ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

থ্রি নভেলস ॥ বিশ্বসাহিত্যে সংযোজন

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

থ্রি নভেলস ॥ বিশ্বসাহিত্যে সংযোজন

ভারত সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নোশনপ্রেস প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের তিনটি উপন্যাসের ইংরেজী অনুবাদ ‘থ্রি নভেলস’। উপন্যাস তিনটির নাম যথাক্রমে ‘তালিবান পাক কান্ল এ্যান্ড আ ইয়াং লেডি’, ‘ফ্লেমিং ইভেনটাইড’ এবং ‘দ্য ফ্ল্যাটারার’। বই বিপণনের কাজে নিয়োজিত আমাজনসহ আরও প্রায় দশটির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে নোশন প্রেস মোস্তফা কামালের উপন্যাসত্রয়ীর বিপণনের কাজ করছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রচিত সাহিত্যের ইংরেজী অনুবাদের কাজ আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় চোখে পড়ার মতো। স্বভাবতই বাংলা সাহিত্যের প্রতিও বিশ্বপাঠকের আগ্রহ জাগতে পারে। অনুবাদের মাধ্যমে তারা আমাদের সাহিত্য পাঠের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই প্রকাশকরা বাংলা সাহিত্যের ইংরেজী অনুবাদের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন। তাঁর উপন্যাসের ইংরেজী অনুবাদ প্রসঙ্গে মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারের রত্ন সম্পর্কে বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের জানার আগ্রহ আছে। সে বিষয়টি বুঝতে পেরে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন প্রকাশকরা। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন বাংলা সাহিত্যের যেটুকু অনুবাদ হয়েছে তা চোখে পড়ার মতো নয়। আমাদের সাহিত্যে, বিশেষ করে আমাদের দেশের সাহিত্যে আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি কিভাবে কতটুকু এসেছে বা আসছে তা অন্যদের কাছে তুলে ধরার একমাত্র বাহন হলো অনুবাদ।’ মোস্তফা কামালের উপন্যাস তিনটির মধ্যে প্রথমটির শিরোনাম ‘তালিবান পাক কান্ল এ্যান্ড আ ইয়াং লেডি’। এ উপন্যাসটির কাহিনীতে দেখা যায় আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান, পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের আধিপত্য বিস্তার এবং সাধারণ মানুষের জীবনে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ প্রভাব। রাজনীতি, ইতিহাস এবং সর্বোপরি জঙ্গীবাদের ভয়াল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এখানে। উপন্যাসের কাহিনীর সঙ্গে দেখা যায় বাস্তবের ঘনিষ্ঠ যোগ। পাকিস্তান এবং আশপাশের এলাকার চলমান অস্থিরতার চিত্র দেখতে পাওয়া যায় এ উপন্যাসটিতে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্যর্থ এবং জঙ্গীবাদের জন্য খুব উপযুক্ত একটা ক্ষেত্র হলো পাকিস্তানÑ এ সত্যটি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। ঔপন্যাসিকের স্পষ্ট দূরদৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর এ উপন্যাসে। এটি প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর আশঙ্কার বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়া যায় পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া কতিপয় ঘটনার মধ্যে। ওসামা বিন লাদেনের পাকিস্তানে অবস্থান, ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি আর্মি পাবলিক স্কুলে তেহরিক-ই-তালেবান জঙ্গীগোষ্ঠীর ছয় বন্দুকধারী সশস্ত্র আক্রমণ করে। জঙ্গীরা স্কুলে ঢুকে শিশু এবং স্কুলের শিক্ষক কর্মকর্তাদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। মোট নিহতের সংখ্যা ১৪৯। তাদের মধ্যে ১৩২ জনই ছিল শিশু। এ উপন্যাসের কাহিনীতে প্রধান চরিত্র হিসেবে এসেছে এসেছে বাংলাদেশী যুবক সাকিব এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মেয়ে মাহাভেস। তাদের দুজনের গভীর প্রেম উপন্যাসটির শুরুতে পাঠকমনে যে আশার সঞ্চার করে সেটা অচিরেই আশঙ্কায় ডুবে যায়। তালেবানদের হাতে বন্দী সাকিব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পার করে। তার অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয় তালেবানদের ভয়াবহ জঙ্গী আচরণের প্রকাশ্য রূপ দেখার অনুভূতি। কঠিন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সাকিবের জীবনের চরম একটা অধ্যায় শেষ হয়। উপন্যাসের কাহিনীও সমাপ্ত হয় সেখানেই। ‘তালিবান পাক কান্ল এ্যান্ড আ ইয়াং লেডি’ উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন দুলাল আল মনসুর। মোস্তফা কামাল নিজে অনুবাদ করেছেন দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ফ্লেমিং ইভেনটাইড।’ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি হয়েছে এ উপন্যাস। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্টো দিকে ঘুরে যায়। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ছিল, যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি তারা ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে নানাভাবে ফুলেফেঁপে ওঠে। হƒতশক্তি ফিরে পেয়ে তারা স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দেয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে আর্থিকভাবে শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। রাজনীতির সাময়িক পরিবর্তনের ধারায় তারা ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার অংশীদারও হয়ে যায়। ক্ষমতার দাপটে তারা অপশক্তির যথেচ্ছ অপব্যবহার দেখাতে থাকে। দেশের অবস্থা পুরোপুরি নাজুক হয়ে পড়ে অপশাসনের অধীনে। যারা বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন তাদের জীবনই অন্যায় অত্যাচারের সামনে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম এক সময় গতি ফিরে পায়। খারাপ লোকেরা অবধারিতভাবেই পরাজিত হতে বাধ্য হয়। শুধু মাঝখান থেকে নিষ্পাপ মানুষদের অনেক ক্ষতি করে ফেলে তারা। বাংলাদেশের ইতিহাসের এ রকম বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘ফ্লেমিং ইভেনটাইড’। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হুমায়ূন কবির। তার বিপন্ন জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তার ছেলের জীবনটাই হারিয়ে ফেলে অপশক্তির প্রতিনিধি শরিফুল আজমের কুচক্রে। রাজাকার শরিফুল আজম তার মেয়ের আত্মহত্যাকে খুন বলে চালিয়ে দেয়। পরিবেশ পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য নিচের কথাগুলো যথার্থই বটে : When Humayun narrated his encounter with Ayam to his wife, she became speechless. She thought, ‘Can a man stand so low? Hwo can he turn a suicide into a murder? Innocent Akmal has been implicated in that very case. Those people are not human beings.’ হুমায়ূনের ছেলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা হয়। মামলার প্রেক্ষিতে তার ছেলে আকমল কবির পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মারা যায় পুলিশের অত্যাচারে। অবশ্য সাধারণ মানুষের বিবেক এক সময় জেগে ওঠে; তাদের কণ্ঠ সরব হয়। তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এ উপন্যাসের ট্র্যাজিক ঘটনা একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়। ‘থ্রি নভেলস’-এর তৃতীয় উপন্যাসটি হলো ‘দ্য ফ্ল্যাটারার’। এটি একটি ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস। সমাজে যারা বিভিন্ন স্তরে থেকে অবিরাম ওপরে ওঠার অবৈধ চেষ্টা চালিয়ে যায় তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এখানকার চরিত্ররা। ওপরে ওঠার জন্য তারা ওপরের স্তরের লোকদের তোষামোদ করে। এ উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম তেলাওয়াত। কর্মক্ষেত্রে ওপরে ওঠার জন্য এবং ক্ষমতা উপভোগ করার জন্য তার বসকে তোষামোদ করতে থাকে অবিরাম। তার লক্ষ্য হলো নিজের স্বার্থ আদায় করা। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্য সহকর্মীদের বঞ্চিত করতে দ্বিধাবোধ করে না সে। আমাদের চারপাশে দেখা যায়, বড় বড় পদে বসে অনেক মানুষ অহরহ অপরাধ করে যাচ্ছে শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশে। তারা আপাত-শিক্ষিত; কিংবা বলা যায়, তারা সার্টিফিকেটধারী স্বার্থপর মানুষ। এ উপন্যাসের চরিত্র তেলাওয়াত, হাবিবুর রহমান এবং তাদের চারপাশের মানুষেরা একে অন্যকে টপকে, ওপরওয়ালাদের ধরে বস্তুগত সুবিধা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তবে নিজের অবস্থান অটুট রেখে ওপরের দিকে ওঠার এই তোষামোদী কৌশলটা অবিরাম সতর্ক পাহারায় রাখতে হয়। সে কারণেই তোষামোদকারীদের জীবন নিরিবিলি শান্তির জীবন নয়। তাদের খেয়াল রাখতে হয়, কোন ফাঁক দিয়ে অন্য কেউ বুঝি ওপরে উঠে গেল। যেমন উপন্যাসের শেষেও দেখা যায় তেলাওয়াতের দুশ্চিন্তার শেষ নেই : Mr. Telawat talks to himself, ‘I am the greatest flatterer of the office to be sure. Still I am being defeated! It means there is a greater flatterer than me! Who is that flatterer? Who is that flatterer!’ ‘দ্য ফ্ল্যাটারার’ অনুবাদ করেছেন মাসুম বিল্লাহ। আন্তর্জাতিক বিষয়ে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন মোস্তফা কামাল। যুদ্ধাপরবর্তী আফগানিস্তানের অবস্থা, নেপালে রাজতন্ত্রবিরোধী গণঅভ্যুথ্যান, পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো হত্যাকা- এবং শ্রীলঙ্কায় তামিল গেরিলা সঙ্কট সম্পর্কে সরাসরি খবরাখবর সংগ্রহে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এ ছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ভারত, ভুটান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, জাপান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। কলামিস্ট হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। কালের কণ্ঠে ‘সময়ের প্রতিধ্বনি’ এবং ‘রঙ্গ ব্যঙ্গ’ নামে দুটো কলাম লিখছেন।
×