ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতিতে হেমন্তের শুভ্রতা

মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো..., ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো..., ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব

সমুদ্র হক ॥ ভোরের তেরছা রোদ কুয়াশার আঁচল চিরে জলের যে জায়গাটায় ঝিলিক তুলেছে সেখানে এক জোড়া হাঁস সদ্য স্নান সমাপনে জানিয়ে দিচ্ছে হেমন্ত দিনের সুপ্রভাত। হেমেন্তই সোনালি ধানের ম ম গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের আঙ্গিনা। নবান্নের ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠেছে। বাংলার ঋতুর বর্ণিল ব্যঞ্জনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে কত বৈচিত্রের সুর বেঁধেছেন.......। হেমন্তকে লক্ষ্মীর উপমায় টেনে লিখেছেন ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা.....’। হেমন্তের শেষ বিকেলের লাজুক আলোয় কোন ললনা কবিগুরুর সুর আপন হৃদয়ে বেঁধে গেয়ে ওঠে ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো দোলে মন দোলে অকারণ হরষে.....’নবান্নের ধ্বনিতে সুরের এই ঝর্ণাধারায় রূপাতীত হয়ে নেচে ওঠে হেমন্ত। বাংলার ঋতুচক্রে হেমন্ত চতুর্থ। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য- খুবই অনুভূতিপূর্ণ ও অভিমানী। নিজেকে গোপন রাখে। তবে এর হৃদয়টি স্নিগ্ধতায় সুন্দর ও বিশাল। তাই কষ্টও বেশি। হেমন্তের আগমন শরতের পর। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা সরিয়ে হাল্কা কুয়াশার প্রলেপ দিতেই সুরের রাগিণী ধ্রুপদ লয়ে মিটি মিটি হেসে এগিয়ে যায়। ধরণীকূলকে ধন্ধের মধ্যে ফেলে- এ শরত না হেমন্ত। অভিমানে হেমন্ত কখনও রেগে ধুলি উড়িয়ে কখনও লুকিয়ে কেঁদে বৃষ্টি ঝরিয়ে দিনপঞ্জি দেখতে বলে। ওদিকে শিশির ঝরিয়ে শীতও একটু এগিয়ে আসতে চায়। হেমন্তের আঙ্গিনায় শরতের খানিকটা বেদখল আর সীমানা অতিক্রম করে শীতের অনুপ্রবেশে অনেকটাই আকুল হয়ে পড়ে। তারপরও ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলায় ত্রিতালে নেচে উঠে হেমন্ত উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে দেয় ভুবন। হেমন্তই প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে অন্ন জোগায়। কৃষকের উঠান ভরে ওঠে ধানে। হাড়িতে চড়ে নতুন চালের ভাত, ফিরনি পায়েস। এনে দেয় নবান্ন। আছড়ে পড়ে উৎসবের ঢেউ। বঙ্গীয় ব-দ্বীপের নবান্নের এই দেশে ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা মায়াভরা গ্রামে মিলন তিথির ভরা চাঁদ ওঠে পশ্চিমের মধ্য গগণে। এমনই নিসর্গের রাতে আঙ্গিনায় বসে কিষান-কিষানী অপার মধুময়তা। তার আগে হেমন্ত সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা কৃষককে পিড়িতে বসতে গিয়ে আদরের পরশ বুলিয়ে দেয়। বাংলার এই চিরন্তন রূপ কি আছে আর কোথাও! হেমন্তের সকাল ও গোধূলি বিছিয়ে দেয় কুয়াশার পাতলা চাদর। এ সময় বয় মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া। মাঝরাতে ঝরে শিশির। কুয়াশার মেঘ নেমে আসে ধরণীতে। দিনকয়েক আগের ভ্যাপসা গরম আর বিরামহীন বারিধারার কথা ভুলে যায় মানুষ। যেন স্বস্তির পরশ এনে দেয় হেমন্ত। এই সময়টায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়বে চারদিকে আমন ধানের সবুজের প্রান্তর। ঋতু বৈচিত্রের পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। এখন তো কিছুই বলা যায় না। প্রকৃতি ও জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বময়। ঋতুর সময় ঠিক থাকছে না। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। সকল ঋতুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কাশবন কখনও হেমন্তও অতিক্রম করে। এখনও গোধূলি বেলার হলদেটে আলোয় কাশবনে শ্বেত শুভ্র পালক হাতে নিয়ে মেতে ওঠে শিশু কিশোর। হেমন্তে নদীর শান্তরূপ হৃদয় ভরিয়ে দেয়। সুর ওঠে ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি...’। বর্ষায় নদীর যে ঢেউ উথাল পাথাল হয়ে তীরে ধাক্কা দিয়ে কখনও ভেঙ্গে দেয় সেই নদী কত শান্ত। তবে সুপ্ত নয়। বয়ে চলে নিরবধি...ভরা চাঁদের রাতে সেই ঢেউয়ের তালে চাঁদের প্রতিচ্ছিবি ছন্দের দোলায় নেচে অপার নিসর্গের রূপ তুলে ধরে। ঋতু পরিবর্তনের এমনই ধারায় এসেছে হেমন্ত। কবিগুরুর কথায় ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা- হিমের ধন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা/সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে, কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাস্পে মাখা...আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা...’। প্রকৃতি এভাবেই হেমন্তের শুভ্রতা এনে দেয়...।
×