ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনী ইশতেহারে কী চাই?

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচনী ইশতেহারে কী চাই?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ॥ নির্বাচন আসছে, তাই রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনেক খাটাখাটুনি করে তাদের দলের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করবে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে এই নির্বাচনী ইশতেহারে আমি দেখতে চাই- এ রকম দশটি বিষয়ের কথা বলতে তাহলে আমার তালিকাটি হবে এ রকম : ১. মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ : সবার প্রথমে আমি চাইব সব রাজনৈতিক দল যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে খুবই স্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলে। এই দেশে রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের কথা বলে রাজাকার কমান্ডারদের একবার ক্ষমতায় আসতে দেখে আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ’ কথাটির ব্যাপারে অনেক স্পর্শকাতর হয়ে গেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর মুখ থেকে এই কথাটি খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে না শুনলে আমি স্বস্তি অনুভব করি না। একাত্তর সালে আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি যারা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার তারাই একদিন এই দেশের মন্ত্রী হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আর কখনও যেন এ রকম কিছু ঘটতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গড়ে তোলা হবে বলা হলে আসলে অনেক কিছু বলা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে যাই আমরা সব ধর্ম, সব বর্ণ সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে একটা আধুনিক দেশ গড়ে তোলার কথা বলছি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাই আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক দেশের কথা বলছি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছি। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছি। সে জন্য এই তালিকায় প্রথম বিষয়টি সব সময়েই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। ২. বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় কোন্টি জিজ্ঞেস করা হলে অনেকগুলো ঘটনার কথা উঠে আসবে। যার একটি হচ্ছে ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসন দেয়া। ১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়ে গেছে কিন্তু তার স্মৃতিটুকুও যেন এই দেশে না থাকে তার জন্য সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে। রেডিও-টেলিভিশনে তার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কথা না জেনে। অথচ এই মানুষটি এবং বাংলাদেশ আসলে সমার্থক। আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু এই দেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যদি তার জন্ম না হতো আমরা সম্ভবত বাংলাদেশটিকে পেতাম না। বেঁচে থাকতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন, কিন্তু এখন তিনি আর কোন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, সারা বাংলাদেশের সব মানুষের নেতা। কাজেই আমি চাই, এই দেশের সব রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকার করবে। অকৃতজ্ঞ মানুষকে আমরা ঘেন্না করি, তার থেকে শত শত দূরে থাকি। ঠিক একই কারণে অকৃতজ্ঞ রাজনৈতিক দলের জন্য সেটা অন্যরকম হবে কেন? তাদের কাছে অন্যরা কে কী আশা করে আমি জানি না, ব্যক্তিগতভাবে আমি অকৃতজ্ঞ রাজনৈতিক দলের কাছে কিছুই আশা করতে পারি না। ৩. অসাম্প্রদায়িক : বাংলাদেশ গত দশ বছরে অনেক অগ্রসর হয়েছে। সংখ্যা দিয়ে বিচার করতে চাইলে বলা যায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১৭৫২ ডলার, দারিদ্র্য হার কমে হয়েছে ২২ শতাংশ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তৈরি করা পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়ে গেছে ৬০ শতাংশ। বিদেশী পত্র-পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা দেখানোর জন্য খুবই ব্যস্ত তারা প্রায় সময়েই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের রগরগে চটুল তথ্য দিয়ে হেড লাইন করে থাকে। সে রকম একটি সাপ্তাহিকী দ্য ইকোনমিস্ট পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই দেশের উন্নয়ন দেখে আমরা সবাই খুশি। আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে চাইলেই আমরা অনেক দ্রæত দেশকে উন্নত করে ফেলতে পারব। কিন্তু আমাদের সমস্ত আনন্দ এবং উৎসাহ মাঝে মাঝেই ছোট একটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা দেখে পুরোপুরি ম্লান হয়ে যায়। যত সময় যাবে আমাদের হৃদয়ের প্রসারতা তত বাড়ার কথা, আমাদের তত উদার হওয়ার কথা। কিন্তু যখন দেখি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা কমেনি বরং বেড়েছে তখন আমরা খুবই অসহায় বোধকরি। আমি সব সময়েই বলে এসেছি একটা দেশ ভাল চলছে না খারাপ চলছে সেটি জানার জন্য বড় বড় গবেষণা করতে হবে না, সেমিনার কিংবা গোলটেবিল বৈঠক করতে হয় না। দেশের একজন সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী মানুষকে জিজ্ঞেস করতে হয়। তারা যদি বলে দেশটি ভাল চলছে তাহলে বুঝতে হবে দেশটি আসলেই ভাল চলছে। যদি তারা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহলে বুঝতে হবে দেশটি ভাল চলছে না। এই দেশে এখনও মানুষে মানুষে বিভাজন রয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর আগে আমি একটা দলিত শিশুদের সমাবেশে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি ফুটফুটে শিশুদের কাছে শুনেছিলাম তারা সেই এলাকায় অস্পৃশ্য। পানি খাওয়ার জন্য একটা গ্লাসকে পর্যন্ত তারা স্পর্শ করতে পারে না। কাজেই আমি চাইব, নির্বাচনী ইশতেহারে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে যে দেশের সব মানুষের ভেতর থেকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা দূর করে সবাইকে নিয়ে আধুনিক একটা বাংলাদেশ তৈরি করা হবে। ৪. নারী-পুরুষ সমতা : আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কী, আমি সব সময়েই তার উত্তরে বলে থাকি যে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এখানে সব ক্ষেত্রে ছেলেরা এবং মেয়েরা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বরং মেয়েদের সংখ্যা একটু বেশি, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের লেখাপড়ার মান ভাল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যখন বইপড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেখানে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক মেয়েদের খেলাতেও মেয়েরা অনেক ভাল করছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে দেখা যায় ছেলেদের সংখ্যা থেকে মেয়েদের সংখ্যা কম। কারণ তখন বাবা-মায়েদের ধারণা হয় ভাল একটা পাত্র দেখে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলা দরকার। মেয়েরা যে শুধু লেখাপড়ার সব জায়গায় আছে তা নয়, গার্মেন্টস শ্রমিক প্রায় সবাই মেয়ে এবং তারা আমাদের অর্থনীতিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে ক্যারিয়ার বলে একটা নিষ্ঠুর শব্দ আছে। যে কোন পর্যায়েই এই ক্যারিয়ারের প্রতিযোগিতায় পুরুষের কাছে মেয়েরা হেরে যায়। কারণ যখন ক্যারিয়ার গড়ার সময় সেটি সন্তান জন্ম দেয়ার সময় সন্তানকে বড় করার সময়। পুরুষ মানুষ অনেক কিছু করতে পারলেও সন্তান জন্ম দিতে পারে না সন্তানের মা হতে পারে না। কাজেই রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে নারীদের এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। যেখানে মেয়েরা কাজ করে সেখানে চমৎকার ডে কেয়ার গড়ে তুলতে পারে। সেটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিই হোক আর বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক। যদি মায়েরা জানে তার শিশু-সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার একটা জায়গা আছে তাহলে তাদের জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনকালীন সময়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে একটা শব্দ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে, তাহলে পুরুষ এবং নারীর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ব্যাপারে কেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না? মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়ার বেলায় বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছে। তাহলে মায়েদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার বেলায় আমাদের দেশ কেন এগিয়ে থাকবে না? কাজেই নির্বাচনী ইশতেহারে আমি নারী-পুরুষের মাঝে সমতা আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝ থেকে এ রকম একটি অঙ্গীকার দেখতে চাই। ৫. জ্ঞানভিত্তিক দেশ : প্রথম যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছিল তখন অনেকেই ভ্রু কুচকে তাকিয়েছিল এবং বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। কিন্তু এখন মোটামুটি সবাই বিষয়টা গ্রহণ করেছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে উদ্যোক্তা নেয়ার কারণে অনেক কিছু ঘটেছে, যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঘটা সম্ভব ছিল না। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয় তখন দেশের মানুষের কথা আলাদাভাবে বলা হয় না, কিন্তু যদি এর পরের ধাপ হিসেবে আমরা জ্ঞানভিত্তিক দেশের কথা বলি তখন কিন্তু আমরা দেশের মানুষের কথা বলি। আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সব মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ কোটি। যদি এদের সবাইকে ঠিকভাবে লেখাপড়া করানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে সে রকম দেশ আর কয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? আমরা সবাই দেখেছি এই দেশের একেবারে সাধারণ মানুষটিও কিন্তু লেখাপড়ার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছে। লেখাপড়ার মান নিয়ে আমরা এখনও সন্তুষ্ট নই, কিন্তু যদি লেখাপড়ার মানটুকু বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে জোর দিয়ে বলা যাবে আমাদের দেশটিকে জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সব উপাদান আছে। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এখনও এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের শরীরের ঘাম। তাদের পাশে যদি মেধা নিয়ে নতুন প্রজন্ম দাঁড়াতে শুরু করে তাহলেই আমরা জ্ঞানভিত্তিক দেশের স্বপ্নে পা দিতে শুরু করব। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আশা করতেই পারি তারা আমাদের দেশকে জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাবে। ৬. শিক্ষায় জিডিপির চার শতাংশ : বাংলাদেশ ডাকার সম্মেলনে অঙ্গীকার করেছিল যে তারা দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ খরচ করবে। এখন বাংলাদেশ খরচ করছে ২.৫ শতাংশ থেকেও কম। আমি সব সময়ই বলে থাকি লেখাপড়ার পেছনে এত কম টাকা খরচ করে পৃথিবীর আর কোন দেশ এত ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করানোর কথা চিন্তাও করতে পারবে না! আমরা ইচ্ছা করলে তো দাবি করতেই পারি যে, যতটুকু অস্বীকার করা হয়েছিল, ততটুকু খরচ করতে হবে কিন্তু তাহলে হয়ত আমাদের দাবিটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই মুহূর্তে যেটুকু খরচ করা হচ্ছে তার দ্বিগুণ চাইতেও বেশি কেমন করে চাই। তাই আমার মনে হয়, আমরা আপাতত নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য জিডিপির চার শতাংশ চাইতে পারি! যারা বাজেট করেন তাদের বিশ্বাস করতে হবে শতাংশ পড়ার পেছনে যদি এক টাকাও বাড়তি খরচ করা হয়, তাহলে সেটারও একটা ফল পাওয়া যায়। তার কারণ, লেখাপড়ার পেছনে যে টাকা খরচ করা হয় সেটি মোটেও খরচ নয়, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ। ৭. সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা : কেন সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নেয়া উচিত সেটি নিশ্চয়ই নতুন করে কাউকে বোঝাতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষার নামে ছেলেমেয়েদের এমন একটি নিষ্ঠুরতার ভেতর দিয়ে নেয়া হয় যেটি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেটি লক্ষ্য করেছেন এবং একাধিকবার সব ভাইস চ্যান্সেলরকে ডেকে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেছেন। গত বছর সেটি নেয়া সম্ভব হয়নি। আমি ভেবেছিলাম এই বছর নিশ্চয়ই সেটি হবে কিন্তু আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি যে এই বছরেও কেউ এটি নিয়ে কথা বলছে না! সত্যি কথা বলতে কী এই বছর অবস্থা আগের থেকে খারাপ। আগে যে পরীক্ষাটি একবার নেয়া হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কারণে এবার সেই পরীক্ষা দুইবার নিতে হয়েছে। কেমন করে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করব জানি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অঙ্গীকার এই দেশের তরুণ প্রজন্ম এবং তাদের বাবা মা এক বাক্যে লুফে নেবে। কাজেই নির্বাচনী ইশতেহারে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অঙ্গীকার করে তরুণ প্রজন্মকে খুব সহজে উৎসাহী করা সম্ভব বলে আমি মনে করি! ৮. সাইকেল লেন : বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম। বিশেষ করে যারা ঢাকা শহরের বাইরে থাকে তারা যদি ঢাকায় এসে একবার ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণাটা অনুভব করে, তাহলে সাধারণত তার ঢাকা আসার সাধ জন্মের মতো মিটে যায়। ঢাকা শহরে নানা মিটিংয়ের জন্য আমাকে প্রায়ই আসতে হয়, আমি একটা বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করেছি। ঢাকা শহরে কোথাও আমি সময়মতো যেতে পারি না। বেশি সময় নিয়ে রওনা দেয়ার পরও ঠিক সময় পৌঁছতে পারি না। কিংবা বেশি সময় হাতে নিয়ে রওনা দেয়ার কারণে অনেক আগে পৌঁছে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাই। সোজা কথায় বলা যায় কতটুকু দূরত্ব কত সময়ে পৌঁছানো যাবে সে দুটির মাঝে কোন সম্পর্ক নেই! এ কারণে ঢাকার মানুষজনের যে কী পরিমাণ সময় নষ্ট হয় তার কোন হিসেব নেই। সেই সময়টাকে যদি টাকা দিয়ে বিবেচনা করা যায় আমার ধারণা, তাহলে আমরা প্রতিমাসে একটা করে পদ্মা সেতু তৈরি করে ফেলতে পারব। আমার ধারণা, এর একটা খুব সহজ সমাধান আছে, সেটা হচ্ছে সাইকেলে যাতায়াত করা। আমাদের নতুন একটা আধুনিক প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সাইকেলে যেতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। শুধু তাই নয়, স্কুলের অনেক ছেলেমেয়েও সাইকেলে করে স্কুলে যাবে। এখন যেতে পারে না। শুধু একটি কারণে, সেটা হচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও নিরাপদ নয়। যে রাস্তায় দৈত্যের মতো বড় বড় বাস-ট্রাক-গাড়ি একজনের সঙ্গে আরেকজন প্রতিযোগিতা করে ছুটে যাচ্ছে, সেই রাস্তায় কে সাইকেলে যেতে সাহস পাবে? কিন্তু যদি রাস্তার এক পাশে ছোট একটি লেন তৈরি করে কংক্রিটের বøক দিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়, তাহলে সবাই সেই পথে যেতে পারবে। আমার এই কথাগুলো মোটেও আজগুবি কথাবার্তা নয়। পৃথিবীর অনেক বড় শহরে সাইকেলযাত্রীদের জন্য আলাদা পথের ব্যবস্থা করে রাখা আছে। আজকাল শুধু যে সাইকেলের পথ তৈরি হয়েছে তা নয়, সাইকেল ভাড়া করার জন্য একটু পরে পরে সারি সারি সাইকেল রাখা আছে, কাউকে আর সাইকেল কিনতেও হয় না। তাই আমি মনে করি, নির্বাচনী ইশতেহারে যদি সব বড় শহরে সাইকেলের আলাদা লেন তৈরি করে দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়, নতুন প্রজন্ম অনেক আগ্রহ নিয়ে সেটি গ্রহণ করবে। ৯. সোশ্যাল নেটওয়ার্কের অভিশাপ থেকে মুক্তি : আমি এখন যেটা বলেতে চাইছি সেটি সবাই মানতে রাজি হবেন কী না আমি জানি না। কিন্তু আমি যেহেতু আমার নিজের পছন্দের কথা বলছি, অন্যরা রাজি না হলেও খুব ক্ষতি নেই। আমি জানি না সবাই এটি লক্ষ্য করেছে কী না, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, যে পরিবর্তনটি ভাল নয়। ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা সাংঘাতিকভাবে কমে এসেছে। এটি শুধু যে, আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ঘটেছে তা নয়, সারা পৃথিবীর সব দেশের ছাত্রছাত্রীদের বেলায় এটা ঘটেছে। এর কারণটিও এখন আর কারও অজানা নয়, সেটা হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নামক বিষয়টির প্রতি আসক্তি। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে সারা পৃথিবীটি এখন দুটি জগতে ভাগ হয়ে গেছে, একটি হচ্ছে রক্ত মাংসের বাস্তব জগত, আরেকটি ইন্টারনেটের পরাবাস্তব জগত। ইন্টারনেটের জগতে একেবারে তুলকালাম ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব জগতের কেউ সেটি সম্পর্কে কিছু জানে না, সেটি এখন এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত না থেকে আক্ষরিক অর্থে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। সে রকম মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। সাধারণ মানুষজন হয়ত খুব বেশি জানে না কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি জগতের বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে সেগুলো হয়ত আমরা নিজেরাই জানি না। তথ্য এখন সোনা থেকেও দামী এবং আমরা না জেনে আমাদের সমস্ত তথ্য ভান্ডার বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছি। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে যেটি ফ্রি সার্ভিস মনে হচ্ছে সেটি যে ফ্রি নয় এবং একবার আমাদের ভাল করে হাতে পেয়ে নিলে হঠাৎ করে গুগল ফেসবুক, মাইক্রোসফট, এ্যামাজন বা এ্যাপলের মতো বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমাদের সর্বস্ব সুদে আসলে তুলে নেবে না আমরা সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি না। সারা পৃথিবীতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আমরা কোথায় আছি এবং কোথায় যাব সেটি কেউ ভাল করে জানে না। কিন্তু বোঝার আগে আমরা হয়ত আবিষ্কার করব আমরা অন্যের হাতের পুতুল হয়ে বসে আছি। তাই আমি চাই, নির্বাচনী ইশতেহারে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকুক। পরিবর্তনশীল এই নাজুক পৃথিবীতে পৃথিবীর বড় তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের পুরোপুরি কব্জা করে ফেলার আগে আমাদের যেন নিজেদের রক্ষা করার একটা পথ খোলা থাকে। সেই সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্ত ছেলে মেয়েদের রক্ত-মাংসের জগতে ফিরিয়ে আনার একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে। ১০. বাকস্বাধীনতা : আমি জানি বাকস্বাধীনতা কথাটি খুব বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ, অনেক বার দেখেছি ঠিক কোথায় বাকস্বাধীনতা খিস্তি খেউর গালাগাল হয়ে যাচ্ছে সেটা অনেকেই জানে না। সামনা-সামনি অনেকেই একে অন্যকে গালমন্দ করে না, কিন্তু ইন্টারনেটের পরাবাস্তব জগতে খুব সহজেই একজন অন্যজনকে তুলোধোনা করে ফেলে। এই সবকিছুর পরেও আমি মনে করি একজনের বাকস্বাধীনতা থাকুক, বাড়াবাড়ি করে ফেললে সেটাকেও প্রতিবাদ করার ব্যবস্থা থাকুক কিন্তু মন খুলে কথা বলা নিয়ে সবার ভেতরে যদি একটা আতঙ্ক কাজ করে তাহলে সেটি ভাল কথা নয়। আমার মনে হয়, আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ৫৭ ধারাটি সবার মাঝে এক ধরনের ভীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেটে খিস্তি খেউর হয়ত করেছে কিন্তু অনেক জায়গাতেই মানুষজন তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জানাতে ভয় পেতে শুরু করেছে। এটি আমরা কখনই চাই না। ৫৭ ধারার বাক্যগুলো খুবই ঢিলে ঢালা, ইচ্ছে করলেই যে কোন মানুষের যে কোন কথাকে ব্যবহার করে তাকে বিপদে ফেলে দেয়া যাবে। এই হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারে আমি কী দেখতে চাই সে রকম দশটি বিষয়ের তালিকা। দেখাই যাচ্ছে এটি কোনভাবেই পূর্ণাঙ্গ নয় এবং আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাই ঘুরে ফিরে সেগুলোই এসেছে কিন্তু ক্ষতি কী? এটাই তো বাকস্বাধীনতা আমার যেটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা বলছি! সবাইকে সেটা শুনতে হবে কিংবা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে? ২১.১১.২০১৮
×