ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এক আসনে ৫২, শুভ লক্ষণ বটে

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

এক আসনে ৫২, শুভ লক্ষণ বটে

দলীয় নমিনেশনের জন্য ফরম জমা দেবার সুবাদে ১৪ নবেম্বর বুধবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে যাই সাক্ষাতকার দিতে। প্রার্থীর আধিক্যের কারণে বরাবরের মতো জনে জনে সাক্ষাতকার গ্রহণ একেবারেই অসম্ভব ছিল বলে, শেখ হাসিনা যে আবেগময় ভাষণ দেন তাতে অনেকের চোখে জল আসে। ভাষণটি দিক-নির্দেশনামূলক এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। ভাষণে যেমন ছিল আবেগ, রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম, স্বপ্ন, ভিশন এবং বাংলাদেশের জনগণ। সর্বোপরি এবারের নির্বাচনকে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। জাতীয় সংসদের আসন ৩০০ এবং এই ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ৪০০০-এর ওপরে। জানা যায়, বরগুনার একটি আসনে ৫২টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। নিঃসন্দেহে এটি শুভ লক্ষণ। অন্তত দুই কারণে- প্রথমত, নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশগ্রহণে দলীয় নেতাকর্মীদের আগ্রহ, দ্বিতীয়ত, যাকে নমিনেশন দেয়া হবে তার পক্ষে অন্তত ৫১ জন সিরিয়াস নেতাকর্মী নির্বাচনী কার্যক্রমে ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ দলীয় প্রার্থী তথা নৌকার বিজয়ে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখবে এবং বিজয়ী হয়ে ঘরে ফিরবে। এটি অবশ্যই শুভ লক্ষণ। নেতাকর্মীগণ নিশ্চয়ই অঙ্কের হিসাবটি জানেন। প্রার্থী ৫২ জন হোন আর ৫৫২ জন হোন, নমিনেশন পাবেন ১ জন। অর্থাৎ ১ আসনে ১-এর বাইরে যাবার কোন সুযোগ নেই। এটা সবার জানা। অতএব, তাদের সিরিয়াস হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ের কথা মনে রেখে জানমাল বাঁচানোর জন্যেও সকলকে সিরিয়াস হতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আগে বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার বক্তৃতাও ছিল সুদীর্ঘ এবং এটিও তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা বলে আমার ধারণা। কাদেরের বক্তৃতায় যেমন আসার বাণী ছিল তেমনি রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি। তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ২০০১ এবং ১/১১ কুশীলবরা আবার মাঠে নেমেছে। এতদিন ভেতরে ভেতরে চক্রান্ত করেছে এবার প্রকাশ্যে। এতদিন তারা হুংকার দিয়েছে ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।’ ড. কামাল হোসেন তো এক পর্যায়ে এমনও বলেছেন যে, ‘শেখ হাসিনার বিচার করবেন।’ বিএনপির গয়েশ্বর রায় বলেছেন- “সরকার উৎখাতে প্রয়োজনে রাজপথে ‘শয়তানের’ সঙ্গে ঐক্য করতে প্রস্তুত।” তাহলে বলতে হয়, তাদের সেই ‘শয়তান’ কি ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব, মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতান মনসুর আহমেদ, না মাহমুদুর রহমান মান্না? অবশ্য শেষোক্ত জন এ পর্যায়ে পড়ে কি-না একটা উদাহরণ দেয়া দরকার। ক’দিন আগে নাগরিক টিভির একটি টক-শোতে একসঙ্গে আমার বসার সুযোগ হয়েছিল। সঞ্চালনায় ছিলেন সাংবাদিক নাজমুল আশরাফ। টক-শোর একেবারে শেষের দিকে মাহমুদুর রহমান মান্না বলে বসলেন ‘পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়েও ভাল।’ আমি অবাক হলাম, সমগ্র বিশ্ব যখন অবাক বিস্ময়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে দেখছে, বিশ্বব্যাংকের চীফ ইকোনমিস্ট কৌশিক বসু যখন বলছেন, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ চীনের মতো টেক-অপ করেছে।’ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ যখন বলছে ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।’ এই ক’দিন আগেও আইএমএফ-এর জরিপে দেখানো হয়েছে ‘মানব সম্পদ উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে।’ মান্না সাহেবকে সাম্প্রতিক এই তথ্যটি স্মরণ করিয়ে বলেছিলাম আপনি বিশ্বস্বীকৃত ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করছেন। এর পেছনে রহস্য কি জানি না। তবে একটা উদাহরণ দিচ্ছি-‘পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটার ইমরান খান এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, ‘আমাকে ৫টি বছর সময় দিন, আমি পাকিস্তানকে সুইজারল্যান্ড বানিয়ে দেব (হামে পাঁচ সাল দিজিয়ে, হাম পাকিস্তান কো সইজারল্যান্ড বানা দেয়েঙ্গে)।’ মতবিনিময়ে উপস্থিত এক সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পাঁচ বছর কী, আপনাকে আরও ৫ বছর, অর্থাৎ ১০ বছর দিচ্ছি, আমাদের একটা বাংলাদেশ বানিয়ে দিন (পাঁচ সাল ক্যায়া, আপকে আওর ৫ সাল ইয়া’নে ১০ সাল দেতা হো, আপ হামে এক বাংলাদেশ বানা দিজিয়ে)। টকশোর শেষ পর্যায়ে কথা হয় তাই আর কোন কথা বলতে পারেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটা ব্র্যান্ড (Bangladesh is a brand now)। এর এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সময় এবং ২০১৩, ১৪-এর দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আসন্ন নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াত সুযোগ পেলে একইভাবে হত্যা, চোখ উপড়ানো, হাত-পা কেটে পঙ্গু করা, হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থকদের ওপর একইভাবে নির্যাতন চালাবে। একই সঙ্গে আমরা যে পদ্মা সেতু (৬২% কাজ সম্পন্ন), পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সমুদ্র বিজয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ৩২০০ মেগাওয়াট থেকে ২০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা, কিংবা কৃষি উৎপাদন, মৎস্য উৎপাদন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মানব সম্পদ উন্নয়ন, অর্থাৎ মধ্যম আয় থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উন্নত দেশের মহাসড়কে হাঁটার মাধ্যমে ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী উৎযাপনের সকল পথ তারা বন্ধ করে দেবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উত্তরণ এবং ২১০০ সালের ডেল্টা প্রকল্পও বন্ধ করে দেবে। সর্বোপরি চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যার নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারও বন্ধ করে দেবে। তারা বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করবে। তারেক রহমানের মতো ক্রিমিন্যালকে আবার দেশে এনে লুটপাট-মানি লন্ডারিং শুরু করবে। এই কথাটা মনে রেখেই যাকে নমিনেশন দেয়া হবে তার পক্ষে সকলকে কাজ করতে হবে, দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। একেকটি কনস্টিটুয়েন্সিতে একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। তারা ডিজার্ভও করে, কিন্তু একজনের বেশি তো নমিনেশন দেয়া যাবে না, তাই অনেক দিক বিবেচনা করে একজনকে প্রার্থী করা হবে। ঐ একজন হবেন সকলের প্রার্থী। তার পক্ষেই সকলকে কাজ করতে হবে। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের জিততেই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী বানাতে হবে। সে জন্য দরকার পার্লামেন্টের মেজরিটি আসন এবং আপনারাই সেই আসন নেত্রীকে উপহার দেবেন। নইলে ২০০১ এর পরের পাঁচ বছর কিংবা ২০১৩ থেকে ১৪ পর্যন্ত যেভাবে হত্যা, হাত-পা কাটা, লুটপাট, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে এবার তারচেয়েও বেশি করবে। খালেদার সঙ্গে যোগ হবে ক্রিমিন্যাল পলাতক তারেক রহমান। সুযোগ পেলে কচুকাটা করবে। আর মনে রাখবেন কেউ বিদ্রোহ করলে এবার চিরতরে বহিষ্কার করা হবে। আগের মতো মাফ করা হবে না।’ এবার একটা কেস স্ট্যাডি চিত্র তুলে ধরতে চাই। চাঁদপুরের একটি নির্বাচনী আসন। ২০০১ সালে ঐ আসনে যাকে নমিনেশন দেয়া হয় তিনি যোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির নির্বাচনী কারসাজি অর্থাৎ বেশ কিছু কেন্দ্রে আগে থেকে ধানের শীষে সিল মারা ব্যালট ভর্তি বাক্স লুকিয়ে রাখা হয়। গণনার সময় সে সব বাক্সও গুনে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ঐ সময় সেনাবাহিনীও বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে। এলাকার এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রশীদ পাটোয়ারী ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদুল্লা তপাদারকে লাঠি-রড দিয়ে পিটিয়ে মরে গেছে মনে করে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে ফেলে রাখে। গ্রামের কয়েকজন যুবক তাদের তুলে নিয়ে সেবা দেয়। খবর পেয়ে নৌকা প্রার্থী এ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের ঢাকায় এনে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেয়। ঐ থানার সর্বত্র এমন নির্যাতন চালানো হয়। পুকুরের মাছ, রাস্তার পাশের গাছ লুট করা হয়, বাজারে বাজারে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে তবে দোকান খুলতে পারে, শত শত নৌকার সমর্থক, ছাত্র, যুবক ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। তাদের অনেকেরই দিন কেটেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও ফুটপাথে। ২০০৮-এ যখন দেশব্যাপী নৌকার বিজয় তখনও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারানো হয়। সেবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে নিজ দলেরই একজন। তিনি প্রথমে তার অনুসারীদের ‘না’ ভোট দিতে বলেন। পরে নৌকার জোয়ার দেখে সরাসরি ‘ধানের শীষে’ ভোট দিতে বলেন। তার বক্তব্য ছিল ‘প্রার্থী জিতে গেলে, ভবিষ্যতে তার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।’ তার চক্রান্তে পানি ঢালে থানার নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রশাসন। কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, কোনভাবেই এবার অবহেলা করা যাবে না। ব্যক্তিস্বার্থ-গোষ্ঠীস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। যে সব নেতা নির্বাচনের দিন পান চিবোতে চিবোতে বিড়ি টানতে টানতে ১০/১১ টার দিকে কেন্দ্রে যাবার অভ্যাস তাদের সেই অভ্যাগ ত্যাগ করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না শেখ হাসিনা আমাদের আওয়ামী লীগ তথা দেশ ও দেশবাসী তথা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের চেতনা, মূল্যবোধ ও মূলধারার জন্য যেমন সর্বশক্তিমান আল্লাহপাকের আশীর্বাদ তেমনি দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির জন্যও আশীর্বাদ। এসব মনে রেখেই আগামী নির্বাচনে কাজ করতে হবে। উপস্থিত ৪ সহস্রাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী হাত তুলে ওয়াদা করে আসেন। ঢাকা ॥ ১৫ নবেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×