ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘ইঙ্কটোবার’-এ মাতোয়ারা তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২০ নভেম্বর ২০১৮

‘ইঙ্কটোবার’-এ  মাতোয়ারা তারুণ্য

বিশেষ কোন দিন বা মাসকে কেন্দ্র করে শিল্প রচনার ইতিহাস নতুন নয়। ইঙ্কটোবার এমনই এক শিল্প-সম্বন্ধীয় আখ্যা যা মূলত প্রত্যেক বছরের অক্টোবর মাসজুড়ে ৩১ দিনে ইঙ্ক মাধ্যমে অঙ্কিত ৩১টি শিল্পকর্মকে বোঝায়। বিশ্বজুড়ে সাড়াজাগানো এক নতুন ধারা এই ‘ইঙ্কটোবার’। একজন আর্টিস্ট অক্টোবর মাসের প্রত্যেক দিন একটি করে নতুন ছবি আঁকেন এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #inktober লিখে শেয়ার করে থাকেন। মাস শেষে নিজের পোর্টফোলিওতে জমা হয় ৩১টি নতুন কাজ। ২০০৯ সালে জ্যাক পার্কার; একজন আমেরিকান কমিক-বই লেখক ও ইলাস্ট্রেটর এই নতুন ধারার সূচনা করেন। ২০১৪ সালে টুইটারে নিজের এই নতুন মাধ্যমে ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা ও ধারণা সম্বন্ধে শেয়ার করার পর বেশ সাড়া পান পার্কার। প্রায় এক লাখ ছবি পার্কারের টুইটারে ট্যাগ করা হয়। বলা বাহুল্য, একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ শিল্পীদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো শিল্পধারা। কষ্টসাধ্য হলেও, ইঙ্কটোবার তরুণ শিল্পীদের নতুন চিন্তাধারায় শিল্পচর্চার দিকে উৎসাহিত করছে। ইঙ্কটোবারে বিষয়বস্তু ও মাধ্যম উন্মুক্ত। অনুসরণ করতে হয় অফিসিয়াল পেজে দেয়া একটি প্রম্পট লিস্ট। তবুও, যে কেউ, যে কোন বিষয় নিয়ে, যে কোন ধরনের কাগজে, যে কোন ইঙ্কে ছবি আঁকতে পারেন। তবে শর্ত একটিই, মাস শেষে ৩১টি সম্পূর্ণ কাজ। বাংলাদেশে ইঙ্কটোবারে আঁকার সূচনাকাল ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে ইঙ্কটোবারে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর বিষয়টি শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অধ্যয়নরত কয়েক তরুণ শিল্পীর হাত ধরে। ২০১৬ সালে প্রসূন হালদার, রাফিউজ্জামান রিদম ও তরিকুল ইসলাম হীরক প্রথম এ রীতিতে অঙ্কন শুরু করেন এবং মাস শেষে তা প্রদর্শনের উদ্যোগ নেন। প্রথম বছর আত্মিকরণে অসুবিধা দেখা গেলেও ২০১৭ সালে বেশ সাড়া পায়। প্রথম প্রদর্শনীও সে বছর। মাসব্যাপী ছবি আঁকার পরে শিল্পীরা তা প্রদর্শনীর জন্য তুলে ধরেন দর্শকের সামনে। মজার বিষয় হলো, এ প্রদর্শনী গ্যালারি অথবা কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের ভেতরে হয়নি। গত দু’বছর তারা এ প্রদর্শনী করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ক্যাম্পাসের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের বারান্দায়, উন্মুক্ত। এ বছর শিল্পীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪। ২৪ জন সংখ্যাটা খুব বেশি না হলেও সমসাময়িক সময়ে এটি একটি বড় প্রয়াস। এ বছর সম্মান পাসকৃত ছাত্র-শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছাত্র-শিল্পীরা কাজ করেছেন পুরো উদ্যমে। হয়েছে ৭৪৪টি কাজের এক বিশাল প্রদর্শনী। ভবিষ্যতে এ প্রদর্শনী আরও বড় হবে বলে আশা নবীন এ শিল্পীদের। মাস্টার্স পড়ুয়া, উদ্যমী নবীন শিল্পী প্রসূন হালদার। বন্ধুদের সঙ্গে ২০১৬ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইঙ্কটোবার নিয়ে। সে বছর তার কাজের বিষয়বস্তু ছিল ‘প্রাণিকুল’, ২০১৭ তে ‘নারীকুল’। ২০১৮তে কাজ করেছেন ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর। তিনি বলেন, সে দৃশ্যের সঙ্গে তার নিজের অভিজ্ঞতা যুক্ত। ঘুরতে যাওয়া, বেড়ে ওঠার গল্পও সংযুক্ত। জায়গা জলরং, গুয়াস বা পেন্সিল স্কেচে আঁকা। যার মধ্যে স্থাপনা, নদী-নৌকা ও মানব ফিগারও রয়েছে। প্রসূনের এবারের কাজে এক ধরনের গতি লক্ষণীয়। দর্শক চাইলে সবগুলো কাজের মধ্যে একটা জার্নি করতে পারতেন। রয়েছে আকাশের খেলা। যা স্মরণ করিয়ে দেয় ভিনসেন্ট ভ্যানগগের স্ট্যারি নাইটের কথা। যা গতিশীল ও ছন্দময়। নিজের কাজের সঙ্গে জীবনের ধারাবাহিক গতির প্রতিও আলোকপাত করেছেন তিনি। এক প্রকার ধূসর কাগজে ছবি এঁকেছেন প্রসূন। ভূমির দৃশ্য এঁকেছেন যা একজন মানুষ তার কল্পনায় ধারণ করে এবং বাস্তবে দেখতে চায়। সত্যিকারের নৈসর্গিক দৃশ্য যেমন হওয়া প্রয়োজন ঠিক সে ধারণা থেকেই প্রসূনের এ শিল্পচিন্তা ও ইঙ্কটোবার-১৮ চর্চা। নবীন শিল্পী তরিকুল ইসলাম হীরক ইঙ্কটোবারে কাজ করছেন ২০১৬ থেকে। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে পছন্দ করেন। তাই ২০১৮ এর ইঙ্কটোবারে উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আহমেদ, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদারসহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাসের প্রধান প্রধান চরিত্রের মুখচ্ছবি। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমুকে’ নিজের অবয়বে আঁকার চেষ্টা করেছেন হীরক। তাছাড়া যে কোন শিল্পীই তার সময়ের বিখ্যাত চরিত্রের আদলে নিজকে আঁকার চেষ্টা করেন, এ প্রবণতাও নতুন নয়। রয়েছে রবিঠাকুরের ‘বিনোদিনী’, ‘হৈমন্তী’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ফটিক’; হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’, ‘রুপা’ ও ‘দেবী’; বিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা সিরিজের ‘তিন গোয়েন্দা‘ ও ‘মাসুদ রানা’, সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’। প্রাধান্য দিয়েছেন নারী চরিত্র মূল্যায়নে। তার চিত্রে উঠে এসেছে সাহিত্যে বাঙালী নারীদের শক্তি ও সামর্থ্য ও সরল মানবতা। বাংলাদেশ ইঙ্কটোবারের যাত্রাকালীন সময়ের অন্যতম প্রধান শিল্পী রাফিউজ্জামান রিদম। তিনি ‘ফিকশনাল ক্যারেকটার’ বা কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। এ বছর তিনি কাজ করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ কল্পকাহিনী লেখিকা জে. পি. রাউলিংয়ের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের নামকরা সব চরিত্র নিয়ে। চোখের সামনে পুরো ৭টি বইয়ের সর্বমোট ৩১টি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। রিদমের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয় চরিত্র ‘প্রোফেসর স্নেইপ’। ‘হ্যারি পটার’ পড়ে বা দেখে যাদেও কৈশোরের বেড়ে ওঠা, তারা অবশ্যই এই রিদমের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন। ইঙ্ককিং করতে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আর কাল্পনিক চরিত্র চিত্রায়নেও তার গুরুত্ব প্রকাশ পায়। আতিয়া মাইবম : কাজের বিশেষত্ব হচ্ছে ‘ফুল’, ‘লতা’ ‘পাতা’। টানা ৩১ দিন তিনি কাজ করেছেন এ বিষয় নিয়ে। নান্দনিক সৌন্দর্যের অনন্য দৃষ্টান্ত লতানো পাতা ও ফুল। সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলকে ইঙ্কে ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে যে সুচিন্তিত প্রয়াস শিল্পী ঘটিয়েছেন তা সত্যই প্রশংসনীয়। সাদা কাগজে ইঙ্ক মাধ্যমে আলো-ছায়ার ব্যবহারে ফুলের বিন্যাস দর্শকের মনকে প্রশান্তি এনে দেয়। এ ছাড়া কিছু ফুলের ক্ষেত্রে শিল্পী নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কালির ব্যবহারে, আলো-ছায়ার তারতম্য ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। আতিয়ার কাজ ক্লান্ত মানুষকেও এক দৃষ্টিনন্দিত প্রশান্তি অনুভব করায়। আনিকা নাওয়ার গুনগুন : সদ্য সম্মান পাস করা শিল্পী আনিকা কাজ করেছেন হলুদ কাগজে ইঙ্ক মাধ্যমে। বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করা আনিকার চিত্রে উঠে এসেছে কাল্পনিক, বাস্তবিক, ও চারপাশের যে কোন বিষয়বস্তু। যেমন, মারভেল কমিকসের কাল্পনিক চরিত্র ‘উল্ভেরিন’ যা slice প্রম্পটের অন্তর্ভুক্ত। বা ‘বীঢ়বহংরাব’ প্রম্পটে নিজের মায়ের প্রতিকৃতি। প্রাত্যহিক জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন ঘটনাকেও তার কাজে দেখা যায়। নিজের জীবনের স্মৃতি নিয়েও এঁকেছেন ইঙ্কটোবার-১৮’র বেশ কিছু ছবি। সুমিতা হালদার : ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্রী সুমিতা কাজ করেছেন ব্যক্তিগত জীবনের জনপ্রিয় সব ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। যেমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার্লি চ্যাপলিন, লিওনেল মেসিসহ অনেকে। তার কাজের ধরন বাকিদের চেয়ে ভিন্ন। সুমিতা কাজ করেন ‘ডুডলে’। সুমিতার ডুডলে নিজস্ব একটা ভাব লক্ষণীয়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে ঘটিয়েছেন ছন্দপতন। ইঙ্কেজেলের পাশাপাশি রঙের তারতম্য বোঝাতে তিনি বল পয়েন্টের ইঙ্কও ব্যবহার করেছেন। আরও অংশ নিয়েছেন আনিকা রায়, অসিম, অঙ্গনা, রাফি, অনামিকা, দোয়েল, ফাইয়াজ, ফাহিম, রিমঝিম, রেজা, জয়, রোকেয়া, শিফা, শাগুফতা, শাহানা, তাহসিন ও সুপ্তি। আমরা বড় হই কিন্তু স্মৃতিরা না। নবীন শিল্পী উর্মি এঁকেছেন তার ছোটবেলায় খেলার উপকরণ ও মাধ্যম নিয়ে। যেমন, গলুই ও তীর, মার্বেল ছোড়ার দৃশ্য, সুপারি পাতার টানা গাড়ি, টিনের পিস্তল বা ইয়ো-ইয়ো। এ যেন যুগ পার হয়েও বাস্তবিক শৈশবে ফিরে যাওয়া। এটাই শিল্পের সার্থকতা, ‘নিজের মাঝে নিজেকে ফিরিয়ে দেয়া।’ মনের ভেতর লুকানো সেইসব দৃশ্যপট জাগিয়ে তোলা যা মানুষ শতবার দেখেও আবার দেখতে চায়। ইঙ্কটোবার বাংলাদেশ ২০১৮ এর সফলতা এখানেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ২০১৮ এর ইঙ্কটোবার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী। শিরোনাম ছিল- Inktober Showdown Charukola 2018. থাকে দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইঙ্কটোবার-২০১৮ এর প্রদর্শনী করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ, কার্টুন পিপল ও ই. এম. কে সেন্টারের আয়োজনে প্রদর্শিত INKTOBER BANGLADESH. মানুষ সবসময় নতুনত্বকে ধারণ করবে, এটাই সহজাত প্রবৃত্তি। একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বগ্রামে যেখানে সেকেন্ডের মাঝে তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে সেখানে ইঙ্কটোবার চর্চিত বা উদযাপিত হবে, এটা স্বাভাবিক। এই বিশেষায়িত রূপ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে শুরু হয় বাংলাদেশে। শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে বের করতে শেখান তিনি। আর ইঙ্কটোবার-১৮ এর অধিকাংশ শিল্পী তাই করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় ঠিকই ইঙ্কটোবারের পরের দিনগুলোতে প্রচুর নিজস্ব ভাবনার ও স্বকীয় ধারার কাজ দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানে প্রাধান্য পাবে গ্রাম-বাংলা, নদী ও নৌকা, কৃষক-শ্রমিক ও বাংলার চিরাচরিত রূপ। সেদিন ইঙ্ক মাধ্যম বড় হবে না, বড় হবে ইঙ্কটোবার বাংলাদেশ।
×