ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আয়কর বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম

কর ফাঁকি বন্ধের উদ্যোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 কর ফাঁকি বন্ধের উদ্যোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বর্তমান সরকার অবশ্য কর ফাঁকি বন্ধ ও সক্ষম ব্যক্তিদের কর দিতে বাধ্য করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন কর বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর কমিশনার ড. এস এম জাহাঙ্গীর। দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় হিসাব করে আরও বেশি রাজস্ব আয়ের নানা উদ্যোগের উল্লেখ আছে চলতি অর্থবছরের অর্থ বিলে। এতে একদিকে যেমন রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে, তেমনি কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, সরকারের নীতিনির্ধারক সবাই মনে করেন, দেশের যে পরিমাণ মানুষের আয়কর দেয়ার কথা, এর সামান্য অংশই কর দেয়। উল্লেখ্য, এবারের আয়কর মেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আয়কর দিতে সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ৪ কোটি হলেও কর দেন মাত্র ৩০ লাখ’। এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ‘দেশে কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন, আর ব্যক্তি পর্যায়ে কর দেন ১৭ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ জন’। আয়করদাতাদের একটি বড় অংশ আবার নানাভাবে কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি ভ্যাট ও করের বোঝা না চাপিয়ে কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্র বন্ধ করে বাড়তি রাজস্ব আয় করার কথা অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সব সময় বলে আসছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুধীজনরা। এ প্রসঙ্গে ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কর ফাঁকি বা কর দিতে অনীহা বাংলাদেশের মানুষের অভ্যাস বলা যেতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কর ফাঁকি বা অনীহা বলতে কিছু নেই। দেশে রাতারাতি কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে আর সেই সঙ্গে কর দিতে সক্ষম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তারা কর দিচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, সাধারণ করদাতা থেকে উচ্চবিত্ত পর্যায়ের সবার জন্য কর ফাঁকি দেয়ার বড় একটি ক্ষেত্র হলো কথিত ‘উপহার’। নিজের আয় দিয়ে ভরি ভরি স্বর্ণালঙ্কার, দামী আসবাব কেনার পর করদাতারা রিটার্ন ফাইলে এর কোন মূল্য দেখায় না। ‘উপহার হিসেবে পেয়েছি’ বা ‘মূল্য জানা নেই’ জাতীয় কথা উল্লেখ করে আয়কর রেয়াত নেয় তারা। অনেক করদাতার স্বর্ণালঙ্কার বা দামী আসবাব না থাকলেও প্রথমবার রিটার্ন দাখিল করার সময়ই ‘উপহার’ হিসেবে বেশি করে স্বর্ণ থাকার তথ্য তুলে ধরে। তাতে ভবিষ্যতে কর ফাঁকি দিয়ে কখনও স্বর্ণালঙ্কারের মালিক হলেও এনবিআর যাতে ধরতে না পারে সে জন্য এই চালাকি করে তারা। অনেকে নিজের টাকাকে অন্যের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ধার বা ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে কর ফাঁকি দেয়। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে উপহার ও ব্যক্তিগত ঋণের নামে কর ফাঁকির এই সহজ পন্থা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(২১) ধারা প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে অর্থ বিলে। করদাতার উপহার ও ঋণ দেয়া সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে ঋণ নেয়া হলে এবং কোন ব্যক্তির কাছ থেকে এক অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ বা এর চেয়ে বেশি অর্থের কোন উপহার পেলে তা করদাতার অন্যান্য খাতে আয় হিসেবে চিহ্নিত করে আয়কর নেয়া হবে। তবে কোন করদাতা তার মা-বাবার কাছ থেকে কোন ঋণ বা উপহার ব্যাংকিং চ্যানেলে পেলে এর ওপর আয়কর প্রযোজ্য হবে না। এফএফ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, দেশে বেসরকারী খাতে কর্মরত অনেকেই করযোগ্য বেতন-ভাতা পেলেও আয়কর দেন না। এবার তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে অর্থ বিলে। এতে বলা হয়েছে, বেসরকারী খাতে কর্মরত প্রত্যেক চাকরিজীবী তার নিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবছরের ১৫ এপ্রিলের মধ্যে নিজের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), আয়কর রিটার্ন দাখিলের তারিখ এবং রিটার্ন দাখিলের সময় আয়কর অফিস থেকে দেয়া সিরিয়াল নম্বর (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) জমা দেবেন। এর আগে প্রতিবছর ১৩ এপ্রিলের মধ্যে বেসরকারী চাকরিজীবীরা তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন। তাতে নিম্নোক্ত তথ্য থাকতে হবে নাম, পদবি, টিআইএন নম্বর, রিটার্ন দাখিলের তারিখ, রিটার্ন দাখিলের পর কর কর্তৃপক্ষের দেয়া সিরিয়াল নম্বর। আয়কর অধ্যাদেশের ১০৮ ধারায় নতুন এ বিধান সংযোজন করার প্রস্তাব করা হয়েছে অর্থ বিলে। তবে এ বিধান সরকারী চাকরিজীবীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিভিন্ন দফতর ও এজেন্সির নিকট করদাতার যে আর্থিক তথ্য থাকে তা কর বিভাগের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেয়ার করার বিধান সংযোজনের কথা বলেছেন। এর ফলে কর ফাঁকি মোকাবেলা অনেক সহজ হবে’। এর মধ্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন, কেউ ব্যাংক, শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্র কিংবা অন্য কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই তথ্য এনবিআরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানাবে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশনও করদাতাদের আর্থিক তথ্য জানাবে এনবিআরকে। ফলে কেউ কর দেয়ার সময় সম্পদের তথ্য গোপন রাখলে তা ধরা পড়বে সহজে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, এনবিআরকে অন্য যেকোন সংস্থার চেয়ে বাড়তি ক্ষমতা দেয়া আছে। এনবিআর চাইলে যেকোন সংস্থার কাছে যেকোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তথ্য চাইতে পারে। কিন্তু এনবিআরের কাছে কেউ তথ্য চাইতে পারবে না। বাংলাদেশে এটি খুবই স্পষ্ট যে বিপুলসংখ্যক মানুষের হাতে প্রচুর পয়সা রয়েছে। কিন্তু তারা সঠিকভাবে আয়কর পরিশোধ করছে না। এবার বাজেটে করের হার ও ভিত্তি বাড়ানো হয়নি। তাই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ফাঁকি দেয়ার ফাঁক ফোকরগুলো বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এবারের বাজেটে কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও কর ফাঁকির মামলা করার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে থাকার চেষ্টা রয়েছে অর্থ বিলে। আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৯ ধারার পর নতুন ১৬৯-এ ধারা সন্নিবেশের প্রস্তাব করে অর্থবিলে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করসংক্রান্ত অপরাধের দায়ে মামলা করার আগে কোন অপরাধের তদন্ত হওয়ার পরও কর কমিশনারের আগাম অনুমোদন সাপেক্ষে ডেপুটি কর কমিশনার পুনরায় তদন্ত করবেন। এছাড়া করদাতাদের কোন কারণে নোটিস দেয়ার দরকার হলে আগামী অর্থবছর থেকে কাগুজে নোটিসের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক মেইলের মাধ্যমে নোটিস করা হবে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সম্বোধন করে পাঠানো সুনির্দিষ্ট ই-মেইলই এনবিআরের পাঠানো নোটিস বলে বিবেচিত হবে। কর ফাঁকির খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমদানি-রফতানির নামে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। আমদানির সময় কোন পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে বাড়তি অর্থ পাচার করছে কোন কোন ব্যবসায়ী। আবার রফতানির সময় কোন পণ্যের দাম কম দেখিয়ে অর্থপাচার করছে তারা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, এর প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি-রফতানির মাধ্যমে হয়ে থাকে বলে তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)।’ এছাড়া বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য দেশে খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আমদানি-রফতানির মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া রোধ করা এবং অর্থপাচার বন্ধ করার জন্য শুল্ক কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলা রয়েছে এবারের অর্থ বিলে। তাই সরকারের এই উদ্যোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
×