ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় ডুবে যায় বাড়িঘর ফসল

কুমিল্লায় নদীর মাটি লুটে ১০ সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২১ নভেম্বর ২০১৮

কুমিল্লায় নদীর মাটি লুটে ১০ সিন্ডিকেট

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খর¯্রােতা কাঁকড়ি নদীটি উপজেলার কাশিনগর এলাকায় এসে পুরাতন ডাকাতিয়া ও নতুন ডাকাতিয়া নদী নাম ধারণ করে একটি শাখা ছোট ফেনী নদীর সঙ্গে ও অপর একটি শাখা বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশে গেছে। এ বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই চৌদ্দগ্রাম অংশে ডাকাতিয়া ও কাঁকড়ি নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট থেকে মাটি কেটে ট্রাক-ট্রাক্টর যোগে ইটভাঁটিসহ বিভিন্নস্থনে বিক্রি করছে অন্তত প্রভাবশালী ১০টি সিন্ডিকেট। এভাবে প্রতিবছরই মাটি বিক্রি করে প্রভাবশালীরা লাভবান হলেও বর্ষা মৌসুমে প্রতিবারই বিভিন্নস্থানে ভাঙ্গে নদী রক্ষা বাঁধ, তলিয়ে যায় নদীপাড় ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষের বাড়িঘর ও ফসলি জমি। সরকার লাখ-লাখ টাকা খরচ করে নদী রক্ষা বাঁধ মেরামত করলেও বাঁধ-চরের ওই মাটি বিক্রি করে কেউ-কেউ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। আর বর্ষা মৌসুম এলে নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হন পাড়ের নিরীহ মানুষ। জানা গেছে, খরস্রোতা কাঁকড়ি নদীর উৎপত্তিস্থল সংলগ্ন জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ২নং উজিরপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর, চকলক্ষ্মীপুর, আশ্রাফপুর পয়েন্টে কাঁকড়ি নদী রক্ষা বাঁধ-চরের মাটি দীর্ঘদিন ধরে কেটে অন্যত্র বিক্রি করছে কৃষ্ণপুর গ্রামের রিপনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট। কাঁকড়ি নদীর উত্তর যাত্রাপুর, রামপুর পয়েন্টে দলিলুর রহমান, অলিপুর পয়েন্টে মনির হোসেন, রবিউল, ফয়েজ মিয়া, কাঁকড়ি-ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল কাশিনগরের তিন গাঙ্গের মুখ ও ব্রিজের উত্তরে আমির হোসেন মেকারের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট, মরা ডাকাতিয়া নদীর হিলালনগর-বারইয়া থেকে উত্তর ধর্মপুর পর্যন্ত মাঝামাঝি স্থানে দুটি পয়েন্টে আলমগীর হোসেন ও জালালের নেতৃত্বে পৃথক দুটি সিন্ডিকেটসহ কাঁকড়ি ও ডাকাতিয়া নদীর ২০টি পয়েন্ট থেকে কমপক্ষে ১০টি প্রভাশালী সিন্ডিকেট চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে শ্রমিক লাগিয়ে ও মাটি কাটার ভারি মেশিনের সাহায্যে নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের মাটি কেটে ট্রাক-ট্রাক্টরযোগে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। কাশিনগরের তিন গাঙ্গের মুখ ও ব্রিজের উত্তরে আমির হোসেন মেকারের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট মাটি কাটার ৫টি মেশিনের সাহায্যে মাটি কেটে বিক্রি করার ফলে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত দুটি ব্রিজ হুমকির সম্মুখীন বলে জানা গেছে। এছাড়া মাটিকাটা চক্র নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের মাটি কেটে নেয়ার ফলে কাশিনগর এলাকার বারিয়া ব্রিজ, হিলালনগর কাতালিয়া ব্রিজ, কাশিনগর বাজার ব্রিজ, কাশিনগর কলেজ সংলগ্ন ব্রিজও হুমকির মুখে রয়েছে। জানা যায়, চৌদ্দগ্রামের শতাধিক ইটভাঁটির মাটি, পুকুর ভরাট, নতুন শিল্পকারখানা নির্মাণে জমি ভরাটসহ ঠিকাদারের রাস্তাঘাট নির্মাণে মাটির যোগান হয় কাঁকড়ি-ডাকাতিয়া নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের মাটি থেকে। এছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, এক রাজনৈতিক নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত কাশিনগর-সুয়াগাজী সড়কের মাটির যোগান দিতে কাঁকড়ি ও ডাকাতিয়া নদীর চর ও পাড়ের মাটি অবাধে কাটা হয়েছে। সরেজমিন পদির্শনকালে স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুম এলে চিহ্নিত এসব সিন্ডিকেট কাঁকড়ি ও ডাকাতিয়া নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের মাটি বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ লাভবান হলেও বর্ষা মৌসুমে প্রতিবারই বিভিন্নস্থানে ভাঙ্গে নদী রক্ষা বাঁধ। তলিয়ে যায় নদীপাড় ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষের বাড়িঘর ও ফসলি জমি, বাড়ে জনদুর্ভোগ, নিঃস্ব হন পাড়ের নিরীহ মানুষ। এছাড়া নদীর নাঙ্গলকোট ও লাকসাম অংশেও বিভিন্নস্থানে মাটি কাটা অব্যাহত আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লাস্থ পওর উপ-বিভাগ-২ সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরসহ গত তিন অর্থ বছরে শুধুমাত্র কাঁকড়ি নদীর তীর রক্ষা বাঁধ মেরামত কাজে ব্যয় হয়েছে সরকারে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এছাড়া কুমিল্লা জেলার পুরাতন ডাকাতিয়া ও নতুন ডাকাতিয়া সেচ ও নিষ্কাশন প্রকল্প নামে ৪৯ কোটি ৮৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকার আরও একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছর থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে সরকার কোটি টাকা খরচ করে নদী রক্ষাবাঁধ মেরামত করলেও সঠিক নজরদারিসহ মাটি কাটা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উল্লেখযোগ্য কোন নজির না থাকায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটগুলো বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে প্রতিবছরই কাটছে নদী রক্ষাবাঁধ চরের মাটি। এ বিষয়ে মঙ্গলবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লাস্থ নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবদুল লতিফ জগলুল জানান, ডাকাতিয়া ও কাঁকড়ি নদীতে চরের ও পাড়ের মাটি যারা কেটে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। তার পরও আমাদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি আরও জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আবদুল্লা আল মামুন অর রশিদ ভূইয়া বাদী হয়ে মনির হোসেন, আমির হোসেন, রবিউল, আলমগীরসহ মাটি কাটা সিন্ডিকেটের ৪ জনের বিরুদ্ধে চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মু. আসাদুজ্জামান জানান, যারা নদী রক্ষা বাঁধ ও চরের মাটি কেটে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং সরকারের অর্থের ক্ষতি সাধন করে তারা কখনও ভাল মানুষ হতে পারে না। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×