ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এবার সবুজ সারখ্যাত ধইঞ্চার জীবন রহস্য উন্মোচন

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 এবার সবুজ সারখ্যাত ধইঞ্চার জীবন রহস্য উন্মোচন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পাটের পর দেশের বিজ্ঞানীরা সবুজ সার হিসেবে পরিচিত ধইঞ্চার জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। দেশে কৃষি খাতে উচ্চ প্রযুক্তির গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের নীতির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাট বিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা ধইঞ্চার এই জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্পন্ন করে এর জিনসমূহ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই আবিষ্কারের ফলে দেশীয় ধইঞ্চার উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হবে। এতে নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে বহুল ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা যাবে। যা দেশে ফসল আবাদকে সাশ্রয়ীই করবে না, মাটির স্বাস্থ্যেরও প্রভূত উন্নতি হবে। বিজ্ঞানীরা জানান, ধইঞ্চার জিনোম গবেষণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করতে হবে। একইসঙ্গে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিশ্চিত করাও আমাদের জন্য জরুরী। বর্তমানে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়াতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের এ পন্থা স্বাস্থ্যকর জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য সহায়ক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই বিশ্বব্যাপী জিনোমিক্স গবেষণালব্ধ ‘সবুজ প্রযুক্তি’-তে কম কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করে পানি সাশ্রয়ী ও ঘাতসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সবুজ সার হিসেবে ধইঞ্চার ব্যবহার বাংলাদেশে প্রাচীন। ধইঞ্চার শিকড় ও গায়ে এক ধরনের নডিউল বা গুটি তৈরি হয়, যাতে ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। এ সব ব্যাকটেরিয়া বায়ু থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন ধরে গুটিতে সঞ্চয় করে, যা গাছ ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, বায়ুমন্ডলে ৭৬ ভাগ নাইট্রোজেন থাকা সত্ত্বেও গাছ সরাসরি তা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু ধইঞ্চা ব্যাকটেরিয়ার সহায়তায় তা করতে পারে। ধইঞ্চার এ বৈশিষ্ট্য অন্যান্য ফসলে প্রয়োগের লক্ষ্যে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় এ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় এবং উন্মোচন করা হয় ধইঞ্চার জীবন রহস্য বা জিনোম সিকুয়েন্স। এখন জিনোম ও ট্রান্সক্রিপটম সিকুয়েন্সিং হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে ধইঞ্চার গায়ে নডিউল গঠনের কৌশল জানা যাবে, যা ব্যবহার করে বিভিন্ন ফসলের উন্নয়ন সাধন করা যাবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোঃ মনজুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশে চার প্রজাতির ধইঞ্চা চাষ হয়। এরমধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ জমিতে চাষ হয় সেসবানিয়া বিসপিনোসা প্রজাতির ধইঞ্চা। এই প্রজাতিটি জলাবদ্ধতা এবং রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল বিধায় বাংলাদেশে এর চাষাবাদের বিস্তার লাভ করেছে। অপরদিকে সেসবানিয়া রোসট্রাটা নামের অপর একটি জাতও বাংলাদেশে অল্প পরিমাণে চাষ হয়। যা আফ্রিকান ধইঞ্চা নামে পরিচিত। আফ্রিকান ধইঞ্চার শিকড়সহ সারা গায়ে নডিউল থাকে অর্থাৎ এ প্রজাতির ধইঞ্চার নাইট্রোজেন ফিক্সিং ক্ষমতা বেশি, কিন্তু এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না এবং ছত্রাক জাতীয় রোগের প্রতি সংবেদনশীল। কাজেই চাষাবাদের পরিধি, জলাবদ্ধতা এবং রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সেসবানিয়া বিসপিনোসা প্রজাতির জিনোম সিকুয়েন্স উন্মোচনের গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এ গবেষণার মাধ্যমে সেসবানিয়া বিসপিনোসা প্রজাতির জলাবদ্ধতা সহনশীল বৈশিষ্ট্যটির মলিকুলার মেকানিজম জানা যাবে এবং তা প্রয়োগ করে পাটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফসলের উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, ‘জীবন রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ধইঞ্চার চারটি প্রজাতির ট্রান্সক্রিপটম সিকুয়েন্সিংও করা হয়েছে। যা থেকে এই চারটি প্রজাতির বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার বিষয়ে একটি চিত্র পাওয়া যাবে এবং এ প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে ধইঞ্চারও উন্নত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সেসবানিয়া বিসপিনোসার জলাবদ্ধতা সহনশীলতা এবং রোগ ও পোকা-মাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য প্রজাতি থেকে বেশি, অপরদিকে আফ্রিকান ধইঞ্চার মূলসহ সারা গায়ে নডিউল থাকে। ট্রান্সক্রিপটম সিকুয়েন্সিং গবেষণা কার্যক্রম থেকে ধইঞ্চার গায়ে নডিউল গঠনের কৌশল জানা যাবে, যা ব্যবহার করে দেশীয় ধইঞ্চার উন্নয়ন সাধন করা যাবে। ফলে নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে বহুল ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ইউরিয়ার ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে করে ফসল উৎপাদন সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্য উন্নত হবে।’ ইতোমধ্যে দেশীয় ধইঞ্চার অর্থাৎ সেসবানিয়া বিসপিনোসার জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্পন্ন করে তা আমেরিকায় অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনে (এনসিবিআই) জমা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় নিরীক্ষান্তে এনসিবিআই তা গ্রহণ করে একটি এক্সেশন নম্বর ইস্যু করেছে। এই নম্বরটি হচ্ছে কিউএলওএইচ ০০০০০০০০। যার জিনোম সাইজ হচ্ছে প্রায় ১১৬৮ মিলিয়ন বেস পেয়ার এবং জীন সংখ্যা প্রায় ৪৯,০০০টি। জিনোম এবং ট্রান্সক্রিপটম সিকুয়েন্সিংয়ের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এখন বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের কাজ চলছে। ইতিপূর্বে সম্পন্নকৃত জিনোম গবেষণার ফলাফল বিএমসি জিনোমিক্স ও নেচার প্ল্যান্টের মতো বিশ্বখ্যাত জার্নালে প্রকাশের ধারাবাহিকতায় এ গবেষণার ফলাফলও অনুরূপ জার্নালে প্রকাশের পাশাপাশি মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের কার্যক্রম চলছে। উল্লেখ্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং পরিবেশের ক্ষতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিবেশবান্ধব কৃষি গবেষণাকে জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পদক্ষেপে পাট বিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে বিশ্বমানের জিনোমিক্স গবেষণার সুবিধাসম্পন্ন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। এটি একটি সর্বজনীন প্ল্যাটফর্ম অর্থাৎ সব ধরনের প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনোম নিয়ে এখানে গবেষণা করা যাবে। জিনোম গবেষণায় সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি নতুন কৃষি বিপ্লবের সূচনা করা সম্ভব হবে।
×