ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপরিকল্পিত নগরায়নে ‘মাস্টারপ্ল্যান’ ব্যাহত হচ্ছে

নগর উন্নয়ন নীতিমালা পাঁচ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

নগর উন্নয়ন নীতিমালা পাঁচ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি

মশিউর রহমান খান ॥ দেশের সব নগরের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ’১৪ সালে খসড়া নগর উন্নয়ন নীতিমালা তৈরি করলেও আজ চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি সরকার। পরিকল্পনামাফিক নগর উন্নয়নের জন্য সরকার এই নীতিমালার খসড়া তৈরির পর ৫ বছরেও চূড়ান্ত অনুমোদন না দেয়ায় উন্নয়ন নীতিমালা ছাড়াই চলছে নগরে ইচ্ছেমতো উন্নয়ন কর্মকান্ড ও বড় বড় নির্মাণ কাজ। ইচ্ছেমতো যে কেউ কৃষিজমি ব্যবহার করে যত্রতত্র গড়ে তুলছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ বা বড় বড় আবাসন প্রকল্প। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সরকার এই নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিলে নানা কারণে তা থমকে আছে। সরকারের বিশেষ লক্ষ্য এসডিজি বাস্তবায়নে পরিকল্পনাকে অন্যতম হাতিয়ার বলা হলেও দেশের ৩২৭ পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এতে দ্রুততার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। সরকারী নীতিমালা না থাকায় নগরে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণে চলাচলে রাজধানীসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নাগরিকদের উপর। সঠিক ও পরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমেই কেবল সুপরিকল্পিত নগর গড়া সম্ভব। তাই নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ছাড়া কোনক্রমেই একটি দেশের সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার ’১৪ সালে দেশের সব নগরের পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে। কিন্তু গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের নগর পরিকল্পনা আইন থাকায় এই খসড়া নীতিমালার সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয় নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন বিষয়সমূহ নিরসনে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বৈঠক করে সমস্যা দূর করার পরামর্শ দেয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব দিক চিহ্নিত করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠালে আইন মন্ত্রণালয় কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে পুনরায় পাঠাতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু দুই মন্ত্রণালয় কয়েক দফা বৈঠক হলেও এর সমাধানে তেমন ফল আসেনি। তাই দীর্ঘ দিনেও নগর উন্নয়ন নীতিমালা চূড়ান্ত রূপ পায়নি। বর্তমান সরকার অতি দ্রুত রাজনৈতিক বা প্রয়োজনে উন্নত ক্যাটাগরি অর্থাৎ ক শ্রেণীতে পৌরসভার ক্যাটাগরি নির্ধারণ করলেও শুধুমাত্র সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা না থাকায় ও পরিকল্পনাবিদদের কাজে না লাগানোসহ তাদের কাজের ক্ষেত্র কমানোয় সার্বিকভাবে তেমন উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। একইসঙ্গে দেশের বড় বড় পৌরসভাকে চাহিদার প্রেক্ষিতে সরকারের নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন ঘোষণা করা হলেও শুধুমাত্র নীতিমালা না থাকায় অনেক বড় ড্রেন ছোট-বড় রাস্তা, নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণসহ নানা কাজে পরিকল্পনাবিদদের যুক্ত না করে অন্য পেশার লোকদের যুক্ত করে এসব কাজ সম্পাদন করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে নগরের প্রকৃত সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত কোন নাগরিকের বা নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য কোন পৌরসভায়ই ভূমি ব্যবহারের জন্য আনুষ্ঠানিক কোন ছাড়পত্র দিতে দেখা যায়নি। নগর উন্নয়নে পরিকল্পনাবিদ মূল ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও পৌরসভা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনাবিদদের এড়িয়ে চলে অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রধান কারণ এটা। সরকারের অন্যতম লক্ষ্য দেশকে ভবিষ্যত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে রূপান্তরে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সরজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে নগর পরিকল্পনাবিদ থাকলেও উন্নয়ন কর্মকান্ডে তাদের মতামত নেয়া বাধ্যতামূলক না হওয়ায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা পৌর মেয়রদের ইচ্ছেমতোই দেশের প্রতিটি শহর বা নগরের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড হচ্ছে, যা অনেকটা আশঙ্কার। ক্ষুদ্র বা বৃহত স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা, বাড়ি বা আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবন কিংবা রাস্তাঘাট নির্মাণ করা যাবে কি না অথবা প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে সরকারের কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি তথা নীতিমালা না থাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠছে স্থাপনা। মাস্টারপ্লান ছাড়াই দেশের প্রায় সব পৌরসভায়ই দিব্যি নগর উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সরকার এমনকি মাত্র একদিনের জাতীয় কর্মশালা করেই কোন ধরনের মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া দেশের বিভিন্ন পৌরসভার জন্য সরকার ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানের (সিআইপি) মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, যা ভবিষ্যতে পরিকল্পিত সুন্দর নগর গড়তে ভয়ানক সমস্যার সৃষ্টি করবে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ লোকই বা পাঁচ কোটি লোক নগরে বাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৩ কোটিই ১৭ পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে বসবাস করে। কিন্তু এসব নাগরিকের বসবাসের স্থান নিয়ে সরকার অনেকটাই উদাসীন। ফলে ইচ্ছেমতোই হচ্ছে নগরের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড। সারাদেশের কোন পৌরসভায়ই পরিকল্পনামাফিক নগর উন্নয়ন হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কয়েকটি ছাড়া কোন পৌরসভায়ই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নগর উন্নয়ন করা হচ্ছে না। আবার অনেক পৌরসভায় অতি দুর্বল মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও তার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এমনকি খোদ ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনেই (ডিএনসিসি) কোন নগর পরিকল্পনাবিদ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সিটি কর্পোরেশন বা পৌর মেয়র অথবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ইচ্ছায় নগর উন্নয়ন কর্মকান্ড হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে সাভারের ধামরাই পৌরসভায় মাস্টারপ্ল্যান এখনও গেজেট না হওয়ায় নিজেদের সুবিধার্থেই খসড়া প্ল্যানেই নগরের উন্নয়ন কর্মকান্ড পবিচালনা হচ্ছে। এছাড়া ২০০৬ সালে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও বাস্তবায়ন একেবারেই নেই। উন্নয়ন নগর পরিকল্পনাবিদদের পাশ কাটানোয় অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শহর প্ল্যানে নগর পরিকল্পনাবিদদের কোন ভূমিকাই নেই। সুন্দর নগর বিনির্মাণে দেশের সব নগরের জন্য উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নগর উন্নয়ন নীতিমালা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ সঠিক ও পরিকল্পিত বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার মাধ্যমেই কেবল সুপরিকল্পিত নগর গড়া সম্ভব। তাই নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ছাড়া কোনক্রমেই একটি দেশের সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানে সময়ের চাহিদার কারণে এক যুগ আগের নগর উন্নয়ন নীতিমালা দ্রুত অনুমোদন দিতে হবে, যা পরিকল্পনামাফিক সুন্দর নগরের দেশ গড়তে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
×