ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

বহুমাত্রিক শিল্পী হামিদুজ্জামান খান

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

বহুমাত্রিক শিল্পী হামিদুজ্জামান খান

হামিদুজ্জামান খান একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পী। তার কাজের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সুযোগ হয় কিশোর বয়সে আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি অগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে ঢুকে কিছু দূর গিয়ে হাতের বাঁয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক বিশাল ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’ আমার অদেখা সীমাহীন ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যরকম অনুভব জাগিয়ে তোলে। এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আহত হওয়ার পরও এক পা এবং এক হাতে অস্ত্র উঁচিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে জীবনের জয়গান গাওয়ার এ শিল্পকর্ম আমাকে তখনই মুগ্ধ করে। সেই থেকেই ভক্ত হয়ে পড়ি এই মহান শিল্পীর। এরপর যেখানেই তার কাজ চোখে পড়েছে অবাক বিস্ময়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছি। তার বেশিরভাগ কাজই মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি, পাখি ইত্যাদিকে উপজীব্য করে। অসাধারণ বিষয়কে যেমন করে তিনি অসাধারণভাবেই উপস্থাপন করেন ঠিক তেমনই সাধারণ বিষয়কে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করার এক অপূর্ব ক্ষমতা আছে তার। আর তাই তো তিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব পরিম-লেও নিজের কাজকে সগৌরবে উপস্থাপন করেছেন। হয়ে উঠেছেন আমাদের আন্তর্জাতিক শিল্পী। শিল্পী হমিদুজ্জামান খান মূলত একজন আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাস্কর হিসেবেই দেশে বিদেশে তার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। কিন্তু চিত্রকর্মেও যে তার সমান মুন্সিয়ানা আছে তার কাজে সেটিই আমরা দেখতে পাই। তার শিল্পচর্চার শুরুই হয় পেইন্টিং দিয়ে। চারুকলার ছাত্রাবস্থায় জল রঙের কাজে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এ জন্য পরিণত বয়সে এসে এখনও তিনি জলরং ও তেলরঙে প্রচুর কাজ করে থাকেন। এ পর্যন্ত দেশে বিদেশে তিনি বহু একক এবং দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। গত ১৭ নবেম্বর রাজধানীর বাড্ডার অবিন্তা গ্যালারি অফ ফাইন আর্টসে শুরু হয়েছে ‘নকটার্নাল শেডস’ বা নিশাচর ছায়া শিরোনামে শিল্পীর ৪০তম একক প্রদর্শনী।চলবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীতে তিনি আলো-আঁধারির মাঝে অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। গ্যালারিতে ঢুকেই নাক বরাবর দেয়ালে শোভা পাওয়া ৫২ ফিট লম্বা এবং ৬.৫ ফিট প্রশস্ত আলো-আঁধারির খেলা করা এক বিশাল চিত্রকর্মে চোখ আটকে যায়। এত বিশাল কাজ সচরাচর কোন প্রদর্শনীতে চোখে পড়ে না। রাজধানীতে সম্পূর্ণ বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা অবিন্তা গ্যালারির বিশাল স্পেসটিকে শিল্পী হয়ত সদ্ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ চিত্রকর্মটি মনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে। যেমন- একই স্থানকে দিনের আলোয় আমারা যেভাবে দেখি রাতের আবছা আলোয় কী সেভাবে দেখি? মানব জীবন কী পুরোপুরি স্পষ্ট? আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কী আলো-আঁধারির খেলা করে না? শিল্পী এই আলো-আঁধারির খেলা এবং অস্পষ্টতার মাঝেই জীবনের সৌন্দর্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন। অন্যভাবেও বলা যায়, পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়; খানিকটা আবদ্ধতার মাঝেও যে এক অসাধারণ সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে শিল্পী সেটিরও তালাশ করতে চেয়েছেন। এ্যাক্রিলিক মাধ্যমের এই কাজে যেন এক মহাজাগতিক রূপ ফুটে উঠেছে। এর পাশের দেয়ালে বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ একগুচ্ছ চিত্রকর্ম মন ভাল করে দেয়। ঠিক তার পরেই পাশাপাশি দুটি দেয়ালে ঝোলানো দুটি চিত্রকর্মে শিল্পী হিমালয়ের বিশালতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিশাল হিমালয় আর বিশাল মেঘমালার এক অপূর্ব সৌন্দর্য রচিত হয়েছে এ দুটি চিত্রকর্মে। ব্যক্তি হামিদুজ্জামান খানকেও আমি বরাবর দেখেছি হিমালয়ের বিশালতায় পূর্ণ এক হৃদয়ের সহজ মানুষ হিসেবে। আর এক পাশের দেয়ালে আরও একগুচ্ছ চিত্রকর্ম আমাদের ভাবনার গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ৯২টি চিত্রকর্মসহ মোট ১১২টি শিল্পকর্ম তার এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এক জায়গায় স্থির থাকেননি শিল্পী। প্রতিটি চিত্রকর্ম বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ। তার এই বিষয় বৈচিত্র্য শিল্পানুরাগী মানুষের মন একঘেঁয়েমি নয়; বরং মুগ্ধতায় ভরে দেয়। কাজের মাধ্যম হিসোবে বেছে নিয়েছেন জল রং, তেল রং এবং এ্যাক্রিলিক। প্রদর্শনীতে কয়েকটি স্থাপনা বা ভাস্কর্য শিল্পও স্থান পেয়েছে। গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর মেঝেতে স্থান পেয়েছে গ্রামীন জীবনে জলাশয়ে দেখা ছোট্ট শামুককে বিশাল আকৃতিতে উপস্থাপনায় এক ভাস্কর্য। পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ ভাস্কর্যটি স্টিলের পাতে তৈরি। নগরের বুকে ফেলে আসা বিস্মৃতপ্রায় গ্রামীণ জীবনকে মনে করিয়ে দেয়াটাতেও শিল্পীর স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মেঝেতে রাখা স্টিল পাতে তৈরি খানিকটা ডিম্বাকার আকৃতির আর একটি ভাস্কর্যে একটা ধীর-স্থিরতা খুঁজে পাওয়া যায়। এটির মাধ্যমে মায়াময় এক শান্তির পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছেন শিল্পী। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান কী ভাস্কর্যে কী পেইন্টিংয়ে উভয় জায়গায় তার শিল্পকর্মে একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হামিদুজ্জামান খান এখন আমাদের অন্যতম জ্যেষ্ঠ শিল্পী। তিনি তার এই বয়সে এসেও যে পরিমাণ কাজ করেন তাতে অনেক তরুণকেও হার মানতে হয়। লাখ করে দেখেছি প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকা বা ঢাকার বাইরে কোথাও না কোথাও তার ভাস্কর্যের কাজ চলমান থাকে। অন্যদিকে বিরামহীন চলে চিত্রকর্মের কাজ। নিজেকে তথা নিজের কাজকে আবদ্ধ করে রাখা নয় বরং বিলিয়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। সর্বোপরি তিনি তার কাজের মাধ্যমে আমাদের মাঝে এক অন্যরকম অনুভবের দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। এই বহুমাত্রিক শিল্পী সুস্থভাবে আরও দীর্ঘ সময় আমাদের মাঝে তার কাজের মাধ্যমে আলো ছড়িয়ে যান সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
×