ে দুই কর্মকর্তার গুণগান গেয়ে বলা হয়েছে ‘তাদের সততা, সুনাম ও দক্ষতার জন্য বিজেএমসিতে তাদের অত্যন্ত প্রয়োজন।’ দেশজুড়ে পাট ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মকর্তার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেও পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিজেএমসির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আশীর্বাদেই এমন ঘটনা বলে বলছেন ব্যবসায়ীরা। পাট ব্যবসায়ী ছাড়াও জনপ্রশান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নতুন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, যেখানে অবৈধভাবে উপদেষ্টা হওয়া কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাবাবদ উত্তোলন করা অর্থের হিসেব চেয়েছে আগেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেখানে নতুন করে পরিচালক করার চেষ্টা বড় ধরনের দুর্নীতি। এ ঘটনার পেছনে কারা আছেন তাদের খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও পাট ও বস্ত্র মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আগের এক আদেশে বলা হয়েছিল, পিআরএল ভোগরত কর্মকর্তাগণ বিজেএমসির পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পদে কর্মরত থেকে এ পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি খাতে কত টাকা উত্তোলন করেছেন তার প্রকৃত আর্থিক মূল্য এ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়। যদিও বিশেষ মহলের আশীর্বাদে সেই সময় তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি কর্মকর্তাদের। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সব আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিন উপদেষ্টা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পিআরএলে থাকা অবস্থায় তিন কর্মকর্তার পাটকল কর্পোরেশনের উপদেষ্টা নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির যোগসাজশে সব আইন লঙ্ঘন করে কিভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উপদেষ্টা। ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে পিআরএলে থাকা অবস্থার একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব), বাবুল চন্দ্র রায় (যুগ্ম সচিব) দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে একই সঙ্গে বেতন গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়মের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন- এ শিরোনামে বলা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের এ তিন কর্মকতা দুই বছর বাংলাদেশ পাটকর কর্পোরেশনের পরিচালকের দায়িতও¡ পালন করেন। বলা হয়েছে, এ তিন কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং প্রত্যেক উপদেষ্টাকে মাসিক ৮০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপদেষ্টারা পরিচালকের কক্ষে বসেই পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিবেদনে নিয়োগকে সম্পূর্ণ অবৈধ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের অর্গানোগ্রামে উপদেষ্টার কোন পদ নেই এবং জনপ্রশানসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ পদ অনুমোদিতও নয়। প্রতিবেদনে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ তাদের নিয়োগ দাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া তাদের সম্পদের তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কাজে লাগানোর সুপারিশও আছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করে গ্রহণ করা সমূদয় অর্থ ফেরত নেয়াসহ তাদের বিরুদ্ধে এবং নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা যেতে পারে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের বিষয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা যেতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তিন কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, তিনজনই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিষেশ সুবিধাজনক পদে পদায়ন পেয়েছেন। একেএম নাজমুজ্জামান পাট ক্রয়ের সময় নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ অবস্থানের পর তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দুজনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। সিরাজুল ইসলাম ও বাবুল চন্দ্র রায়ের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মতামত জানতে চাইলে একেএম নাজমুজ্জামান রাগ ঝেড়েছেন প্রতিবেদকের ওপর। তিনি বলেন, ‘উল্টা পাল্টা লিখে আপনিই এসব করেছেন। আমার কাছে তথ্য প্রমাণ আছে আমি আপনার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করব।’ তবে অপর এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এখনও মন্ত্রণালয়ের কোন চিঠি পাইনি। মন্ত্রণালয় আমার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেবে আমি মেনে নেব।’
×