ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইসি সচিব

বিএনপির অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া যায় না

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২১ নভেম্বর ২০১৮

  বিএনপির অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা  নেয়া যায় না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বয়ং নির্বাচন কমিশন সচিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এবার ইসিতে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছাড়াও ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপকমিশনার এবং কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২) এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে তাদের ব্যবস্থা গ্রহণে আইনের আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হব বলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিএনপির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ চলাকালে আচরণবিধি প্রতিপালনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইসি সচিবের একটি চিঠি পুলিশকে দেয়ার পরই নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির এই চিঠির প্রেক্ষিতে ইসি সচিব সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির ঢালাও অভিযোগের ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তাদের এসব অভিযোগ আমলেও নেয়া হবে না। তবে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে বলে ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সচিব ইসির মুখপাত্র। তার আলাদা কোন সত্তা নেই। কমিশন যে সিদ্ধান্ত নেয় ইসি সচিব তা বাস্তবায়নে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে মাত্র। মঙ্গলবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এ সংক্রান্ত চিঠি ইসি সচিবের কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়া ইসি সচিবের বদলি, মাঠ প্রশাসনে রদবদল, দেশের ৪৫ জেলায় সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাদের মেন্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আদেশ বাতিলসহ ৯ দফা দাবি জানিয়ে আলাদা চিঠিও কমিশনে পৌঁছে দেন বিএনপির এই নেতা। পরে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিকদের বলেন, এখন আমরা যে অবস্থায় রয়েছি, তা হচ্ছে পর্বতের গিরিখাতে। আর ক্ষমতাসীন দল পর্বতের শৃঙ্গে। ইসিকে সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। রেফারির যা করার কথা, সরকারের পক্ষ নিয়ে তা করছেন খেলোয়াড়রা। ইসি নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ নম্বেবর দলীয় মনোনয়ন বিতরণকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের সামনে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীরা পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া ছাড়াও ভাংচুর ও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার আগে ইসির পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য চিঠি দেয়া হয়। পল্টনে সহিংস ঘটনার পর থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিক মামলা করা হয়েছে। মামলায় এখনও গ্রেফতার অভিযান চলছে। এই মমলায় এখন পর্যন্ত ৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্প্রতি পল্টন ঘটনার প্রতিবেদন চেয়ে পুলিশের কাছে চিঠি দেয় ইসি। গত রবিবার এই ঘটনার প্রতিবেদন ইসিকে দেয়া হয়। ঘটনা পর্যালোচনা করতে গত সোমবার কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পল্টনের ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত করতেও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় ইসি। ইসির এই নির্দেশনা দেয়ার পরদিন মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে বিভিন্ন অভিযোগ ও দাবির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে ইসি ব্যবস্থা না নিলে আদালতে যাওয়ার হুমকিও চিঠিতে দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, ইসি আচরণবিধি মানার নামে একটি চিঠি দিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে বিঘœ সৃষ্টি এবং নিরপরাধ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে ইন্ধন জুগিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর সরকারী দল ৯ নবেম্বর থেকে ১২ নবেম্বর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে মনোনয়নপত্র বিতরণ করে। এ সময় তাদের নিজেদের প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষে দুজনের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এই ঘটনায় পুলিশের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু আচরণবিধির খ—গ নেমে আসে বিএনপির ওপর। ইসি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিকে আচরণবিধির লঙ্ঘন বলে চিহ্নিত করে। ১৩ নবেম্বর এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা ডিএমপিকে চিঠি দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি অফিসের সামনে সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, সন্ত্রাসী ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় ৪৭২ জনকে আসামি, ৭০ জনকে গ্রেফতার ও ৩৮ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। চিঠিতে ইসি সচিবের শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, নয়া পল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ইসি সচিব ও ডিএমপি কমিশনারের ‘ইন্ধন’ রয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয় ইসির আচরণবিধি প্রতিপালনের নির্দেশনা নেতাকর্মীসহ জনগণের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের গণমাধ্যমে দেয়া বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ও ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার বক্তব্যে ঘটনা সংঘটনের ইন্ধনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় ইসি সচিব, ডিএমপি কমিশনার, সংশ্লিষ্ট জোনের উপকমিশনার ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে জারি করা চিঠির স্বাক্ষরকারী ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার যুগ্মসচিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি। বিএনপির অপর একটি চিঠিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে সব বিভাগীয় কমিশনার, উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (রেঞ্জ ডিআইজি), মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। অপর এক চিঠিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিদের বর্তমান কর্মস্থল জেলার বাইরে বদলি করার দাবি জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব এবং পুলিশ সদর দফতরের মাঠ প্রশাসনে বদলি করতে হবে। নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পদে পদায়ন ও বদলিতে সিনিয়রিটি ও মেধাক্রম অনুসরণ করতে হবে। সব বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারদের প্রত্যাহার করে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদায়ন করতে হবে। ডিসি-এসপি ও মেট্রোপলিটন এলাকায় উপপুলিশ কমিশনার পদে দুই বছরের বেশি দায়িত্ব পালনকারীদের প্রত্যাহার ও বদলি করতে হবে। ডিসি পদায়নে ফিট লিস্ট তৈরি এবং ইউএনও ও ওসিদের বর্তমান কর্মরত জেলার বাইরে বদলি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন বা আছেন এবং মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী/উপমন্ত্রী/উপদেষ্টাদের পিএস ও এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন করা যাবে না। পক্ষপাতমূলত আচরণকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান এবং জেলা প্রশাসনে অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপদেষ্টা (মেন্টর) মনোনয়ন সংক্রান্ত আদেশ বাতিল করতে হবে। ইসিতে দেয়া বিএনপির আর একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও কর্মীসমর্থকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সব অপকৌশল হিসেবে এ ভীতির সঞ্চার করে এ ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা বন্ধ করতে হবে। কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত হলে এর দায় ইসির ওপর বর্তাবে। চিঠিতে বিএনপি আরও অভিযোগ করেছে তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে ‘ব্রিফিং’ করা হয়েছে। গত ১৩ নবেম্বর এসব কর্মকর্তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তলব করা হয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে বলে বিএনপির প্রেরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগের জবাবে ইসি ॥ বিএনপির অভিযোগের বিষয়ে ইসি সচিব মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা বলেন। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, সারাদেশে সচিব মর্যাদার ৪৫ মেন্টর নিয়োগ সংক্রান্ত আদেশ ১৩ নবেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্থগিত করেছে। জেলা প্রশাসনে মেন্টর নিয়োগ পূর্ব প্রচলিত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এটা রুটিন কাজ। আদেশটি কমিশন অবহিত নয়। ৮ নবেম্বর আদেশটি করেছিল, ১৩ নবেম্বর স্থগিত করেছে। এ সময় তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ব্রিফিং করার বিষয়টি কমিশন অবহিত নন বলে উল্লেখ করেন। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে যাতে কোন ধরনের বৈঠক না করা হয় সেজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয়া হবে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার কমিশন একটি নির্দেশনা দিয়েছে। সব বিষয় মিলিয়ে সরকারকে একটা পত্র দেব। সিদ্ধান্ত হয়েছে ভবিষ্যতে যাতে পত্রপত্রিকায় যেসব অভিযোগ আছে তা যেন আর না করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের অধীন হওয়ায় তাদের যাতে অন্য কোনভাবে কেউ ডেকে সভা না করে, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক, ডিআইজিসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা নিয়ে অভিযোগ ও রদবদলের বিষয়টি ঢালাওভাবে আমলে নেয়া হবে না। ঢালাও রদবদল প্রস্তাব ইসি গ্রহণ করবে না। অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হতে হবে। কেবল সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে দেয়া অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে উল্লেখ করেন। বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনাররা নিজেরা বসে নিয়েছেন। এখানে কোন চাপ বা পরামর্শে সিদ্ধান্ত হয়নি।
×