ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অন্য স্রোতের গল্প

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

অন্য স্রোতের গল্প

পৃথিবীর এ ধারে সুনসান নীরবতা ছাপিয়ে অঘ্রাণের বাতাস বইছে। দমকে ওঠা বাতাসের ঘূর্ণি হালকা ঝাপটা দিয়ে যায় অন্ধ চরাচরে। চারদিক কিছুটা ওলোটপালট, তারপর আবার শান্ত। আশপাশে কোথাও একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। একটা দলছুট বাতাসের দল হিমধরা আমেজ নিয়ে বিপুল আধিপত্যে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। কাজ থেকে ফিরে ঘরের আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে আছি গা এলিয়ে। শরীরের সঙ্গে মনের সন্ধি হচ্ছে না কিছুতেই। পাঁজরের কাছে অদৃশ্য কোণের এক চিনচিনে অনুভূতি সন্ধ্যা থেকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসলেই কি তাই? নাকি মগজের লেঠেল বাহিনী দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে আজকাল? দুজন মাত্র মানুষের পৃথিবী আশ্চর্যরকম স্থির; এখানে চারপাশের সময়টাও আমাদের মতো নির্ঘুম, স্থবির। বাইরের ঘূর্ণায়মান সময়কে পাশ কাটিয়ে আমার মা তহুরা বেগম নির্জীব বসে থাকেন তার ঘরে। এদিকে বুকের ভেতরের অস্থির হৃৎপাখি সন্ধ্যা থেকে ঠিক যেমনি করে ঢিপঢিপ করে যাচ্ছিল অচেনা সুরে তার সে মুহুর্মুহু ডাক তখনও থামেনি। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের তালে একটা ভয়ের শিষ বাজছিল যেন। মায়ের ঘরে একবার উঁকি দিতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যান তিনি। খোকা এসেছিস? এই তো মা। একটু কথা শুনে যাস। জরুরী কিছু বলবে মা? কাল একবার সময় করে গাঁয়ে যেতে হবে। আমি চিঠি লিখে রেখেছি আর সঙ্গে কিছু..... মায়ের শীতল কণ্ঠে শঙ্কামেশানো; যা আরও হিমশীতল করে দিয়েছে ঘরের পরিবেশকে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি আবার বললেন, সঙ্গে কিছু টাকা নিয়ে যাস। লোকমান ভাইয়ের কথা খেয়াল আছে তোর? তার কাছে দিবি। আর শরিফারও একটা খোঁজ নিয়ে আসবি। মায়ের ঘরের দেয়ালে ঝুলানো বিশাল একটা পোট্রেটের গায়ে একজন নারী ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন একা। আমার কাছে মায়ের এ নিমগ্ন বসে থাকাটুকু ঠিক তেমনই লাগল। ছবির নারীর মুখাবয়বের সঙ্গে মায়ের চেহারার বেশ খানিকটা মিল থাকলেও দুজনের বয়সের তফাৎ রয়েছে অনেক। মায়ের শরীরে নবীন বার্ধক্য উঁকি দিয়েছে এখন; তারপরও শুধু উদাস, স্থির চোখে তাকিয়ে থাকাটুকু দেখে আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলাম, এমন কিছু কি হয়েছে যার জন্যে জরুরী যেতে হবে গাঁয়ে? কিছু বলবি আর? না মা। ঠিক আছে। তবে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়িস। লোকমান, শরিফা এ নামগুলো আমার কাছে অপরিচিত নয়, হঠাৎ শোনা কোন চরিত্রও নয়। গাঁয়ে থাকা লোকমান মিয়া সম্পর্কে মায়ের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইÑ শরিফাও ঠিক তেমন সম্পর্কের কেউ। এতটুকু আমি আগে থেকেই জানি। তারপরও অনেকদিন পর তাদের নামগুলো শোনার পর থেকে অজানা এক শঙ্কা কেমন যেন অবশ করে দিয়ে যাচ্ছে সমগ্র চেতনা। তাদের কারও কি বিপদ হলোÑ এমন চিন্তায় কুঁকড়ে গিয়ে সারারাত ঠিকমতো ঘুম হলো না। মনে মনে ভাবছি, কে এই শরিফা? যার কথা উঠলে মা একদম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন, আশ্চর্যরকম নীরব হয়ে যান। কী যেন এক অসামান্য শক্তি রয়েছে এই অদেখা নারীর! যে কিনা দূর থেকেও অদৃশ্যশক্তির মতো এই পরিবারে থেকে যাচ্ছেন ভীষণভাবে। সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই মনে হলো, আজ বাতাসটা বড় নিষ্প্রাণ, অগোছালো। বুকের ধুকপুকানির মতো কেমন বিক্ষিপ্তভাবে বইছে চারদিকে। আর অনেকক্ষণ গাড়ি চালিয়ে গাঁয়ের দিকটায় প্রবেশ করতেই বুঝলাম রঙের-কথার-সজীবতার আধো আধো বোল ফুটছে প্রকৃতির সবখানে। দিনটাই যেন আজ কেমন রঙা-বেরঙা অপার রহস্যে বন্দি। পাকা সড়ক ছেড়ে কাঁচা সড়কে নামতেই অনেক গাছের ভিড়ের ফাঁকে এক চিলতে আকাশ দেখা গেল। ব্যস্ততার অজুহাতে যা এতদিন ঠিকমতো লক্ষ্যই করিনি। গাঁয়ের আকাশÑ ঘোলাটে নয়, রোদ্দুরের ঝিকমিক খেলা নেচে বেড়ায় সেখানে। ডানামেলা ভাবনার একটা আভাসও সেখানে লেখা ছিল নির্ভয়ে। ২. চকচকে নীলচে-কালো রঙের মার্সিডিজ গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে পেছনে মুখ থুবড়ে অসহায় পড়ে থাকে ধুলোমাখা মাটির সড়ক। গেরুয়া রঙের চাদরে ঢেকে যায় পেছনের পথ, গাছপালা, দোকানপাট, ছোট হয়ে যাওয়া সারিবদ্ধ মানুষের দেহের আকৃতি পর্যন্ত। গাঁয়ের সে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে অপার রহস্যের অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে আমার গাড়ি। কোথাও বোধহয় মায়াজড়ানো আশ্চর্য কোন ব্যাপার মাখামাখি হয়ে ছিল বাতাসে। তাই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিতেই পড়ন্ত মধ্যাহ্নের এক টুকরো নরম রোদ বাতাসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে অনুমতিহীন ঢুকে পড়ল গাড়ির ভেতরে। একদম নিবেদনহীন সে রোদ-হাওয়া গায়ে মেখে নিতে দারুণ লাগছিল তখন। স্টিয়ারিং হাতে একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে সামনের অল্পবয়সী ছেলেটা। মাত্র ক’দিন হলো এসেছে, নতুন ড্রাইভার। ফড়ফড় করলেও চোখে-মুখে এক ধরনের সপ্রতিভাত আছে। ওকে উদ্দেশ করে বললাম, সামনে যে চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে ওখানেই গাড়ি থামাও। কাউকে না হয় জিজ্ঞেস করে.....কথা শেষের আগেই ক্যাচ করে সশব্দে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দেয় সে। এই তোমার নাম যেন কী? ভ্রু কুচকে খুব বিরক্ত নিয়ে জিজ্ঞেস করি। স্যার, সুজন। এভাবে হুট করে গাড়ি থামালে কেন? যা করবে ভেবেচিন্তে খুব সাবধানে করবে। ঘাড় কাত করে বোকার মতো বলে, জি আচ্ছা স্যার। বাইরের সোনাঝরা নরম রোদের সঙ্গে শস্যশূন্য মাঠ আর বুনো জংলার সোঁদা গন্ধ মিশে বাতাসে বিলকুল ভাসছে তখন। একাকার করা সে গন্ধে মন শুধু আকুল হতে চায়। রোদের তাপে অসহনীয় ব্যাপারটা নেই একদম। পিঠ পেতে আপন করে সাদরে ডাকছে যেন আমায়। বিড়বিড় করে কেবল বলছিলাম, একটু জিজ্ঞেস করে নিতে পারলে ভাল হতো। অমনি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সুজন বলে ওঠে, ঠিক স্যার। আন্দাজে আর কতক্ষণ গাড়ি টানা যায়। কাউকে জিজ্ঞাস করে নেয়াই ভাল। সামনে মুরব্বির একটা চায়ের টঙ দেখা যায়। ওইদিকে যাই স্যার? ঠিক আছে, যাও। জনমনিষ্যিহীন দীর্ঘ পথের ধারে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ গুমটি ঘর। দূরে কাছাকাছি দাঁড়ানো আরও কয়েকটি খড়ের চালা হাঁপিয়ে উঠে একে অন্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। পাশে রোদে তাতা ক্ষেত, ফসলশূন্য ধু-ধু। রোদঘুমে ক্লান্ত সব, বড় নিঝুম খাঁ খাঁ চারদিক। অর্ধেক ঝাপখোলা শরীর নিয়ে গুমটি ঘরটি হাঁ হয়ে আছে; নিভানো উনুনের উপর কালিমাখা চায়ের কেটলি হাঁপাচ্ছিল জিভ বের করে। তপ্ত দুপুরের গিরগিটির মতো ষাটোর্ধ বুড়োটি দোকানের আস্ত উনুন থেকে বের হয়ে আসছিল তড়িঘড়ি করে। গাড়ি নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় সুজন। সবাই ততক্ষণে কাজ শেষে বাড়ির দিকে বা অন্য কোথাও ছুটে গিয়েছিল হয়তÑ তাই জায়গাটা কেমন জনশূন্য। অনেকদিন পর চালতা গাছের ফাঁকে করুণ সুরে একটা তিলাঘুঘুকে ডাকতে শুনলাম আমি। ঠিক আমাকে নয়- বিষাদমাখা মনের বিষণœœ অনুভূতিকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিল ঘুঘুটি। বৃদ্ধ দোকানি দোকান বন্ধের যাবতীয় বন্দোবস্ত শেষ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। চাচা, জয়নারায়ণপুর গ্রামটা কোনদিকে? আন্যেরা কোন বাড়িত যাইবেন? আমি তখন ভাবি মা তো বিস্তারিত তেমন কিছু বলেনি। শুধু দুটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘জয়নারায়ণপুর’। পথিমধ্যে বড় বাজার পেরিয়ে মাইল দুয়েক গেলেই শরিফাদের গ্রাম। তবে গাঁয়ে যাবার পথে বিশাল একটা দীঘি আছে। সেটারও আবার চমকভরা নাম। সবাই দুই সতীনের দীঘি বলে চিনে। দীঘির সম্মুখেই লোকমান দর্জির দোকান আছে। সেই লোকমান দর্জি মানে লোকমান মামাই বাড়ির পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে। যতদূর মনে পড়ে ছিপছিপে সে মানুষটাকে আগেও দু’একবার দেখেছিলাম আমাদের বাড়িতে। সবিস্তারে দোকানিকে কথাগুলো জানিয়ে একটু দম নেই আমি। আঙ্গো গেরামের নাম রত্তনহুর। ইয়ান তুন সোজা গেলে বিরলী বাজার। হিয়ান তুন ডাইনে গেলে বিরাট বাজার পইড়ব। এইটাই রাজাহুর বাজার। আন্নে হিয়ানে যাই এক্কানা খোঁজ লন। আর নোয়াজের সময় হইছে। আমার চকচকে গাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আর ফিনফিনে দাঁড়িতে আলতো হাত বুলিয়ে কথাগুলো বললেও বুঝতে তেমন কষ্ট হয়নি আমার। বাড়িতে মাকেও মাঝে মাঝে শুনেছি এমন ভাষায় কথা বলতে। শুনতে দুর্বোধ্য মনে হলেও একেবারে বোধগম্যহীন নয়; কেমন যেন কড়া নেড়ে যায় মনের দরজায়। গাঁয়ে পা দেবার পর থেকে অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছি ভেতরে ভেতরে। আমার যদি এখানে শেকড় গাড়া থাকতো খুব একটা মন্দ হতো না। মুরব্বির কথামতো ছোটখাটো বিরলী বাজার পেয়ে গেছি। খালের ওপর পাকা সেতু পেরিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই বিরাট রাজাপুর বাজারের কাছে। গাঁয়ের বাজারের এমন সরগরম অবস্থা দেখে সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আজ তো বৃহস্পতিবার- তবে কি হাটের দিন এখানে? বাজারের প্রান্তে জীপ নিয়ে ঢুকতেই সবাই কেমন ড্যাবড্যাব চোখে দেখছিল আমাকে- অচেনা এক আগন্তুকের মতো। সত্যিই তো। আমি তো তাদের কাছে অচেনা অনাহুতই। এখানে জিজ্ঞাসা করতেই পেয়ে যাই মিনিট বিশের দূরত্বে সেই দুই সতীনের দীঘির ঠিকানা। আমার প্রত্যাশিত গন্তব্য যতই কাছে আসতে থাকে চেতন জগতের মধ্যে অচেতনের একটা অজানা অভিমান ভিড় করতে থাকে একটু একটু করে। ৩. দুই সতীনের দীঘির পাড়ে গাঁয়ের নির্জন রাস্তাটা মধ্যাহ্নের অলস রোদ পোহাচ্ছিল কেমন মাটির শরীর পেতে। সরু সর্পিল জনশূন্য সে রাস্তার একটা অংশ চলে গেছে লোকমান দর্জির দোকানের সামনে দিয়ে। সেখানে তার সেলাই মেশিনের খটখট ছন্দতোলা আওয়াজ দুপুরের অবসন্ন নিস্তব্ধতা ভাঙছিল প্রতিদিনকার মতো। গাড়ির গোঙানির আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলেন মানুষটি। ছিপছিপে লম্বা শরীরের মানুষটাকে দেখলাম অনেকদিন পরÑ ধনুকের মতো বাঁকা শরীর নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কিংবা তিনি হয়ত আমার জন্যেই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ডান হাত দিয়ে আমার মাথা যখন স্পর্শ করছিলেন চোখের কোণায় চিকচিক করছিল রূপার মতন অশ্রুদানা। আপনিই তো লোকমান চাচা? জী বাবা। তবে চাচা না; আমি তো তোমার মামা হই। তহুরা সম্পর্কে আমার ভইন হয়। ও, হাঁ। অনেকদিন পর তো। তাই ঠিক মনে করতে পারছিলাম না মামা। এদিকে মায়ের ডাকনাম যে তহুরা সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো। মা আপনাকে একটা চিঠি আর এই খামে কিছু টাকা দিয়েছে বোধ হয়। আমারে না। চল, বাড়ি যাই আগে। তুমি নিজ হাতে চাচির কাছে দিবা। আমি সম্মোহিতের মতো লোকমান মামার কথাগুলো শুনে যাই। ধূলি ওড়া রাস্তার বাঁকে বিশাল জোড় তালগাছ দুটি গাঁয়ে ফেরা হাঁটুরের পথ আগলে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে আঙুল দিয়ে তিনি দেখালেন বাড়ি যাওয়ার পথটি। আমি ততক্ষণে সুজনকে ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে মামার সঙ্গে হাঁটতে থাকি। মামার সঙ্গে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছি আগেও কি এমনি করে রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো গাছ দুটি- গোঁফওয়ালা একরোখা সান্ত্রীর মতো? ঠিক মনে পড়ছে না আজ। আগে খুব ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে দু’একবার এসেছিলাম গাঁয়ে। একটু বড় হওয়ার পর কেন জানি সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা। খুব একটা আসতে চাইতেন না। আমাকেও আসতে দিতেন না। অবশ্য লোকমান মামার সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ রেখে গাঁয়ের খোঁজখবর ঠিকই রাখতেন তিনি। অনেকদিন পর আসায় টুকরো নানা স্মৃতি একটু একটু করে মনে ভাসছে আজ। চিঠি আর টাকা নিয়ে এতদিন পর গাঁয়ে ফিরে আসার যথার্থ কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। কোন দায় শোধ কিংবা ঋণ স্বীকারের ব্যাপার নেই তো? নাকি মায়ের রেখে যাওয়া সহায়-সম্পত্তি বা বাস্তুভিটার হিসাব-নিকাশের কোন বিষয় জড়িয়ে আছে এতে? শেষবার যখন এসেছিলাম দুপুরের ঝাঁঝাঁ রোদ পেছনে ফেলে সাইকেলে টুংটাং শব্দ তুলে লোকমান মামা আমাকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছিলেন এখানে ওখানে। গাঁয়ের রাস্তায় পথচলতি মানুষ আর রিকশার টুংটাং শব্দ পেয়ে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যেতো আমার। তবে এ মুহূর্তে ভাবনাটি কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে আমাকে দেয়া সেই চিঠির অক্ষরগুলোর ভাঁজে- কী লেখা আছে তাতে? অবশেষে নিজেকে দমিয়ে রেখে ভাবি- থাক, সবকিছু পরে একসময় জানা যাবে। গাঁয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেছে- সেও দু’যুগ পেরিয়েছে। অনেক কিছুই আমার আজ ঠিকমতো মনে নেই। আজ প্রথম দেখায় লোকমান মামাকে চিনতে না পারার একটা অস্বস্তি ভেতরে কাজ করছে সেই তখন থেকে। নির্লোভ সাদাসিধে মানুষটা আগের মতোই ছিলেন- শুধু ভেতর থেকে অনেকটা বদলে গেছি আমি। বিকেলের দিকে আলো যখন একদম মিইয়ে এসেছে গাঁয়ের অফুরন্ত আলো-হাওয়া গায়ে মেখে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল আমার। ওদিকে ড্রাইভার ছোকরাটি পেছন থেকে জিপ নিয়ে আমাদের অনুসরণ করে যাচ্ছিল। সরু পথে চলতে চলতে মামার কথাতেই আবার সম্বিৎ ফিরে আসে। সামনে বাম দিকে যে গোরস্তান দেখা যায় তারপরেই শরীফাদের উঠান। ওইখানে চাচি একা থাকে; মানে শরীফার মা। আমিই দেখাশোনা করি তার। মা আসেন না কেন মামা? সে কথার উত্তর না দিয়ে লোকমান মামা আমাকে নতুন একটা কবরের কাছে নিয়ে গেলেন। ঘাস দূর্বা ওঠেনি, মাটি এখনও নতুন। এইটা শরীফার ঠিকানা বাপ... আমাগো শরীফার কবর। অনেক চেষ্টা করছিলাম যোগাযোগের। কিন্তু, পারি নাই। আমার শূন্য মগজের ভেতরে ততক্ষণে হাজারো প্রশ্ন তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করে যাচ্ছিল। অনেক কিছুর জবাব খোঁজার চেষ্টা করে যাই আমি। মামার দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলি, মাও কি কোন যোগাযোগ করেননি মামা? মরণের সঙ্গে যুদ্ধ কইরা শরীফার পরাণ গেছে। তোমার মুখখান একবার দেখতে চাইছিল সে। প্রথম দিকে শরীফার অসুস্থতার সময়ে তহুরা মাসে মাসে কিছু টাকাও পাঠাই তো আমার কাছে। শেষে ওইটাও সে বন্ধ কইরা দিল। চিকিৎসা না পাইয়া শেষে.....একপর্যায়ে ঝরঝর করে কেঁদে উঠে আবার পাথরের মতো চুপ হয়ে গেলেন মানুষটি। ৪. জীবনের রূঢ়তম সত্যটা তারপরেই এসেছে আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ঝড়ের বেগে। গাঁয়ে এসে এমন নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য যে দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন তা মোটেই ছিল না আমার- এমনকি ন্যূনতম ধারণাও। শুধু মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে একা একাই সামলে নিচ্ছিলাম সবকিছু। আপনাদের বলে রাখি, এমন মহৎ গল্পের দৃষ্টান্ত আপনাদের অনেকের জীবনেই হয়ত সত্য হয়ে আছে। হাঁ, আমি বলছি নিশ্চয় আছে। তবে অমন মহৎ প্রাণের আত্মত্যাগের কাছে কেইবা পারে নিজেকে অজেয় করে তুলতে? লোকমান মামার কাছ থেকে এতদিন পরে স্বাভাবিক সত্যটা জানার পর বিশাল এক শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে নিল তখন। পাশাপাশি কবরে শুয়ে থাকা মানুষটার প্রতি প্রচ- একটা অভিমানও হতে লাগল। সে অভিমান বা রাগের মধ্যেও একটা ভালবাসার পাতলা আবরণ উড়ে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল বার বার। সারাদিনের ছোপ ছোপ অস্থিরতা স্থায়ী ক্ষতরূপে বুকের কোণে জেঁকে বসার আগে কবরের জায়গাটি ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই ঝাপসা উঠানের দিকে। লোকমান মামা লম্বা পা ফেলে আগেই ছুটে গেছেন সেদিকে- ঠাঁয় বসে থাকা শীর্ণা এক বৃদ্ধার অপত্য স্নেহের কাছে। অঘ্রাণের শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে বসে পলকহীন চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন তিনি। মুখের চামড়া কুঁঁচকানো অশীতিপর এক নারী মোড়ায় বসে যেন আমারই অপেক্ষায় ছিলেন। মুখের দিকে চেয়ে থাকলেও আসলে ঝাপসা চোখে তিনি ঠিক কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। পিতলের পানের বাটা হাতে মরা রোদের দিকে পিঠ পেতে যেন যুগ যুগ ধরে এমনই অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম, সাদা কাপড়ের এখানে ওখানে পানের পিকের ছোপ ছোপ লালচে খয়েরি দাগ। তার চারপাশে মিষ্টি জর্দার একটা অদৃশ্য সুবাস ঘিরে আছে। চোখের জ্যোতি কমে গেলেও গলার স্বরে এখনও কিছুটা দম আছে। কানেও শোনেন স্পষ্ট। বার্ধক্যের শেষ ধাপে উপনীত হওয়া মানুষটি খুুঁড়িয়ে খুুঁড়িয়ে হাঁটলেন সমগ্র উঠান- কাছ ও দূর থেকে প্রাণভরে দেখলেন তাঁর শেকড়ের সবটুকু পরিধি। একদিন পরেই আমি ফিরে আসি সেই শ্যামল মাটির উঠান থেকে। ফিরে আসার প্রস্তুতিতেও পা দুখানা আশ্চর্য দৃঢ়ভাবে আটকে ছিল সেখানে- প্রাণহীন এক মানুষের নতুন ঠিকানার কাছে। ফিরে আসার সময় বৃদ্ধা সে মানুষটির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে গেলে বুকের কাছে দলা পাকানো অদ্ভুত একটা অনুভূতি শিহরণ তুলে যায়। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি ছোট হয়ে আসা তাঁর ঘোলাটে নিষ্প্রাণ চোখের দিকে। আমায় তিনি প্রাণভরে দোয়া করছিলেন- হয়ত যেমনভাবে করতেন আমার গর্ভধারিণী জননীকে। কাঁপা হাতে ক্ষয়ে যাওয়া আঙুলসমষ্টি বেশ আলত করে আমার মাথায় ছোঁয়ালেন। অস্ফুট স্বরে কী যেন বলতে গিয়ে শুধু অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। আমি লোকমান মামার হাতে মায়ের দেয়া চিঠিসহ খাম গুঁজে দিয়ে আসি। এগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে কিনা জানি না তবে স্বার্থপরতার দলা পাকানো নিকষ কালো অন্ধকার আমার গা বেয়ে শিরশির করে উঠে যাচ্ছিল উপরের দিকে। সান্ত¡নার পরিতৃপ্ত বাক্য লোকমান মামার মুখে। চাচি আন্যে তারে দোয়া করি দেন। আল্লাহ কত্ত বড় মানুষ বানাইছে তারে। আন্যে দোয়া কইরলে শরীফার আত্মাও শান্তি পাইব। বিদায় নেয়ার আগে মনে মনে ভাবছি, মাংসহীন কঙ্কালের মতো একটা পরিকাঠামোর মাঝে এখানে প্রাত্যহিক সুখের মিছে মুখোশ নেই হয়ত- তবে আত্মত্যাগে প্রাণ বলিদানের মতো পরম সুখের অবাধ উপস্থিতি আছে। অবারিত সুখ-শান্তি এঁদের উঠানে দেহের আকার ধরে দাঁড়াবে না জানিÑ তবে কোথায় জানি আলোর ঝলকানি আছে, অদৃশ্য মায়ার আগল আছে। কোমল ছায়ার সুখের চাদর নাইবা থাকল তাদের জীবনে, কিন্তু শ্রীহীন জীর্ণ সে জীবনের কঠোর আগলের মাঝেই যে আমার প্রাণভোমরা নিহিত আছে। অপরাধবোধের গ্লানি নিয়ে সেখান থেকে মুখ লুকিয়ে ফিরে আসার সময়ও দেখি এক দিগন্তপ্লাবি দৃষ্টির প্রচ- অস্থিরতা আমায় খুঁজে ফিরছে অবিরত। হোক না তা ঝাপসা, ঘোলাটে কিংবা সীমার মাঝে আবদ্ধ, তবে তা অলীক চাতুর্যে মোড়া নয়। সেখানে সুখের দাম অলৌকিক। জীবন সায়াহ্নে উপনীত এ বৃদ্ধা মানুষটি আরও শত-সহস্র বছর বেঁঁচে থাকুক আমার প্রাণের গহ্বরে। আমিই তো ছিলাম তার গর্ভখনিজের লুক্কায়িত একমাত্র শস্যকুসুুম। মানুষটিকে হাজার প্রণতি জানাই যে কিনা আমার অদেখা জননীর জন্মদাত্রী হয়ে আজও বেঁচে আছে।
×