ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই খেমাররুজ নেতার যাবজ্জীবন

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

 দুই খেমাররুজ নেতার যাবজ্জীবন

প্রথমবারের মতো কম্বোডিয়ার নিষ্ঠুর খেমাররুজ শাসন আমলের দুই নেতাকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন খেমার শাসক পল পটের ডেপুটি নুয়ান চিয়া (৯২) ও রাষ্ট্র প্রধান খিউ সাম্পান (৮৭)। চ্যাম মুসলিম ও ভিয়েতনামীদের নিধন করার অভিযোগে জাতিসংঘ সমর্থিত ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারের রায় শুক্রবার ঘোষণা করা হয়। তাদের আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। খবর বিবিসির। দুই খেমাররুজ নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করার রায়টিই হলো খেমাররুজ শাসকদের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গণহত্যা চালানোর অভিযোগের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে নিষ্ঠুর খেমাররুজ শাসনামলে ২০ লাখের বেশি লোককে হত্যা করা হয়। যাদের বেশির ভাগই জাতিগত খেমার। ধারণা করা হয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জোনাথন হেড বলেন, এই বিশাল অংশের হত্যাকান্ড নিয়ে কম্বোডিয়ার মানুষ গণহত্যার আন্তর্জাতিক এই সংজ্ঞা সঠিক মনে করে না। তারা একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। দুই খেমার নেতা ইতোমধ্যে ২০১৪ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আমৃত্যু কারাদ- ভোগ করছেন। ট্রাইব্যুনাল এই দুজনসহ আরও একজনকে এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছে। অপরজন হলেন কাইং গুয়াক ইভ যিনি ডাচ নামে পরিচিত। কুখ্যাত তুওল স্লেং নির্যাতন কেন্দ্র ও কারাগারের কারারক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ২০১০ সালে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। বিচারক নিল নন পম পেনে তার বিশাল ও প্রত্যাশিত রায়টি পড়ে শোনান। আদালত কক্ষটি তখন খেমার রুজের শাসনামলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের দ্বারা পূর্ণ ছিল। দুই খেমার নেতাকে দীর্ঘ তালিকার অতিরিক্ত অপরাধেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে জোরপূর্বক বিয়ে, ধর্ষণ ও ধর্মীয় নিপীড়ন অন্যতম। তবে চূড়ান্ত মুহূর্তটি আসে যখন নুয়ন চিয়াকে চ্যাম মুসলিম ও জাতিগত ভিয়েতনামী কম্বোডিয়ানদের হত্যার অভিযোগে এবং খিউ সাম্পানকে জাতিগত ভিয়েতনামীদের বিরুদ্ধে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আদালত কক্ষে উপস্থিত লোকজন তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। খেমাররুজদের অপরাধকে দীর্ঘকাল ধরে কম্বোডিয়ার গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকরা এই অপরাধে কতটা পরিমাণ অপরাধ করেছেন তার জন্য বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক করেছেন। যদিও চ্যাম মুসলিম ও জাতিগত ভিয়েতনামীদের বিশাল সংখ্যা এতে নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের কনভেনশন অন জেনোসাইডে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে কোন জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ই হচ্ছে গণহত্যা। তাই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা প্রমাণ করেছেন যে, খেমাররুজ বিশেষ করে এই গোষ্ঠীগুলোতে নিধন করার চেষ্টা করেছিল। কিছু বিশেষজ্ঞ যোগ করেন যে, পলপটের জীবনীকার ফিলিপ শট বলেছেন তারা তা করেনি। বিচার চলাকালে ১৯৭৮ সালে পলপটের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যাতে তিনি বলেছেন, কম্বোডিয়ায় যেন একজন ভিয়েতনামীকেও পাওয়া না যায়। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে কয়েক হাজার লোকের একটি সম্প্রদায়কে নির্বাসন বা হত্যার দ্বারা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছে। চ্যাম মুসলিম ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, গণহত্যা ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে শূকর খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও তাদেরকে জোর করে খেমাররা শূকর খেতে বাধ্য করেছিল। আজকের এই রায় পুরো বিতর্কটি শেষ করতে পারবে না। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচারের এই ক্ষণটির জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে আসছেন। সালোথ সারের নেতৃত্বে খেমাররুজ শাসন শুরু হয়েছিল। পলপট নামে পরিচিত ছিলেন সালোথ। সাম্যবাদে দীক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কট্টর মাওবাদী আন্দোলন খেমাররুজ। তারা একটি আত্মনির্ভারশীল কৃষি সমাজ তৈরি করতে কট্টর। যেখানে শহরগুলো খালি হয়ে গিয়েছিল এবং লোকজনকে জোর করে গ্রামীণ সহযোগিতামূলক কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাজ করতে করতে অনেকেই ক্ষুধার্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির কারণে মানুষকে এসব কাজ করতে হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের শাসনামল ছিল সবচেয়ে সহিংসতামূলক সময়। এই চার বছরে খেমাররুজরা নির্যাতন ও হত্যা করেছে সেসব কথিত শত্রুদের যাদের মধ্যে ছিল বুদ্ধিজীবী, সংখ্যালঘু, সাবেক সরকারী কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার। হত্যাকান্ডের মাত্রা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে কর্মকর্তারা যথাযথভাবে নথিভুক্ত করেছে। সে জন্য বিংশ শতাব্দির সবচেয়ে রক্তাক্ত এক শাসন ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের আগ্রাসনের মাধ্যমে এই শাসকগোষ্ঠী পরাজিত হয়। পলপট পালিয়ে যান। ১৯৯৭ সালে তিনি আটক হন। গৃহবন্দী হওয়ার এক বছর পর তিনি মারা যান।
×