ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহাকালী পাঠশালার শতবর্ষ ও একজন স্মৃতিকণা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

  মহাকালী পাঠশালার শতবর্ষ ও একজন স্মৃতিকণা

ফরিদপুর শহরের চকবাজার এলাকার শতবর্ষী পুরনো একটি ভগ্নপ্রায় একতলা ভবন। চুন সুরকির গাঁথুনি। খসে পড়ছে ছাদের টালি। এ ভবনটি প্রয়াত অশুতোষ বসুর। তার ছয় ছেলে ও চার মেয়ে। স্মৃতিকণা বসু অষ্টম সন্তান। তিনি বাদে আর সবাই প্রয়াত হয়েছেন। স্মৃতিকণা বোসের বর্তমান বয়স ৭২। রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত মহাকালী পাঠশালায় দীর্ঘ ৪১ বছর শিক্ষকতা করার পর নিজে থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। ভগ্নপ্রায় ওই জরাজীর্ণ বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। বহুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন স্বামী অরুণ কুমার সেন। নিঃসন্তান স্মৃতিকণা। ওই বাড়িতে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা আছেন। কিন্তু উপার্জনহীন এই বৃদ্ধার খোঁজ কেউ নেন না। এই বয়সে নিজে রান্না করে পেটের আহার যোগাতে নিজেকেই বাজার করা থেকে শুরু করে রান্না করতে হয়। এভাবেই একাকী নিঃসঙ্গতার মাঝে কাটছে স্মৃতিকণার বর্তমান। স্মৃতিকণার দিনকাটে এখন স্মৃতির বেড়াজাল হাতড়িয়ে। জরাজীর্ণ ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় স্মৃতিকণার সঙ্গে। মহাকালী পাঠশালা থেকে অবসর নেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে স্মৃতিকণা বলেন, শিশুদের পড়াতে পড়াতে যদি ভুল করে বসি, ওরা ভুল শিখবে, এটা আমার জন্য কষ্টের হবে। এ ভয়ে নিজে থেকেই ছেড়ে দিলাম চাকরি। ১৯৭৫ সালে ৪৫ টাকা মাসিক বেতন দিয়ে পাঠশালায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন স্মৃতিকণা। নার্সারি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সব শ্রেণীর ক্লাসই তাকে নিতে হতো। কোন ক্লাসে বাংলা, কোন ক্লাসে অঙ্ক, কোন ক্লাসে বিজ্ঞান এভাবেই ছিল তাঁর দৈনন্দিন রুটিন। অবশ্য এর আগে তিনি নিজে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন স্থানীয় সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ থেকে। ৪৫ টাকা বেতন দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে তাঁর বেতন বেড়ে ১৫০, ৫৫০, ৭০০ ও ১০০০ টাকা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি যখন শিক্ষকতা ছেড়ে দেন তখন তাঁর বেতন ছিল এক হাজার টাকা। স্বামীহারা, নিঃসন্তান স্মৃতিকণা চাকরি ছেড়ে দিলে কিভাবে তাঁর দিন চলবে? স্বামী নেই, সন্তান নেই, কোন অবলম্বন নেই। কে দেখবে তাকে। কিভাবে চলবে তাঁর দিনকাল? একথা ভেবে ওই পাঠশালার তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মুকুন্দ লাল শীল রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষকে বলে কয়ে তাঁকে এককালীন ১০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর পাঠশালা পরিচালনা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাঠশালা থেকে প্রতিমাসে তাঁকে ৫০০ টাকা এবং তার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ আরও কিছু টাকা যুক্ত করে স্মৃতিকণাকে প্রতিমাসে প্রদান করবে। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা স্মৃতিকণার জন্য ভাল হয়নি। তার ভাষায়, ‘চাকরি ছেড়ে দেয়ার একমাস পর পাঠশালার তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তুষার ব্যানার্জী তাকে ৫০০টাকা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের পকেট থেকে এ টাকা দিতে হচ্ছে। এ টাকা আমি আর ফেরত পাব না।’ প্রধান শিক্ষকের মুখ থেকে এ কথা শুনে সে টাকায় আর হাত দেননি স্মৃতিকণা। তারপর থেকে গত ২৩ মাসে তিনি একটি টাকাও পাননি। বর্তমানে চরম আর্থিক সঙ্কটে দিনযাপন করছেন এই বৃদ্ধা শিক্ষক। বিভিন্ন জনের কাছে চেয়েচিন্তে চালাতে হচ্ছে পেটের অন্ন। স্মৃতিকণাকে দেখার যেন আজ কেউ নেই। স্মৃতিকণা বলেন, আর্থিক সঙ্কটের কথা কাউকে বলতে পারছি না। আমি অবসরে যাওয়ার সময় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্কুল পরিচালনা কমিটি ও রামকৃষ্ণ মিশন, সেটি কার্যকর হলেও কিছুটা হয়তো চালিয়ে নেয়া যেত। স্মৃতিকণার স্মৃতিধন্য মহাকালী পাঠশালা শতবর্ষ পূর্ণ করেছে এ বছর। এ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী নানান ধরনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই পাঠশালার একজন অবসর নেওয়া শিক্ষক স্মৃতিকণা আজ কি অবস্থায় রয়েছেন তার খবর কি কেউ রেখেছেন? মহাকালী পাঠশালার বর্তমান প্রধান শিক্ষক আড়তি দাস জানান, স্মৃতিকণার জন্য এ পাঠশালা থেকে ৫০০ টাকা ও রামকৃষ্ণ মিশন থেকে কিছু টাকা মাসোহারা হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এটি কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে এ পাঠশালা আর্থিক সঙ্কটে পড়ায় স্মৃতিকণার বিষয়টি আর কার্যকর করা হয়নি। কিন্তু স্মৃতিকণার বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে। তার স্বামী সন্তান নেই তিনি কিভাবে বাঁচবেন। আমরা না দেখলে তাঁকে কে দেখবে। ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের বর্তমান সম্পাদক স্বামী সুরবরানন্দ বলেন, মহাকালী পাঠশালার বর্তমান আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। আমরা চেষ্টা করছি ওই পাঠশালাকে ভাল অবস্থানে নিতে। পাঠশালার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে স্মৃতিকণাকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য প্রদান করা সম্ভব হবে। তবে আপাতত তাকে এককালীন কিছু আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। -অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর থেকে
×