ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জনগণের সেবা করে যেতে চাই ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জনগণের সেবা করে যেতে চাই ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জনগণের সেবা করার সংকল্প ব্যক্ত করে এই দেশকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চলার পথ কখনই মসৃণ ছিল না, কণ্টকাকীর্ণ ছিল, তবুও আমরা এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। খবর বাসস’র। প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা ‘স্টপিং বাই উডস অন এ স্নোয়ী ইভনিং’ এর দুটি পঙ্ক্তি ‘উডস আর লাভলি, ডার্ক এ্যান্ড ডিপ/ বাট আই হ্যাভ প্রমিসেজ টু কিপ/এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই সিøপ/’ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের মতো করে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই এবং আগামীর বাংলাদেশ হবে সুন্দর, উন্নত ও সমৃদ্ধ।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই আমি এটুকুই বলব, আমি এগিয়ে যেতে চাই যতই অন্ধকার আসুক, ঘন দুর্যোগ আসুক, যতই গভীর হোক জঙ্গল কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতেই হবে।’ তিনি সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ- শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ আসন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা পুনরায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, নির্বাচনে জনগণ যদি ভোট দেয় তাহলে আবার ক্ষমতায় আসবেন। আর যদি নাও আসেন তাহলেও আফসোস নেই। কারণ বাংলাদেশকে যে উন্নয়নের মহাসড়কে তিনি তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন তার থেকে বাংলাদেশকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন জীবনানন্দ দাসের ভাষায় বলেন- ‘আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব, ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। ইনশাআল্লাহ তখন বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করেই আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলায় তাঁর সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে এ সময় বলেন, শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেই তাঁর সরকার স্বাধীনতার সুফলকে জনগণের ঘরে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এর আধুনিকায়নে তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহের উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করব না। যুদ্ধ করতে আমরা চাই না। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের যে সশস্ত্র বাহিনী হবে সেটাকে স্বাধীন দেশের উপযুক্ত হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করব না কিন্তু কেউ আক্রমণ করলে আমরা ছেড়ে দেব না, অন্তত যতক্ষণ আমাদের শ্বাস আছে আমরা প্রতিরোধ করব। সেজন্য আমরা প্রত্যেকটি বাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দেয়া, তাঁদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি এই অল্প সময়ের মধ্যে।’ প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে এবং সকল বাহিনীকে একত্রিত করে এই সশস্ত্র বাহিনী ২১ নবেম্বর গড়ে তোলা হয় সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করি।’ তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর সরকার ‘আর্ম ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রবর্তন করে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী সংবলিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।’ তিনি বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছরে আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ করে যান। সেখান থেকে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মর্যাদাটা ধরে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমাদের সামনে আরও অনেক পথ বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪০ ভাগের ওপর থেকে ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি। এই দারিদ্র্যের হারকে আরও অন্তত পাঁচভাগ নামিয়ে বাংলাদেশকে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলব, ইনশাল্লাহ সে বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করে যাওয়া ‘ল্যান্ড বাউ-ারি’ চুক্তির আলোকে ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের জমে থাকা ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র সীমানা অর্জনেও সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। তিনি মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে সহযোগিতার জন্য কক্সবাজার তথা দেশের জনগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘অনেক উন্নত দেশও যা পারেনি আমরা তা পেরেছি। আমরা মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা নাগরিকদের মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদান করেছি।’ তিনি বলেন, এজন্য তাঁর সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে কোন ঝগড়া বিবাদে না জড়িয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকারও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ জাতির পিতার এই পররাষ্ট্রনীতির আলোকেই দেশ পরিচালনা করে বিভিন্ন আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপেরও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং তিন বাহিনী প্রধানরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সংস্থার প্রধান, উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তা ও তাঁদের সহধর্মিণী, বিদেশী কূটনীতিক এবং পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করেন। বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রিত্বকে জনগণের সেবা করার সুযোগ হিসেবে দেখি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদকে জনগণের সেবা করার সুযোগ হিসেবেই তিনি বিবেচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনা এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ আমার কাছে যতটা না মূল্যবান তার চাইতে এইটা একটা বড় সুযোগ জনকল্যাণের এবং জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সকালে ঢাকা সেনানিবাসে সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের সেবায় এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।’ প্রধানমন্ত্রী বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার-পরিজন এবং মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সেনানিবাসের মাল্টি পারপাস কমপ্লেক্সে এই সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ মাহফুজুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমদ এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত এবং পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর ১০১ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের ঘনিষ্ট পরিবার-পরিজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে এখন উন্নয়নের রোল মডেল এবং এটি একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আজকে আমরা এই সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি এবং বিশ্বের বহু দেশ এখন বাংলাদেশ অনুকরণ করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘এটা আমার কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, মুক্তিযোদ্ধা যারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা দুঃখ-কষ্টে থাকবেন।’ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে সেজন্য তাঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে আমি আমার পদক্ষেপসমূহ অব্যাহত রাখব এবং আপনারা যে কোন সমস্যার কথা আমাকে জানাতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গৃহীত তাঁর সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহের উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলতি অর্থ বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবস ভাতা এবং ২ হাজার টাকা নববর্ষ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০১৮ পাস হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘদিনের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, এখন থেকে সশস্ত্র বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীণের সম্মানী ভাতা পেতে আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।
×