ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আনা বার্নস ॥ সাহিত্যে ম্যানবুকার জয়ী

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

আনা বার্নস ॥ সাহিত্যে ম্যানবুকার জয়ী

এ বছর ‘ম্যান বুকার পুরস্কার-২০১৮’ অর্জন করেছেন উত্তর আয়ারল্যান্ডের ঔপন্যাসিক আনা বার্নস। এর ফলে প্রথমবারের মতো উত্তর আয়ারল্যান্ডের কোন সাহিত্যিক ম্যান বুকার পুরস্কার বিজয়ের গৌরব অর্জন করলেন। ‘মিল্কম্যান’ নামক উপন্যাস লিখে তিনি সাহিত্যের এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেলেন। এক স্বল্প বয়স্কা নারীর ওপর এক ক্ষমতাধর পুরুষের যৌন হয়রানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। পুরস্কার বিজয়ের ফলে তিনি পাচ্ছেন ৫০ হাজার পাউন্ড; যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। এটি আনা বার্নস-এর তৃতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটিতে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্বল্প বয়স্কা নারীর নিজস্ব কোন নাম নেই। তাকে ডাকা হয় ‘মিডল সিস্টার’ বা মেঝো বোন হিসেবে, যার বয়স মাত্র ১৮ বছর। আর ক্ষমতাধর পুরুষটি আধাসামরিক বাহিনীর একজন সদস্য, নাম মিল্কম্যান। বয়সের দিক থেকে বেশ প্রবীণ। তাদের মধ্যকার প্রেমের গুঞ্জন, যৌন সহিংসতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের নানা গল্প উঠে এসেছে উপন্যাসটির বর্ণনায়। ম্যান বুকার কমিটির প্রধান নির্বাচক ও বিশিষ্ট দার্শনিক কোয়াম এন্থনি এ্যাপিয়াহা উপন্যাসটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এটি একটি অসাধারণ মৌলিক কর্ম। এর আগে আমাদের মধ্যের কেউই এ ধরনের লেখা পড়েননি। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও মোহনীয় ঢঙে আমাদের সামনে তিনি এই বিস্ময়কর গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। আনা বার্নাস আমাদের সামনে পুরোপুরি ভিন্নধর্মী একটি গল্প তুলে ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত নানা বিতর্কের সমুচিত জবাব দিয়েছেন; নতুন চিন্তা ও অবিশ্বাস্য কল্পনা শক্তির গদ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এখানে তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও ক্রমবর্ধমান হুমকির বিষয়গুলোকে ব্যঙ্গাত্মক অথচ তীব্র মর্মভেদী ভাষায় তুলে ধরেছেন। মিল্কম্যান নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানুষ মনে করতে থাকেন। এজন্য তিনি হয়ে ওঠেন অমানবিক। জড়িয়ে পড়েন নানা যৌন সহিংসতায়। কিন্তু এক পর্যায় গিয়ে আরেক চরিত্র স্লোডেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক কেননা মানুষ যখন ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যায়, তখন সে আর পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। ৫৬ বছর বয়সী আনা বার্নস তার অভিমত ব্যক্ত করেনÑ উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে আমি আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ও ধ্যান-জ্ঞান লেখালেখির মধ্যে প্রদান করার চেষ্টা করি। এভাবেই আমি আমার উপন্যাসগুলোকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। যদিও আমার লেখালেখির প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। যেমন আমি আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো ঠিক করতে বহুদিন সময় নিয়ে থাকি। উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে আনা বার্নসের আগে কেউ ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করতে পারেননি। ২০১৩ সালের পর তিনিই প্রথম নারী, যিনি ম্যান বুকার বিজয়ের গৌরব অর্জন করলেন। এর আগে ২০১৩ সালে ইলানর ক্যাটন নামের এক লেখিকা এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। এই পুরস্কার অর্জন করতে গিয়ে আনা বার্নাসকে অনেক বড় বড় লেখকদের পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে। যেমন আমেরিকান সাহিত্যিক হেভিওয়েট রিচার্ড পাওয়ার ও ডেজি জনসন, কানাডার লেখক ইসি ইদুইগান প্রমুখ। এরা সকলেই পুরস্কার প্রাপ্তির সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন। এ বিষয়ে ম্যান বুকার কমিটির প্রধান বিচারক এ্যাপিয়াহা বলেন- বিচারকগণ যে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছিলেন সেখানে থেকে বিচারকদের ‘ঐক্যমতের’ ভিত্তিতে সেরা বিষয়বস্তু সংবলিত রচনাটিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রভাবকে আমলে নেয়া হয়নি। আমেরিকান লেখকদের প্রতি স্বজনপ্রীতি করা হতে পারে এমন গুঞ্জনও সত্য হয়নি, কেননা ম্যান বুকার কর্তৃপক্ষ সকল প্রকার বিতর্কের উর্ধে থাকতে চায়। আনা বার্নস ১৯৬২ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফেস্টে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ইস্ট সাসেক্সে বসবাস করছেন। তার রচিত অন্য দুটি উপন্যাস হলো ‘নো বোনস (২০০১)’ এবং ‘লিটিল কনস্ট্রাকশনস (২০০৭)’। এরপর দীর্ঘ অবসর ভেঙ্গে ‘মিল্কম্যান’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি আবার লেখালেখির জগতে ফিরে আসলেন। তিনি তার নতুন উপন্যাসের মূল কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন- উপন্যাসটিতে এমন একটি জায়গার বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ সহিংসতা বিরাজমান; সেখানকার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড সন্দেহ-অবিশ্বাস; মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে প্যারানিয়া বা বিকৃতমস্তিষ্কের বিশেষ রোগে। দার্শনিক এ্যাপিয়াহার মতে, উপন্যাসে বর্ণিত ১৮ বছর বয়সী মিডল সিস্টার এমন একটি বিভক্তিমূলক সমাজে বসবাস করেন, যেখানে পুরুষরা যদি কোন নারীর প্রতি যৌনাকর্ষণ অনুভব করেন, তাহলে তাকে যৌন হয়রানি শুরু করেন। এজন্য তারা সমাজে বিরাজমান বিভক্তির সুযোগকে কাজে লাগান। আর এই বিভক্তি থেকে উৎসারিত ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে একদল ক্ষমতাধর পুরুষের হাতে। এভাবেই গল্প আগাতে থাকে। উপন্যাসে মূলত আয়ারল্যান্ডে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক বিভক্তির করুণ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র যে উত্তর আয়ারল্যান্ডে এমন বিভক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা চালু আছে তা তো নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই এমন শোষণমূলক ব্যবস্থাপনা চালু রয়েছে। আর টিএস ইলিয়ড বলেছেন, ‘আপনি বিশেষ না হয়ে সর্বজনীন হতে পারবেন না’- এই উপন্যাসটি একটি বিশেষ কাজ এবং যা লেখিকাকে সর্বজনীন করে তুলতে সাহায্য করবে। কোন সাহিত্য সর্বজনীন কিংবা বিখ্যাত হয়ে উঠতে হলে সাধারণত বাস্তব সমাজ ও মানসের সঙ্গে তার কোন না কোন সংযোগ থাকতে হয়। ফলে মিল্কম্যান উপন্যাসটিও আজকের সমাজের সঙ্গে বেশ প্রাসঙ্গিক। এটি আমাদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যেমনটি বলছিলেন দার্শনিক এ্যাপিয়াহা: আমি মনে করি এই উপন্যাস মানুষের মধ্যে #মি টু আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দিতে পারে। এটি আমাদেরকে গভীরভাবে নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সচেতনতামূলক বার্তা প্রদান করতে পারে। পাশাপাশি #মি টু আন্দোলনের প্রতি আসা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতেও বইটি আমাদের সহায়তা করতে পারে। মূলত ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত উত্তর আয়ারল্যান্ডে চলমান ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট সহিংসতার কালখণ্ডকে ধারণ করে এই উপন্যাসটি রচনা করা হয়েছে। ধর্মের নামে এই যে বিভক্তি তা সমাজে নানাভাবে অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদিকে উস্কে দেয়। সেসব ঘটনার রূপক উপস্থাপনা উঠে এসেছে ‘মিল্কম্যান’ উপন্যাসের বর্ণনায়- যা একটি প্রতিবাদও বটে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রতিবছর সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার দেয়। নোবেল পুরস্কারের পর এটিকেই বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে এই পুরস্কার দিয়ে আসা হচ্ছে তবে তখন থেকে শুধু ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য চর্চাকারী লেখক তথা যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশের লেখকদের এই পুরস্কার দেয়া হতো। ২০১৪ সাল থেকে আমেরিকার লেখকদেরও ম্যান বুকার পুরস্কারের আওতাভুক্ত করা হয়।
×