ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

 মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-২২ আজকের লেখাটি আমার বিগত পর্বের পরিপূরক হিসেবেই লিখতে হচ্ছে। বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার ধারণার অভাব আছে, সেগুলো ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যেমন, আমি বলেছিলাম যে সেকুলার চেতনা নিয়ে আমাদের রাজনীতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তরুণেরা যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু অচিরেই দেখতে পেলাম, সেই চেতনা থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে আসতে শুরু করলাম। এটা সত্য যে অনেকেই হয়ত ভাববেন এটাই যদি সত্য হয় তাহলে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে আমরা কি করে পাকিস্তানকে রুখে দাঁড়াতে পারি। আমার তো মনে এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে ’৬০ এর দশক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমরা যে রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছিলাম সেখানে আসলেই অসাম্প্রদায়িকতা কতটুকু স্থান পেয়েছিল? এটা ঠিক যে শিক্ষিত কিছু তরুণ যারা বলশেভিক আন্দোলন, কম্যুনিজমের চেতনা এবং পূর্ব ইউরোপীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু করে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তাঁরা নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীলতার ধারক, বাহক। কিন্তু সত্য কথা হলো এই যে সাধারণ মানুষের উপরে তাদের চিন্তাধারার প্রভাব আসলেই পড়েনি। এবং পড়লেও সেই চিন্তাধারা ছিল ক্ষণস্থায়ী। আজকে জনগণের কথা বলতে বলতে আমাদের মুখে ফেনা উঠে যায় কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই জনগণের কাছে আমরা অর্থাৎ এই প্রগতিশীলেরা সমর্থনের জন্য ফিরে যেতে পারি না। আমাদের আদি নিবাস গ্রাম বাংলায় হলেও ঢাকা শহরই দাঁড়ায় আমাদের কন্সটিট্যুয়েন্সি। কেননা, আমাদের অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল তরুণ রাজনীতিবিদেরা আমাদের জনসাধারণকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প থেকে বের করে আনতে পারেনি। প্রসঙ্গত, মনে পড়ে গেল যে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর বাংলাদেশের ব্যাপারে চরম দুঃখ পেয়ে ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জগজীবন রাম, দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘কন্যা, তুমি এক পাকিস্তান ভেঙেছো বটে কিন্তু দুটি পাকিস্তান বানিয়েছো।’ এই যে বাংলাদেশের চরিত্রগতভাবে দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে যাওয়া এর প্রতিফলন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অহরহ দেখা যায়। আর এখন আরও বেদনাবহ ব্যাপার হলো এই যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবাই তাদের মনের কথা বলেন। ফলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বেশিরভাগ মানুষ কি ভাবছেন। তাই আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে। যে পাকিস্তান আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ’৭১ এ, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা এই দেশটিকে স্বাধীন করেছিলাম, যারা আমাদের নারীদের সম্ভ্রমহানি করেছিল তারা এবং ভারত এখন সমানভাবে মূল্যায়িত। অথচ আমরা তো সবাই জানি যে ’৭১ এ ভারতীয়রা কেবল আমাদের এক কোটি মানুষকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল তাই নয় তাদের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য এই দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে ভারত আমাদের প্রতি সর্বদাই অসদাচরণ করে। এটা বোধহয় এ কারণে যে আমরা যখন আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর কথা ভাবি তখন তাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মূল্যায়ন করি না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেবল যে মধুর হবে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সকল প্রকার দ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে রেখে সেটাও ভাবা অনুচিত। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই নিজস্বতা থাকে যা তাদের নিজেদের জনসাধারণের কল্যাণের স্বার্থেই। সেইখানে কেউই আপস করতে চায় না। ’৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা চিন্তা করে আমরা যদি ভুলে যাই যে তারা একটি ভিন্ন রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের পরিচালনায় তাদের নিজস্ব কিছু এজেন্ডা থাকবে তাহলে আমরা অর্বাচীনের মতই চিন্তা করবো। এ ছাড়াও আরও দু-একটি বিষয় আছে যা রাজনীতি কিংবা কূটনীতিকে ছাড়িয়ে যায়। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যখন আমাদের জাতির পিতাকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন রাতারাতি ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারে ১৮০ ডিগ্রী বদলে গেল। তখন ক্যান্টনমেন্ট এবং ক্যান্টনমেন্টমুখী রাজনীতিবিদরা ভারতকে ‘ব্লাডি ইন্ডিয়া’ ছাড়া আর কোনভাবে সম্বোধন করতো না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যে কারও পক্ষে এই ধরনের মনোভাব সহ্য করা বাস্তবিক পক্ষেই অসম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে এইসব ভারত বিদ্বেষীরা অনেকেই তখন মনে করেছিলেন যে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত, বাংলাদেশ দখল করে নেবে। এই ধরনের অবিমৃষ্যকারী চিন্তা অবশ্যই বালখিল্য এবং পরিত্যাজ্য। সময়ে সবাই বুঝতে পারল যে ভারত একটি গণতাান্ত্রিক দেশ হিসেবে অনেক বেশি অভিজ্ঞতাপুষ্ট এবং দ্বিপাক্ষিক সম্বন্ধ সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তাশীল। আমি সেই সময়ের কিছু আবাল বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের অপরিপক্ব খামখেয়ালী চিন্তা ভাবনায় কখনই বিচলিত হইনি। আমি জানতাম যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মনোবৃত্তি কেমন হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে তখনও আমাদের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। অবশ্য আমাকে স্বীকার করতেই হয় যে আমাদের অগ্রযাত্রায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে সেটা যেমন জরুরী, আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম-গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে কিভাবে পথ চলব তা আরও বেশি চিন্তা ভাবনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ নিয়ে যখন ভাবি তখন এই বিষয়টিই আমাকে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত করে। যে কারণে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে ভাষা আন্দোলন, নানাবিধ সাংস্কৃতিক উপলব্ধি, ছয়দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি কথাই তো বলবার চেষ্টা করেছি আমরা। সেই আদর্শ থেকে কত দূরেই না সরে এসেছি আজ। একি সেই জগজীবন রামের মন্তব্য, ‘এক পাকিস্তান ভেঙে দুই পাকিস্তান’ বানানোর বিষয়টাকেই প্রতিষ্ঠিত করে না? (চলবে)
×