ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশে উৎপাদনের পাশাপাশি রফতানিও হচ্ছে

মোটরসাইকেল খাতে বিনিয়োগ আড়াই হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২১ নভেম্বর ২০১৮

 মোটরসাইকেল খাতে বিনিয়োগ আড়াই হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বড় হচ্ছে মোটরসাইকেলের বাণিজ্য। খাতটিতে বর্তমানে বিনিয়োগ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। দেশীয় ব্র্যান্ড রানারসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের মোটরসাইকেল এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। সম্প্রতি চালু হয়েছে হোন্ডার কারখানা। আগামী বছরেই উৎপাদনে আসছে টিভিএস। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে খাতটি হেঁটে চলছে স্বনির্ভরতার পথে। এসবের প্রভাবে দেশীয় বাজারে মোটরসাইকেলের দাম কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ। বিক্রিও বেড়েছে। আর গত তিন বছরে খাতটির প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরেও রফতানি হচ্ছে মোটরসাইকেল। ২০১৭ সালে প্রতিবেশী দেশ নেপালে প্রায় ১ হাজার মোটরসাইকেল রফতানি করে রানার। রফতানির প্রক্রিয়া চলছে ভুটান ও আফ্রিকায়। খাত সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট দু’টি সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে, এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার প্রভাবে নগরী ঢাকায় বাড়ছে মোটরসাইকেলের আধিক্য। এতে নতুন করে হচ্ছে অনেকের কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। রাইড (মোটরসাইকেল) শেয়ারিংয়ের শীর্ষে থাকা পাঠাও’য়ে বর্তমানে নিবন্ধিত রাইডারের (চালক) সংখ্যা এক লাখের বেশি। এছাড়াও উবার, ওভাই ও স্যামসহ রয়েছে একাধিক এ্যাপ। আর এসব সেবার প্রভাবে বাজারে বাড়ছে মোটরসাইকেলের বিক্রিও। পাঠাওসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। শিল্প হিসেবে মোটরসাইকেল এখনও পুরোটা আমদানি-নির্ভর। বাজারের ৮০ শতাংশ এখনও আমদানিকারকদের দখলে। দেশীয় ব্র্যান্ড রানারকে বর্তমানে এই শিল্পের অগ্রদূত বলা চলে। ২০১০ সালে দেশেই মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরুর পর এ প্রতিষ্ঠানটি খাতটিকে এগিয়ে নিচ্ছে। একইসঙ্গে যোগ দিয়েছেন মোটর শিল্পের অন্যান্য উদ্যোক্তারাও। দেশেই এখন কারখানা গড়ে উঠছে নামীদামী সব ব্র্যান্ডের। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রানারের পর উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে উত্তরা মোটরস ও হিরো। সম্প্রতি চালু হয়েছে হোন্ডার কারখানা। ফলে দেশেই এখন উৎপাদন হবে প্রতিষ্ঠিত এই ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল মোমেন অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি থেকে বছরে এক লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। ভবিষ্যতে তা দুই লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য তাদের। বাংলাদেশ অটোমোবাইলস এ্যাসেম্বলার্স এ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএএএমএ) সভাপতি হাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘সম্প্রতি দেশের মোটরসাইকেল শিল্পে বেশ উন্নয়ন হয়েছে। গত তিন বছরে অন্তত ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠায় সবাই দাম কমাচ্ছে। দাম কমেছে অন্তত ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ। গতবছর সাড়ে তিন লাখের মতো মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। এ বছর তা চার লাখ হতে পারে।’ বাংলাদেশ মোটরসাইকেল এ্যাসেম্বলার্স এ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, ‘সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগে খাতটি এখন এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাড়ার আরও সম্ভাবনা রয়েছে।’ উত্তরা মোটরসের এই কর্ণধার আরও বলেন, ‘দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন হওয়ায় দাম কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। গতবছর ৩ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হলেও আগামী বছরে তা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০২০ সালে মোটরসাইকেল বিক্রির পরিমাণ ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০২৭ সালে তা ১০ লাখে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খাতটিতে বর্তমানে ১০ হাজার মানুষ জড়িত থাকলেও কয়েক বছরের মধ্যেই এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’ তবে এ্যাটলাস বাংলাদেশ লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের কোন প্রতিষ্ঠানই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখনও বাইরে থেকে মোটরসাইকেল আমদানি হচ্ছে, এ সংখ্যা ৫ লাখ হতে পারে। আর যারা উৎপাদনে আছে, তারা মোটরসাইকেলের কিছু অংশ উৎপাদন করে। অনেক ক্ষেত্রে হয়ত ১০ শতাংশ। মোটরসাইকেলে হাজার থেকে ১২শ’ পার্টস রয়েছে। দেশের কেউ ইঞ্জিন উৎপাদন করতে পারে না।’ ২০১০ সালে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে মোটরসাইকেল প্রস্তুত শুরু করে রানার। ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি মোটরসাইকেল প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে রফতানি করে। বছরটিতে প্রতিবেশী দেশ নেপালে ১ হাজার মোটরসাইকেল রফতানি করে তারা। বর্তমানে ভুটানেও রফতানির প্রক্রিয়া চলছে। সে দেশে প্রথম ধাপে ৮৬টি মোটরসাইকেল রফতানির লক্ষ্য রয়েছে। মোটরসাইকেল রফতানিতে প্রতিষ্ঠানটির কথা চলেছে আফ্রিকাতেও। আর রফতানির ক্ষেত্রে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে রানার। বর্তমানে বাজারে যত মোটরসাইকেল বিক্রি হয়, তার ১৫ শতাংশ রানারের দখলে। তবে, সর্বশেষ ২০১৭ সালে তাদের বাজার শেয়ার ছিল ১১ শতাংশ। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির বাজার প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ। এদিকে, দেশে আমদানি করা মোটরসাইকেলের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে বাজাজ, টিভিএস, হিরো, হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি ও মাহিন্দ্রা। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদন কাজ শুরু করেছে। শীঘ্রই দেশে তৈরি এসব ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলও বাজারে মিলবে। প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর বাইরে আরও কিছু চীনা ও ভারতীয় ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল দেশে আসে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় উৎপাদকেরা ইঞ্জিন বাদে সব উপকরণই দেশে তৈরি করেন। আর আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশেই ইঞ্জিন উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। খুচরা মোটরসাইকেল বিক্রির ক্ষেত্রে নগরীর ইস্কাটন রোড একটি প্রসিদ্ধ নাম। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছোট বড় দোকান রয়েছে এখানে। নাহার এন্টারপ্রাইজ তার মধ্যে একটি। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) এ বি এম ফিরোজ বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে আমাদের বিক্রি বাড়ছে। ২০১৬ সালে আমরা দেড় হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি করেছি। ২০১৭ সালে সেই বিক্রির পরিমাণ ৩ হাজার ৩০০টি। আর চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই বিক্রি সাড়ে তিন হাজার পেরিয়ে গেছে।’ ফিরোজ জানান, এ্যাপভিত্তিক পরিবহন আসার পর হিরোসহ কয়েকটি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের বিক্রি বেড়েছে। রয়েল মোটরস, ইউনিভার্স মোটরসসহ ইস্কাটনের আরও কয়েকটি দোকানের সঙ্গে কথা বলেও একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ। খোদ রাজধানীতেই এখন এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ছুঁই ছুঁই। আর চলতি বছরের প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে মোটরসাইকেল নামছে অন্তত ২৬৭টি। আগের বছরেও যে সংখ্যা ছিল দুইশ’র ঘরে। এসব তথ্যই বলে দিচ্ছে, নগরীতে বাড়ছে মোটরসাইকেলের আধিক্য। আর এ তথ্য স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরাও। বহুল প্রচলিত এ যানটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানজট ও দুর্ঘটনা। তবে সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য স্বীকার না করে বলছেন, মোটরসাইকেলই একমাত্র যানজটের কারণ নয়। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদশেও রাইড শেয়ারিংয়ের ধারণা নিয়ে শুরু হয় এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা। ২০১৬ সালের নবেম্বরে দেশে যাত্রা শুরু করে উবার। ধীরে ধীরে পাঠাওসহ এসেছে একাধিক এ্যাপ। হাতের মুঠোয় পরিবহন পাওয়ায় জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস আসে নগরবাসীর। পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলে ভর করে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক তরুণের। এতে নগরীতে বেড়ে গেছে মোটরসাইকেলের বিক্রিও। এ প্রসঙ্গে পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসেইন এম ইলিয়াস বলেন, ‘পাঠাও বহুসংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। এক বছর আগেও যেখানে ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল তিন লাখের কাছাকাছি, বর্তমানে এ সংখ্যা ৫ থেকে ৬ লাখ। পাঠাওয়ে যুক্ত হতে এখন অনেকে মোটরসাইকেল কিনছে।’ একই বিষয়ে উত্তরা মোটরস’র চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, ‘এ্যাপ আসার পরে অনেকে মোটরসাইকেল কিনছে। ফলে বাজারে বিক্রিও বেড়েছে। তবে যতটা দেখা যাচ্ছে বা বলা হচ্ছে, ততটা নয়।’ কেবল ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরসাইকেলই বাড়ছে তা নয়, আশপাশের নিবন্ধিত মোটরসাইকেলও নগরীতে ঢুকছে। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানেই মোড়ে মোড়ে যাত্রীদের ডাকতে দেখা যায় কথিত এ্যাপ সার্ভিসের বাইকওয়ালাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত্রতত্র যেখানে সেখানে যেনতেন রাইডারের কারণে কমছে রাইড শেয়ারিংয়ের মান। বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এমন এক প্রশ্নের উত্তরে পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসেইন এম ইলিয়াস বলেন, ‘এ্যাপের বাইরে গিয়ে ডেকে যাত্রী তোলার পেছনে রাইডারদের মানসিকতা দায়ী। এমন রাইডারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে পাঠাও তাদের নিবন্ধন বাতিল করবে।’ এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী মাহিন রহমান। ৬ মাস আগে যুক্ত হয়েছেন পাঠাওয়ে। এরই মধ্যে বদলে গেছে তার জীবনের পথচলা। আগে যেখানে গল্প আড্ডায় কেটে যেত তার বিকেলের পুরোটা সময়, এখন ‘আড্ডা এড়িয়ে’ মাসে তার আয় ২০ হাজার টাকা। বসুন্ধরার বাসিন্দা মাহিন বলেন, ‘এখন ক্লাস শেষে বাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। এতে মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আর এ টাকা দিয়েই লেখাপড়া ও হাত খরচের বড় একটি অংশ মেটানো সম্ভব হচ্ছে।’ মাহিন আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, হাত খরচের জন্য আগে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতে হতো। এখন তা নিতে হচ্ছে না। বরং পরিবারেও কিছুটা কন্ট্রিবিউট করতে পারছি।’ একই ধরনের কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে কিস্তিতে মোটরসাইকেল কিনেছি। আগে শুধু টিউশনি করতাম। এখন টিউশনির পাশাপাশি এ্যাপে মোটরসাইকেল চালাই।’ আগের চেয়ে এতে তার আয় বেড়েছে বলেও জানান তিনি। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসে পাঠাওয়ে যুক্ত হয়েছেন ইব্রাহিম সুমন (৩০)। তিনি বলেন, ‘স্ট্রোক করে বাবা প্যারালাইজড। আগে দর্জির কাজ করতাম।
×