ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তাদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ

রোহিঙ্গাদের কারণে ১০ হাজার একর বনাঞ্চল বিনষ্ট

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২০ নভেম্বর ২০১৮

রোহিঙ্গাদের কারণে ১০ হাজার  একর বনাঞ্চল বিনষ্ট

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ওরা ভিনদেশী। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অধিবাসী। সে দেশের সেনাসহ উগ্র মগ সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত নিপীড়ন নির্যাতনে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে ওদের কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রয় দেয়ার পর সরকারী বনাঞ্চলসহ ১০ হাজার একরেরও বেশি রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিনষ্টের যে ঘটনা ঘটেছে এর ক্ষতি অপূরণীয়। উক্ত পরিমাণ জমির মধ্যে সরকারী বরাদ্দের ঘোষণার খাস জমি রয়েছে ছয় হাজার একর। অবশিষ্ট চার হাজার একর জমিতে ওরা বসতি গেড়েছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। পরিবেশগত এই মহা ক্ষতির পাশাপাশি এসব রোহিঙ্গাদের নানামুখী অপকর্মে স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে কিছু এনজিও এ অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানার জমি কেনার তৎপরতা শুরু করেছে। এ প্রক্রিয়া অবহিত হওয়ার পর স্থানীয়দের মাঝে অজানা শঙ্কা সৃষ্টি হয়ে তা আরও বড় ধরনের উদ্বেগ বয়ে এনেছে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে কি হবে না, নাকি এদের দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আশ্রয় দিয়ে রাখতে হবে-এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দারা। আশ্রিত এসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল সাবাড় করেছে। শত শত বড় ছোট বিভিন্ন শ্রেণীর গাছ কেটে লাকড়ি বানিয়ে জ্বালিয়েছে। পাহাড় কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। উখিয়া টেকনাফের পাঁচটি এলাকায় ছোট বড় পাহাড়ী টিলা কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করেছে। এসব স্থানে এরা বানিয়েছে ঝুপড়ি ঘর। পরবর্তীতে এসব স্থানে বিভিন্ন এনজিও, সংস্থা শেড নির্মাণ করে দিয়েছে। উখিয়ার ওয়ালাপালং এলাকার কুতুপালং গ্রামজুড়ে বনভূমি বলতে এখন আর কিছুই নেই। বালুখালি, থাইনখালি ও পালংখালি বন বিটের শত শত একর রিজার্ভ বনভূমির গাছপালার কোন চিহ্নও এখন আর নেই। টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং, হ্নীলা, মুচনি ও শামলাপুর বন বিটের অবস্থা আরও মারাত্মক। খাস জমি, বনভূমি সবই এখন রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, উখিয়া টেকনাফে রক্ষিত-সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে ৩৭ হাজার ২৭১ একর। এরমধ্যে উখিয়ায় রয়েছে ২০ হাজার ৮১৭ ও টেকনাফে ১৬ হাজার ৪৫৪ একর। সরকারী এ বনাঞ্চলের মধ্যে রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে ৬ হাজার ১৫৮ একর। সরকারীভাবে এ পরিসংখ্যান হলেও আরও চার হাজার একরেরও বেশি বনাঞ্চল পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দখলে রয়েছে। দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে বন বিভাগের পক্ষে প্রতিটি রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তাদের এ অবৈধ তৎপরতা বন্ধে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এদিকে, আশ্রিত ৩০ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধও দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি উখিয়া টেকনাফের স্থানীয়রাও উদ্বিগ্ন। খুন, অপহরণ, গুম, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, মাদক বিক্রি, মানব পাচারসহ হেন কোন অপকর্ম নেই এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা সংঘটিত করে যাচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্প অভ্যন্তরে নেতৃত্বের আধিপত্য, পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, নিজ দেশে ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে মতবিরোধ কেবলই বিস্তৃতি লাভ করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৪ মাসে ২৪ রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এদের হাতে স্থানীয় ৩ যুবকও প্রাণ হারিয়েছে। তবে এরই মাঝে ক্যাম্প অভ্যন্তরে পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং এর পাশাপাশি রাতের বেলায়ও যৌথ টহল বলবত করা হয়েছে, যা শুরু থেকে দীর্ঘ সময় ছিল না। বর্তমানে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও শুরু হয়েছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেয় সকল সুযোগ সুবিধা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। স্থানীয়দের মতে, উখিয়া টেকনাফে অরক্ষিত ক্যাম্পগুলো সন্ধ্যার পর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এসব ক্যাম্পে সন্ত্রাসী তৎপরতা যে হারে বাড়ছে তা ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। এসব এলাকায় মেঠোপথ রয়েছে অজস্র। এসব পথে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা রাতের বেলায় ক্যাম্পে প্রবেশ করে। এরপর চালায় নানা অপকর্ম। কিছু এনজিওর অপতৎপরতা ॥ রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। অতীতেও রোহিঙ্গা আগমনের ঘটনা রয়েছে। কিন্তু কক্সবাজারের প্রশাসন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি ক্রমাগতভাবে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এত বিপুলসংখ্যক হবে। এ সময়ের পর থেকে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ীই এসেছে ৭ লাখ। বেসরকারী হিসাবে তা আরও বেশি। সরকার মানবিক কারণে এদের আশ্রয় দেয়ার পর উখিয়া টেকনাফের সাড়ে ছয় হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে। বরাদ্দকৃত জমিতে গড়ে উঠেছে ৩০ আশ্রয় ক্যাম্প। সরকারী বাদ্দের এ জমি ছাড়াও শত শত রোহিঙ্গা অবৈধভাবে সরকারী বনাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে আবাস গেড়েছে। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশের সঙ্গে কিছু এনজিওর আঁতাত সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। এনজিও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির নামে বিদেশ থেকে অর্থ আনছে। এসব এনজিও নিজেদের স্বার্থ হাসিলে রোহিঙ্গারা যাতে সহজে নিজ দেশে ফিরে না যায় সে প্রচেষ্টায়ও রয়েছে বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, গত ১৫ নবেম্বর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়ার পর কিছু এনজিও উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলে জমি কেনার তৎপরতা শুরু করেছে। এ জাতীয় খবর প্রচার হওয়ার পর উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের স্থানীয় জনসাধারণের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কেন তারা জমি ক্রয় করতে চাচ্ছে এবং এদের উদ্দেশ্য কি রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে রেখে দেয়া-এসব নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কমতি নেই। সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটিও কেন শুরু করা হচ্ছে না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া মিয়ানমার ভবিষ্যতে প্রত্যাবাসন শুরু করলে তা হবে অতি স্বল্প পরিসরে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সময় যে দীর্ঘ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। উক্ত সময়ের মধ্যে এদের অন্যত্র সরানো সময়ের দাবি।
×