ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

খুরশীদ আলম বাবু

সেরা পঁচিশ ॥ অনবদ্য গল্পের সমাহার

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

সেরা পঁচিশ ॥ অনবদ্য গল্পের সমাহার

একজন গল্পকারের কাছে সেরা গল্প বলে আমাদের কথাসাহিত্যে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা সেটা দীপ্র বিতর্কের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বনির্বাচিত গল্প গ্রন্থের ভূমিকায় তিরিশের খ্যাতিমান কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেনÑ ‘নিজের গল্প বাছাই করা ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। ঠিক যেন নিজের সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেছে নেয়ার চেষ্টা যে জীবন সমাজ সাহিত্য ইত্যাদি আসল পরীক্ষায় কে সবচেয়ে ভালভাবে পাস করেছে অর্থাৎ উতরে গেছে।’ (সূত্র : বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত মানিক বিচিত্রা, প্রথম প্রকাশ মে দিবস ১৯৭১) অবশ্য তার অনুজ গল্পকার বিমল কর অন্য ধারণা পোষণ করতেন। তিনি তার বাছাই গল্প-এর ভূমিকায় এই ধরনের শব্দকে বাজার চলতি বলে ধরে নেয়ার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করেছেন। কারণ বিদেশে এই ধরনের সংকলন প্রায়শ প্রকাশিত হয়, যা হয় এই রকম বেস্ট অফ মম অথবা বেস্ট অফ লরেন্স ইত্যাদি। ঠিক এই ধারায় নাজিব ওয়াদুদের অনবদ্য অনেকগুলো গল্প (যার সংখ্যা পঁচিশ) একসঙ্গে পাওয়া গেল, যা আমাদের গল্পসাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে সাম্প্রতিককালে গল্পলেখার এক ধরনের হাহাকার চলছে, তার প্রমাণ হলো ঈদ সংখ্যাগুলোতে প্রকাশিত গল্পমালা যা পাঠে চিত্তে কোনরূপ বিলোড়ন ঘটে না। মনে হয় কোথায় যেন সততার অভাব রয়েছে। গল্পকারদের গল্প লেখার জন্য যে মনোযোগ ও পরিশ্রমী মনোযোগ দেয়া জরুরী ছিল গল্প পাঠে সেই মনোযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তা যেমন রীতিমতো দুঃখজনক অনেকটা হতাশারও বটে। তবে এই নৈরাশ্যজনক অবস্থার প্রেক্ষাপটে গল্পকার নাজিব ওয়াদুদের সেরা পঁচিশ নামের অনবদ্য গল্প সংকলন হতাশার ক্লান্তি খানিকটা জুড়িয়ে দেয়। একসঙ্গে এতগুলো গল্প পাঠ রীতিমতো সমেয়ের ব্যাপার; পাশাপাশি গল্পের বিষয়বস্তু ও মনোব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দরকার। প্রথমত, পাঠকদের জানিয়ে রাখি, এই পঁচিশটি গল্পের অধিকাংশই এর আগে নাজিব ওয়াদুদের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থে বের হয়েছিল। তবে নতুন অগ্রন্থিত গল্পও রয়েছে কয়েকটি। এসব গল্প পাঠের সময় যে চিন্তা-চেতনা মনের কোনে জড়িয়ে গিয়েছিল, বিস্ময়করভাবে তাতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটল। হয়ত এই মন্তব্যের মধ্যে খানিকটা রহস্যময়তা থাকতে পারে। বস্তুত তা নয়। এক সময় মনে হতো নাজিব ওয়াদুদের হাতে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে তার সুবিখ্যাত আলোচিত গল্প ‘আবাদ’ পাঠের পর ‘আরও দুটি খুন’ নামীয় গল্পটি পড়লে বোঝা যায় নগর জীবনের যে ক্লেদাক্তময়তা, তার বর্ণনা দিতেও তিনি সমান শক্তিমান। বলাবাহুল্য, দুই গল্পের পরিবেশ অনুযায়ী যে আলাদা ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তাতেও তার দক্ষতার প্রমাণ রয়েছে। ভাষা ব্যবহারে রয়েছে মারাত্মক ভিন্নতাÑ যা মহৎ শিল্পের লক্ষণ। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই লিপিকৌশল উপার্জনে সমরেশ বসু ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের রচনা পাঠের অভিজ্ঞতাকে অকাতর দক্ষতায় কাজে লাগিয়েছেন নাজিব ওয়াদুদ। এতে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের গল্পসাহিত্য। আর এই কারণেই এই গল্পগ্রন্থের উপর আলোচনা একান্ত জরুরী। প্রথমে পাঠকদের জানিয়ে রাখি এই পঁচিশটি গল্প কোনভাবেই এক রকম বা এক মানের নয়। এসব গল্পে বিষয়বৈচিত্র্যের বর্ণচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রিজমের মতো নানা দিগন্তের দিক ঘিরে। এই গল্পমালায় বিষয় এক ম্যানারিজমের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে শাহরিক পরিবেশ ছাড়িয়ে কল্পবিজ্ঞান ও উপকথা-রূপকথার জগতেও প্রামাণিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন তিনি, যা তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি চিহ্নিত করতে আমাদের দারুণ সহায়তা করে। সেই কারণে অনেক সমালোচকের সঙ্গে আমরাও একমত ‘তাকে বিশেষ ধারার গল্পকার হিসেবে চিহ্নিত করা মুশকিল।’ অবশ্য এর আগে প্রকাশিত তার বরেন্দ্রবাংলার গল্প সংকলনের আলোচনায় এক সমালোচক আমাদের সাহিত্যের প্রয়োজনে জানিয়েছিলেন, নাজিব ওয়াদুদ সেই জাতের গল্পকারÑ সাম্প্রতিক কালের বিপথগামী গল্পকারদের মতন সাধারণ পাঠকদের সঙ্গে যিনি নাফরমানি করেন না। তিনি তার গল্পে গল্প রেখেছেন, কিন্তু তার বিশেষত্ব এবং কৃতিত্ব এখানে যে তিনি মপাঁসীয় ধারায় অবগাহন করে চেখভকে কা-ারি বানিয়েছেন। পাশাপাশি একটু কৌশলে গল্পকার আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রভাব (‘জীয়নকাঠি’ গল্পের কথা মনে রেখে) ধারণ করে গল্প সৃজনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সেই দিক দিয়ে নাজিব ওয়াদুদকে সাম্প্রতিক কালের ব্যতিক্রমী গল্পকার বললে ভুল বলা হবে না। এখন দেখা যাক এই সেরা পঁচিশ গ্রন্থের গল্পগুলোর মধ্যে কোন গল্প কোন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। গ্রামীণ পরিবেশের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত গল্পমালার মধ্যে রয়েছে- ১. আবাদ, ২. দখল, ৩. কান্নাহাসির উপাখ্যান, ৪. কমরেড ও কিরিচ, ৫. মেঘ ভাঙা রোদ ও ৬. নাকফুল। এই গল্প সমুচয়ের মধ্যে নাজিব ওয়াদুদ পরম্পরাগতভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোলাহল ও সঙ্কটের মধ্য দিয়ে সরাসরি নায়ক-নায়িকার মনোগত সমস্যা ও পরিস্থিতি হৃদয়ে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। যেমন ‘আবাদ’ (গল্পটি ‘শৈলী’ পত্রিকায় ‘নিষ্ফলা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল) গল্পের মাঝখানে নকশাল আন্দোলনের কথা প্রাঙ্গগিকভাবে এসেছে। যদিও গল্পের নায়করা এই আন্দোলনের সঙ্গে মোটেও জড়িত ছিলেন না। তবুও শাস্তি জুটেছে (সিরাজ পুলিশের গুলিতে মারা যায়, জগলুকে জেল খাটতে হয়), এমনকি প্রেমও ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়েছে। তবে লেখক কোনভাবেই হতাশাবাদীদের দলে ভিড়ে যাননি। নাজিবের এই সমস্ত গল্প পড়তে পড়তে যে আস্তিকতা ও শুভবোধের সুগন্ধি আমাদের চেতনার বিবরে ছড়িয়ে যায় তা সত্যিই অতুলনীয়। অন্তত এই গল্পের শেষাংশ পাঠ আমাদের স্মরণ করিয়ে দ্যায়, অধিকাংশ গল্পকার যেখানে অবিশ্ব্যাস্য নিখিল নাস্তির চারণ ক্ষেত্রে বিচরণ করতে অভ্যস্ত, সেখানে নাজিব ওয়াদুদ ব্যতিক্রমী। গল্পে সর্বদা নিজের রূঢ় অভিজ্ঞতার জানান দিলেও তিনি জীবনের প্রগতিকে অস্বীকার করেন না, বরং তাকে আধ্যাত্মিক আস্তিকতার চেতনায় প্রস্ফুটিত করে তোলেন। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে নাজিব ওয়াদুদের গল্পের ভেতর দেশে গ্রামীণ পরিবেশ অনবদ্য ভাষায় ফুটে উঠেছে তার সর্বোচ্চ মহিমায় ম-িত হয়ে। তা বলে অন্য ধারার গল্পে, তা হোক শাহরিক বা কল্পবৈজ্ঞানিক, বা উপকথা-রূপকথাময়, তাতেও তার ভাষার মহিমায় কোন কমতি দেখা যায়নি। দুটি ধারায়ই তিনি ভাষা ও বাকপ্রযতœকে দক্ষ হাতে সামলে নিয়েছেন। যেমন ধরা যাক মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক দুটি গল্পের কথা। প্রথমটি হলো ‘মেঘ ভাঙা রোদ’। গ্রামজীবনের এই গল্পের নায়ক রমিজ মুক্তিযুদ্ধের সময় তার প্রেমিকা ও মাকে হারায়। তার পরে বিমর্ষকেন্দ্রিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। কাজেকর্মে এক ধরনের অনীহা দেখাতে থাকে। আর এটা ক্ষুব্ধ করে তোলে তার পিতা তামিজউদ্দিনকে। শেষাবধি এক বর্ষণমুখর দুপুরে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পিতা তার প্রিয় সন্তানকে লাঠি দিয়ে (গল্পকারের ভাষায় ‘লড়ি’) ক্রমাগত আঘাত করতে থাকেন। এই আঘাতই রমিজউদ্দিনকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনে। গল্পের শেষাংশে অতুলনীয় গদ্য ভাষার ব্যবহার আমাদের মোহিত করে। পড়া যাক সেই বাক্যমালা- ‘দূরে কোথাও বাজ পড়ল। চিড়চিড় করে ফেটে গেল আকাশ। বৃষ্টি তখনও ঝরছে অঝোরে। মেঘ সরে যাচ্ছে পূবে। সব কিছু ভুলে জোয়ান ছেলেকে শিশুর মতো জাপটে ধরল তমিজউদ্দিন। হাপুস নয়নের আঁ আঁ করে কাঁদতে লাগল বাপবেটা। পশ্চিমের আকাশে উড়াল মেঘের ফাঁকে সূর্যটা তখন ফকফক করে হাসছে।’ এক ধরনের প্রতীকের মাধ্যমে গল্পটি শেষ হয়েছে। অন্য গল্পটি ‘শহীদ ইদু কানার বউ’। এই গল্পে গ্রাম ও শাহরিক পরিবেশের সহাবস্থান কখনও সমান্তরাল, কখনও পরস্পরভেদী। স্বীকার করা ভাল যে, গ্রামীণ পরিবেশের আবহে লেখা গল্পমালার দিকে আমার ব্যক্তিগত পক্ষপাত থাকলেও নাগরিক চেতনামন্ডিত গল্পমালাকে এড়িয়ে যেতে চাই না। এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ প্রত্যেক গল্পকার একধরনের সুপরিশীলিত নাগরিক। সাধারণভাবে নগরকেন্দ্রিক গল্প সৃজন করা সবসময় কঠিন। গল্প পাঠকরা সাধারণত অচেনা জগতের সন্ধান করে থাকেন। আমাদের গল্পসাহিত্যে অবশ্য নগরকেন্দ্রিক গল্পকারের সংখ্যাই বেশি। তবুও নগরকে কেন্দ্র করে ভাল গল্প যে পরিমাণ প্রত্যাশা ছিল, সে পরিমাণ আসেনি। নাজিবের শহরকেন্দ্রিক গল্পমালার মধ্যে আরও দুটি খুন ইতোমধ্যে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছে, যা রীতিমতো ঈষর্ণীয়। আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের দেখা যায় যারা ব্যক্তিগত জীবনের ধর্মকে আবর্জনা মনে করে। কিন্তু স্বার্থের কারণে আবার মাজার-দরবারের স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হয়ে যান। এই রকম একজন অধ্যাপক বুদ্ধিজীবীর কুলুষিত জীবনের অধ্যায়কে পিয়াজের খোসার মতো এক এক করে খুলে ফেলেছেন নাজিব ওয়াদুদ তার এই অনবদ্য গল্পটিতে। গল্পের নায়িকা শিরিন এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রফেসরের ছাত্রী থাকলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। পিএইচডি করার সুবাদে তারা ঘনিষ্ঠ হন এবং এক পর্যায়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই শারীরিক সম্পর্কের আগে প্রফেসর শিরিনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি তাকে বিয়ে করবেন। একপর্যায়ে শিরিন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে একজন ছাত্র খুন হয়। সেই রাতেই অধ্যাপক আপদ বিদায় করতে গলা টিপে হত্যা করেন শিরিনকে। ছাত্র খুনের ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত হয়। এই রাজনৈতিক কোলাহলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাঠের মাঝখানে খুঁজে পাওয়া যায় শিরিনের লাশ। ক্ষমতাবান অধ্যাপক এটাকে কোন সাধারণ ছাত্রের অসামাজিক কাজ বলে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন। এভাবে কৌশলে নিজের পাপমোচন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অদ্ভুত রূপকের মাধ্যমে গল্পের সমাপ্তি ঘটেÑ ‘নির্দেশ পেয়ে গাড়ি ছাড়ল ড্রাইভার। একটা দমকা বাতাসের ঘূর্ণি তখন প্যারিস রোডের ঝরা পাতা ওড়াতে লাগল।’ সত্যি বলতে কি একজন দক্ষ রহস্য গল্পের লেখকের মতন এই গল্পটি লিখেছেন নাজিব। রহস্য যে সফল গল্পের জন্য কতটা জরুরী এই গল্প পড়লে বোঝা যায়। অন্তত এই গল্পের ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাকে সাম্প্রতিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার বলতে দ্বিধা থাকে না। এই গ্রন্থের ২৫টি গল্পের বিষয়বস্তু যে পঁচিশ রকম, তার জন্য লেখককে গল্প চয়নে বেশ বাছ-বিচার করতে হয়েছে। তিনি এই গ্রন্থটিকে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ বলেননি বটে, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস নাজিব তাঁর সেরা গল্পগুলোকে ঠাঁই দিয়েছেন এই গ্রন্থে। তা পাঠে কোন পাঠক হতাশ হবেন না। প্রতিটি গল্প পাঠের শেষেই আনন্দ, বিস্ময়, জিজ্ঞাসা ও নবতর জীবনানুভূতি পাঠক মননে সঞ্চারিত হবে। সেটাই তার সফলতা। যেমন রয়েছে ‘খনন’ (মৃত্যু চেতনা আক্রান্ত), পাশাপাশি ‘পদ্মাবতী’, এমনকি ব্যর্থ প্রেমের কৌতুকময় বয়ান ‘সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’র মতো গল্প। প্রতিটি গল্পই আলাদা আলাদা করে আলোচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সেই সুযোগ এখানে কম। নাজিব ওয়াদুদের প্রত্যেকটি গল্পই পাঠযোগ্য হয়েছে এই কারণে যে, তার গল্প রচনার সংখ্যা কম। এই দিক দিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাতারে তাকে রাখা যায়। আরেকটি কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন- বর্তমানের অন্যান্য গল্পকারদের তথাকথিত উদ্দেশ্যবাদী গন্তব্যহীনতার জটাজালে তিনি জীবনকে বন্দী করতে চাননি। এই বিপ্লবী চেতনার জন্য তাকে পরিশ্রমী হতে হয়েছে। নাজিব ওয়াদুদের গল্পের রচনাশৈলীতে রয়েছে একইসঙ্গে রম্য ও বাস্তবতা জড়ানো শিল্পের ছাপ। তবে সেটা কোনভাবেই কষ্টকল্পিত ওঠে না। তিনি অভিজ্ঞতাকে সঞ্চারিত করেন ভাষার পরতে পরতে। দুটি উদাহরণ- ক. ‘বোশেখের শেষ। খাঁ খাঁ শূন্য আকাশে জ্বলতে থাকা সূর্যটা চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাতে তৈরি মাষকলাইয়ের রুটির মতো বড় ও গোল। আর কেমন যেন সাদাটে।’ (নাকফুল) খ. ‘দুই খেঁজুর গাছের মাঝখানে সোনার চাকতির মতো গোল চাঁদটা ছবির মতো। রাতের মেঘেরা হালকা পালক ছড়িয়ে আকাশের গা ঘেঁষে এলিয়ে পড়েছে। ওরা যেন আলোর পরি। ছায়া পড়ে না মাটিতে। আশ্বিনের জোছনা ধবধবে সাদা।’ (জীয়ন কাঠি) এই দুটি উদাহরণ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না যে, নাজিব ওয়াদুদ ভাল গদ্যকারের মতন একজন কবিও বটে। যদিও তিনি কবিতা লেখেন না বললেই চলে। তার গদ্যের ভাষা সুবোধ্য। ভাল গদ্যশিল্পীর মতন তার গদ্যের ভাষা তরতর করে বয়ে চলে। আর এখানেই সমকালীন অন্য গল্পকারদের চেয়ে তিনি ব্যতিক্রমী শীর্ষ চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের দেশে গল্পের উপর তুলনামূলক আলোচনা কম করে থাকেন সমালোচকরা। কবিতার পাশাপাশি গল্পের উপর আলোচনা গতি সেই তুলনায় প্রবহমান নয়। তবুও আমরা প্রত্যাশা করতে চাই নাজিব ওয়াদুদের সেরা পঁচিশটি গল্প অন্যান্য সমালোচদেরও আলোচনার বিষয় হবে। কারণ তার গল্প যে আমাদের সাহিত্যে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ঠিক সেই রকমই আভাস দিয়েছেন ওপার বাংলার বিশিষ্ট কথাশিল্পী মুর্শিদ এ এম- ‘নাজিব ওয়াদুদের গল্পে অবগাহনই নয়, সিক্ত হতে হতে কিছুটা বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে না পারলে পাঠকের অধরা থেকে যাবে শিল্পবোধের পরত ও পরম্পরা।’ এই মতামতের সঙ্গে আমি একটি বাক্য যোগ করতে আগ্রহী। সেটা হলো এই যে, শিল্পবোধের পরত ও পরম্পরায় জারিত হয়ে এই গল্পগুলো পড়বেন পাঠকরা। সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×