ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচিত ৫০ নেতার দলবদল

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 আলোচিত ৫০  নেতার  দলবদল

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। সাম্প্রতিক সময়ে একথাটি বহুল আলোচিত। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বারবার এ কথাটি বলেন। মূলত তার মুখ থেকেই একথাটি এখন সবার মুখে মুখে। তাই হয়ত রাজনীতির ময়দানে মতেরও কোন শেষ নেই। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল পাল্টানোর রীতিমতো হিড়িক লেগেছে। রাজনীতির ময়দানে এ নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা। নিজেদের সুবিধা মতো দল পরিবর্তন করছেন নেতারা। লক্ষ্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া। দল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির হিসাব নিকাশও পরিবর্তন হচ্ছে। দলগুলোকে নতুন করে প্রার্থী নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সর্বশেষ হিসেবে দেখা গেছে অন্তত ৫০ জন আলোচিত নেতা ইতোমধ্যে দল পরিবর্তন করেছেন। রাজনীতির ময়দানে যাকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে দেখা গেছে তিনি এখন পাল ভেড়াচ্ছেন ধানের শীষ তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। আবার ধান নিয়ে যিনি ব্যস্ত ছিলেন তিনি এখন এখন নৌকা নয়ত লাঙ্গলে ভিড়ছেন। যিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনিও সরব হয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন জোটগুলোতে যোগ দিচ্ছেন বড় ও আলোচিত নেতারাও। ক্ষমতার লোভে অনেকে আদর্শ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে ভুলছেন না। আওয়ামী পরিবারের সন্তানরাও বিনা দ্বিধায় হাত মিলাচ্ছেন বিপরীতমুখী রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে হেভিওয়েট প্রার্থীদের এই রকমফেরে ভোটাররাও আছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। এক কথায় নির্বাচনের আগেই প্রার্থী নিয়ে যে চমকের সৃষ্টি হয়েছে, এর কোন ব্যাখ্যাই এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোও আসন রক্ষায় নেতা পরিবর্তন নিয়ে কোন শব্দ করছেন না। অর্থাৎ দল পরিবর্তনের রেওয়াজকে সরাসরি সায় দেয়া হচ্ছে বলা যায়। অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতালোভী চরিত্রকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্যই মনোনয়ন মৌসুমে এসে রাজনীতিবিদরা ডিগবাজি দিচ্ছেন। তাছাড়া দল বদল একটি সাধারণ বিষয়। তবে দল পরিবর্তনের কারণে রাজনীতির চিরচেনা দৃশ্যপটই বেশকিছু আসনে পাল্টে যাবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুই এক দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগের এবং এক সপ্তাহের মধ্যে শরিক দলের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। এ জন্য কাজ চলছে। ভাল প্রার্থী পেলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বাদ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে ১৪ দলের প্রার্থীদের মধ্যে যারা যোগ্য তারা থাকবেন। সংরক্ষিত মিলিয়ে বর্তমানে ১৪ দলের ১৭ সংসদ সদস্য রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা শামসের মবিন চৌধুরী এক সময়ে ছিলেন দলটির প্রাণ। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি দল ছেড়ে বেশ কিছুদিন একান্ত নীরবেই ছিলেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই সরব হন তিনি। ঘটা করেই যোগ দেন বিকল্পধারায়। পদ পান প্রেসিডিয়াম সদস্যের। ১৪ দলের সঙ্গে মিলে মহাজোটেও যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে তার। ফলে শামসের মবিন শেষ পর্যন্ত ধান বাদ দিয়ে নৌকা অথবা কুলা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে আলোচনায় এসেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি থেকে একযোগে মনোনয়নপত্র কিনে আলোচনায় এসেছেন। ফেনী থেকে নির্বাচন করতে চান ১/১১ সময়ে আলোচিত এই সেনা কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে এরশাদের সামরিক উপদেষ্টা করা হয়েছে তাকে। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের পদও পেয়েছেন মাসুদ উদ্দিন। শেষ পর্যন্ত তিনি নৌকা না লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করবেন তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এক সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্না ও কামাল হোসেন। তারা প্রত্যেকেই এখন নৌকা প্রতীকের পরিবর্তে ধানের শীষ নির্বাচন করার অপেক্ষায়। ছাত্রদলের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি গোলাম সারোয়ার এখন বিকল্পধারায়। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল আজাদও বিকল্পধারায় যোগ দিয়ে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে লড়বেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের চন্দনাইশে কর্নেল অলির আসনে সুব্রত চৌধুরীর মনোনয়ন নিয়েও লড়াই চলছে। মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সুকুমার রঞ্জন ঘোষের আসনে মাহী বি চৌধুরী মহাজোট থেকে নির্বাচন করতে চাওয়ায় সেখানেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও বিএনপির সাবেক নেতা মনজুর আলম সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন কিনেছেন। তিনি বিএনপির হয়ে চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিদায়ের ঘোষণায় হবিগঞ্জ-৪ আসনে সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার পরিকল্পনার মধ্যে হবিগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত জানালেন রেজা কিবরিয়া। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দল কামাল হোসেনের গণফোরামের প্রার্থী হতে শুক্রবার মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এই জোটের বড় দল বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে জোটের অন্য দলগুলোও ভোটে অংশ নিতে চায়। রেজার বাবা শাহ এ এম এস কিবরিয়া শেখ হাসিনার ১৯৯৬-০১ সালের সরকারে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে হবিগঞ্জ-১ আসনে (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৫ সালে হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তিনি। বাবা আওয়ামী লীগ করলেও অন্য দলে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে রেজা বলেন, আমার বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও আমি কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইনি। এছাড়াও গত ১৪ বছরেও আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ। জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা শাহ কিবরিয়ার মতো তার ছেলে রেজাও জাতিসংঘে কাজ করছেন। তার জন্ম নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের জালালসাপ গ্রামে হলেও তার কৈশোর আর যৌবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিদেশে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি যখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জোট করল, তখনই তাতে ভিড়লেন রেজা। তিনি জানান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনয়ন দিলে তিনি ধানের শীষ প্রতীকে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেবেন। রেজা কিবরিয়ার খবরে নবীগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘ড. রেজা কিবরিয়ার বাবা হত্যা মামলার আসামি বিএনপি নেতাকর্মী। সেই রেজা কিবরিয়া ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করলে এটা আমাদের জন্য চরম বিব্রতকর। এ রকম পরিস্থিতিতে শনিবার সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হতে গণফোরামে যোগ দিয়েছেন। তিনি হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে প্রার্থী হতে চান। এর আগে তিনি নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তিনি গণফোরামে যোগ দেন এবং প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে চান। এদিকে বিএনপিপন্থী ডাক্তারদের পেশাজীবী সংগঠন ড্যাবের সাবেক সভাপতি ডাঃ রফিকুল ইসলামও রাজনীতিতে চমক দিয়েছেন। হঠাৎ করেই বিএনপি থেকে তিনি যোগ দিয়েছেন বিকল্পধারায়। সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চান রফিকুল ইসলাম। মনোনয়ন পেলে মহাজোটের হয়ে নৌকা প্রতীকে অংশ নেবেন তিনি। সিলেট-৬ আসনটি (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আসন। এতদিন ওই আসনে আওয়ামী লীগ তথা জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনিই নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু শুক্রবার থেকে ওই আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ভোটের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শমসের মবিন চৌধুরীর নাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শমসের মবিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, কিছুদিন লাইনচ্যুত হয়েছিলাম। এখন আবার লাইনে চলে এসেছি। আপনি কি সিলেট-৬ থেকে নির্বাচন করছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি সেখান থেকেই নির্বাচন করছি। এতে কি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে কোন ঝামেলা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করছি কোন ঝামেলা হবে না। মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-জুড়ীর একাংশ) আসন এর আগে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। আর ধানের শীষে একবার এবং স্বতন্ত্র একবার নির্বাচন করেছেন এমএম শাহীন। কিন্তু এবারের ভোটে আগের সবকিছু পাল্টে গেছে। নৌকার সুলতান গেছে ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষে। আর ধানের শীষের শাহীন চলে এসেছেন বিকল্পধারার কুলায়। সম্প্রতি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক আলম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন। দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন না তা আগে ভাগেই টের পান এই সুযোগ সন্ধানী নেতা। তাই নৌকা ছেড়ে চলে গেছেন ধানের শীষে। এখন তিনি গাইবান্ধা-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন। ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিলেন ন্যাপের জেবেল রহমান গনি। কথা ছিল মনোনয়ন পেলে ধানের শীর্ষ নিয়ে মাঠে নামবেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম। রাজনৈতিক কারণে ২০ দলের প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে বনিবনা হয়নি। তাই দল ত্যাগ করে বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন। এখন গনি নৌকা অথবা কুলা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এনডিপি চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মর্তুজাও ছিলেন ২০ দলীয় জোটে। তিনিও এসেছেন বিকল্পধারায়। সম্মানজনক পদ পেয়েছেন। বিএলডিপির চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন আল আদাজও ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিকল্পধারায়।
×