ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ হাসু আপার গল্প ॥ অ্যা ডটার’স টেল

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ হাসু আপার গল্প ॥ অ্যা ডটার’স টেল

দুটো বোন। পিতা হারা, পরিবারে আপনজন ছাড়া। পরিবারের সবাইকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছে। বুলেটের আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝড়া করেছে ছোট্ট ভাই রাসেলকে পর্যন্ত। চারপাশে শত্রুমহল। যেখানেই দেখবে, নাম-পরিচয় জানলে হত্যা চেষ্টা করবে। বংশকে নিরবংশ করার শেষ কাজটি দুই বোনকে হত্যা করা। এরা দৌঁড়াচ্ছে, মরণ-পণ দৌঁড়াচ্ছে। একটু বাঁচার আকুলতা নিয়ে, শত্রুমহলকে নিশ্চিহ্ন করতে বাঁচতে হবে। পিতা মুজিব ছাড়া তাঁর পাহাড়সম স্বপ্ন আগলে রেখে মানুষ-মানবতার জন্য কাজ করার উদ্যোম, বছরের পর বছর পিতার আদর্শ লালন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শত্রুর মাঝখানে এতোগুলো দিন দুবোনের ভীষণ কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়ানো, দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরা কান্নাকাটি করা, বেঁচে থাকা, শত প্রতিকূলতার কাছে দমে না যাওয়া, ৮১’র পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন, ২১ আগস্ট বাঙালী জাতিকে আবারও অভিভাবকত্বহীন করা ষড়যন্ত্র মোকাবেলার একটি গল্প বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত ডকুড্রামা ‘হাসিনা ॥ অ্যা ডটার’স টেল’। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেহেতু লেখালেখি আর গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই এই ডকুফিল্মের অধিকাংশ তথ্য-উপাত্তের সঙ্গেও পরিচিত। আবার ডকুফিল্মের স্থিরচিত্র যেমন রিক্সা-ভ্যানে চড়া, ব্যাডমিন্টন খেলা, একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের হাতে রান্না করার দৃশ্যটি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায়- এটিও অনেকের কাছে পরিচিত ছিল। তবে, কেউ রাজনীতি পছন্দ করুক, আর না করুক,‘হাসিনা ॥ অ্যা ডটার’স টেল’ একটি অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার জীবনীভিত্তিক পাশে শেখ রেহানার উপস্থিতি ও তার কণ্ঠ; প্রামাণ্যচিত্র হৃদয় ছুঁয়েছে। ডকুড্রামার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ মিনিট। এখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দেখা যাবে। উঠে আসবে শেখ হাসিনার সাধারণ জীবনের বেশ কিছু অসাধারণ মুহূর্ত। এছাড়াও শেখ হাসিনার জীবনের বিজয়, বিষাদ ও নৈকট্যের দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই প্রামাণ্যচিত্রে দেখা গিয়েছে শেখ হাসিনার দর্শন, একজন ইন্ডিপেনডেন্ট সিটিজেন হিসেবে তিনি ইতিহাসের বড় একটি অধ্যায়কে কীভাবে যতœসহকারে আগলে রেখেছেন। আরেকটি বিষয়ে আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে, ডকুফিল্মটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত, একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত নয়। এখানে শেখ হাসিনার পারসোনাল জার্নি দেখানো হয়েছে এবং এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেফারেন্স হতে পারে, ইতিহাসও হতে পারে। ডকুড্রামার আবহ সংগীতের কাজ করেছেন কলকাতার দেবজ্যোতি মিশ্র। তিনি দৃশ্যের পড়তে পড়তে অসাধারণ আবহ সংগীতযুক্ত করেছেন। আমি কিছুক্ষণ থমকে যাই! কিছুটা নিরবতা আমার মাঝেও কাজ করে। চোখ গড়িয়ে অশ্রুজল পড়ে...! বিশেষ করে ৭৫-এর প্রেক্ষাপট নিয়ে শেখ হাসিনার নিরবতার সঙ্গে আমিও হারিয়ে যাই। রক্ত আমারও টগ-বগিয়ে উঠে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে? আবার এই নিষ্ঠুর মানুষগুলো- এদেশে বসবাস করছে কীভাবে? রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতায় কীভাবে এই বর্বরগুলো অধিষ্ঠিত হয়েছিল-কিছুক্ষণের জন্য আমার ভেতরেও এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে। ‘হাসিনা ॥ অ্যা ডটার’স টেল’ ডকুফিল্মটি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এখানে অতিরঞ্জিত কিছুই করা হয়নি। তবে অজানা বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতে বসবাস করার সময়ও শেখ হাসিনা নিজেদের পরিবারের সকল সদস্যদের হারিয়ে অবশেষে নাম-পরিচয়টুকুও গোপন রাখতে হয়েছে। কতটুকু প্রতিকূল পরিবেশ থাকলে, শত্রুপক্ষের বিষাক্ত রক্ত চক্ষু আড়ালে বাঁচতে নাম পরিবর্তনের তথ্যটুকু চার দশক পর নতুন করে উঠে এসেছে। নির্মাতাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই এখানে যে, দর্শককে পুরো ঘটনার সঙ্গে, প্রতিটি দৃশ্যে সঙ্গে এবং সংগীতের মধ্যে হাঁটাতে পেরেছে বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে। দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও আটপৌরে ও সাদাসিধে জীবনবোধ, দেশ ও জন্মভূমির প্রতি দায় এবং রাজনীতি ও সরকারের সর্বোচ্চ জায়গায় থেকেও সহজ সাবলীল জীবনাচার এই চিত্রের গভীরতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। আরেকটি বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনের সঙ্গে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন দর্শনের একটি চমৎকার মিলবন্ধন এই ছোট্ট চলচ্চিত্রটির মধ্য প্রতীয়মান। শেখ হাসিনার মমত্ব সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু দুইবোন টুঙ্গিপাড়া তাদের শেকড়টিকে যে এত গভীরভাবে লালন করেন, ভালবাসেন, মাঝে মাঝে শৈশবে ফিরে যান- এটি এই প্রথম জানা গেল। বাংলাদেশের বাঙালীরা আমার বাবাকে মারবে, এটা তো ধারণারও বাইরে ছিল...! শেখ রেহানার এই কথার মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তাঁর পরিবারও বিশ্বাস করত; এই দেশের বাঙালীরা কখনও তাদের আঘাত করতে পারে না- এই গাঢ় বিশ্বাসটি। ‘সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল...’ বঙ্গবন্ধু’র পছন্দের গানটি এতোটাই মুগ্ধ করেছে, এতোটাই গভীরে স্পর্শ করেছে- এটি এক অন্য রকম নতুনত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দর্শক এই ডকুফিল্মটি বার-বার দেখবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আজকের কিছু বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছে ছোট পরিসরে এটি অত্যন্ত তথ্যবহুল ডকুফিল্ম। পিতা থেকে কন্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত প্রজন্ম একটি দেশ, একটি জাতিকে কী দিতে পারে- এটিও শিক্ষণীয় বিষয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব, বাংলাদেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে এটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করা জরুরী। সহজ করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে এটিকে তুলে ধরা উচিত। হাসিনা ॥ অ্যা ডটার’স টেল- এ গল্পটি সেই মানুষটির গল্প, যার বাবা শুধু একজন মানুষ ছিলেন না, একজন নেতা ছিলেন না। যার বাবা শুধু তাঁর একার বাবা নন, ১৬ কোটি মানুষের বাবা, জাতির জনক। এই গল্প জাতির জনকের সেই কন্যার গল্প, ১৬ কোটি মানুষের ভালবাসার হাসু বুবুর গল্প। যেখানে অসাধারণের মাঝে সাধারণ। একজন নেতা, একজন যোদ্ধা, একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তিত্ব এবং একজন মানবিক রাজনীতির রাজনৈতিক মনোভাব স্পষ্ট প্রতীয়মানÑ যা নতুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×