ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর আলোচনায় বিশিষ্ট নাগরিকদের আহ্বান

প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট, তাদের ভোট দেবেন না

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট, তাদের ভোট দেবেন না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে সাম্প্রদায়িক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে বলে অভিযোগ এনে তাদের ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় দেশবাসীর প্রতি এ আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, খালেদা জিয়া ও তারেকের অবর্তমানে বিএনপি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগায়নি। বরং নেতৃত্ব শূন্যতা পূরণে বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গী জামায়াত কামাল হোসেনসহ কিছু রাজনীতিককে ভাড়া করে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে। বিশিষ্টজন আরও বলেছেন, যখন তারেক রহমান মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নিয়েছেন তখন বোঝা যায়, তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি। আগামী নির্বাচন খুব সহজ-সরলভাবে হবে না। যারা মনে করছেন, এটি বকুল বিছানো পথে হবে, তা কিন্তু হবে না। এবার হবে গোলাপ বিছানো পথে, যে গোলাপের মধ্যে অসংখ্য কাঁটা আছে। যেই কাঁটাগুলোকে দেখা যায় না, কিন্তু হাত দিলে হাতে রক্ত ঝরে। পা ফেললে পায়ে রক্ত ঝরে। আমাদের সাবধানী ও সতর্ক হতে হবে। ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ আয়োজিত আলোচনায় বিশিষ্ট নাগরিকরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে স্পষ্টই একটি সাম্প্রদায়িক জোট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচন ঘিরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঠেকাতে ‘ব্রিগেড’ গড়াসহ বিভিন্ন সুপারিশও এসেছে আলোচনা সভা থেকে। বলা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিও সেইফ। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কেবল আওয়ামী লীগ না সংখ্যালঘুসহ সব ধরনের লোক সেইফ থাকবে না। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব ডাঃ মামুন আল মাহতাবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ আলী শিকদার। আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, নারী প্রগতি সংঘের রোকেয়া কবীর, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা চিত্তরঞ্জন দাস, খ্রীস্টান ধর্মীয় নেতা প্রলয় সমাদ্দার প্রমুখ। গত ১০ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার থাকার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে মেজর (অব) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, উগ্রধর্মান্ধ গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে উগ্রবাদ ত্যাগ করে চিরন্তন শান্তির পথে ফিরে আসতে শুরু করেছে। নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন, আমরা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কবল থেকে বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করার জন্য আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করি। বাঙালী সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক পক্ষ ও ব্যক্তিকে আমরা কেউ ভোট দেব না, এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হই। ঐক্যফ্রন্টের দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, জনগণকে সতর্ক করার প্রয়োজন আছে, কারা আজকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেব না। আজকে যারা মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, একই প্রতীকে নির্বাচন করার কথা বলছেন। তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উল্টে দেয়া হয়েছিল মন্তব্য করে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এখনও বিশ্বাসঘাতক রয়ে গেছে। তাদের বোঝা যাবে না। নানা প্রতারণার মাঝ দিয়ে তারা চেষ্টা করছে। সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ২০১৮ সালের নবেম্বর মাসে এসে যখন আমাদের সম্প্রীতির কথা বলতে হচ্ছে, তখন আমাদের দুঃখ হয়, বেদনা হয়, লজ্জা হয়। সাম্প্রদায়িকতা তো আমরা শেষ করে এসেছিলাম ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। যে মুক্তিযুদ্ধে মুসলমানের রক্ত, হিন্দুর রক্ত, বৌদ্ধের রক্ত, খ্রীস্টানের রক্ত, আদিবাসীদের রক্ত এক ¯্রােতে প্রবাহিত হয়েছে। তারপরে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা থাকার কথা না এখানে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অবর্তমানে বিএনপি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগায়নি বলে মনে করছেন অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, নেতৃত্ব শূন্যতা পূরণে বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী কামাল হোসেনসহ কিছু রাজনীতিককে ‘ভাড়া করে’ নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার তারেক রহমানের নেয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, খালেদা-তারেকের অবর্তমানে বিএনপির জন্য একটা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। কিন্তু যখন তারেক রহমান মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নিয়েছে তখন বোঝা যায়, তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া তাদের অপরাধের জন্য দ-িত হয়ে একজন কারাগারে আছে এবং একজন পলাতক আছে। সেই অবস্থায় বিএনপি-জামায়াত কিন্তু ভাড়া করে নিয়ে এসেছে ড. কামাল হোসেনকে এবং আরও কিছু রাজনীতিককে। এই অবস্থা কিন্তু হয়েছে বাংলাদেশে। ওই জোটের নেতারা মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। একেক আসনে বেশ কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার কথা উল্লেখ করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে তাকে কেউ হারাতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ হারাতে পারবে না। আওয়ামী লীগকে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। প্রশাসন নির্দলীয় করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সচিবালয়ে বিএনপির পক্ষের লোক খুব আছে। আশুগঞ্জে প্রশাসন থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বিজয় মেলা হবে না। ডিসেম্বর মাসে যদি বিজয় মেলা না হতে পারে আওয়ামী লীগের আমলে, তাহলে ভোট দেবে কোথায় গিয়ে? আগামী নির্বাচন খুব সহজ-সরলভাবে হবে না মন্তব্য করে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, যারা মনে করছেন, এটি বকুল বিছানো পথে হবে, তা কিন্তু হবে না। এবার হবে গোলাপ বিছানো পথে, যে গোলাপের মধ্যে অসংখ্য কাঁটা আছে। যেই কাঁটাগুলোকে দেখা যায় না, কিন্তু হাত দিলে হাতে রক্ত ঝরে। পা ফেললে পায়ে রক্ত ঝরে। আমাদের সাবধানী ও সতর্ক হতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন আমরা সাফল্যের হাইওয়েতে ছুটছি। আমাদের এই সাফল্যকে ধরে রাখতে হবেই। আসন্ন নির্বাচনে আমাদের সম্মিলিত শক্তিই পারবে, এই সাফল্যকে ধরে রাখতে। দেশের ৭০ ভাগ লোক অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে উল্লেখ করে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, ৭০ ভাগ লোক যদি যূথবদ্ধভাবে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষে, সংবিধানের পক্ষে, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করি, তাহলে তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছেন তাদের চিহ্নিত করে বর্জন করতে হবে। যারা ঐক্যফ্রন্ট করেছেন এবং যারা নিবন্ধন বাতিলকৃত দলের সঙ্গে গোপনে ঐক্য করছেন, আসন দিচ্ছেন- তাদের মুখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যায় না। তারা কীভাবে মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন? অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যারা ধরে রাখতে চান, তাদের এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াতের কাউকে হত্যা করেনি মন্তব্য করে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার উপরে গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। গ্রেনেড কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র। সেই গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে এ কারণে যাতে শেখ হাসিনার মৃত্যু ঘটে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার একটি চুলও ছিঁড়েছেন? বিরোধী দলের কাউকে কিছু করা হয়েছে? এমনকি খুনী মোশতাকেরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। কারণ বাঙালী সংস্কৃতিতে যারা বিশ্বাসী তারা সন্ত্রাস করে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিও সেইফ। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কেবল আওয়ামী লীগ না সংখ্যালঘুসহ সব ধরনের লোক সেইফ থাকবে না। নির্বাচন কমিশনের সভায় ঐক্যফ্রন্টের সংগঠক মাহমুদুর রহমান মান্নার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের দিকে ইঙ্গিত করে নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, আজকে আমরা দেখছি, যারা গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তারা আবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ধমক দিচ্ছেন, এই দেশেই তো থাকবেন নির্বাচনের পরে। বাংলাদেশেই তো থাকতে হবে। আমরা দেখে নেব। তারা কিন্তু ৫০ শতাংশ নারীর বিষয়ে কিছু বলছেন না। নারীরা নির্বাচনে দাঁড়ালে পোশাকসহ নানা বিষয়ে কথা উঠে। অথচ নারীর সমানাধিকারের বিপক্ষে কোন পরিবেশ এখানে থাকবে না, এমন কথাই আমাদের সংবিধানে ছিল।
×