ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহৎ জীবন ভাবনার কবি

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

মহৎ জীবন ভাবনার কবি

‘সেটা সত্য হোক . শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ। / সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যেও খ্যাতি করা চুরি /ভালো নয়, ভালো নকল সে শৌখিন মজদুরি।’ রবীন্দ্রনাথ। আজকাল কবিতার নামে অনেকেই কেবল ভঙ্গি বা আঙ্গিকের চর্চা করেন। যাপিত জীবন অভিজ্ঞতার ছোঁয়া থাকে অনুপস্থিত। ফলে তারা কবিতার মাঠে অর্থহীন শব্দের চিটা উৎপাদনই করেন। কবি মতিন বৈরাগীর ভিন্নতা এখানে যে তিনি সোনালি ফসলের পরিশ্রমী কৃষক। তাঁর ২য় কাব্য ‘কাছের মানুষ পাশের বাড়ি’ পাঠ করা মাত্র একজন সমাজ মনস্ক, রাজনীতি সচেতন, প্রতিবাদী এবং একই সঙ্গে মৃদুভাষী কবির কণ্ঠস্বর শ্রাব্য হয়ে ওঠে। এই কাব্যগ্রন্থের ‘মানসিক খরার দিন’ শীর্ষক কবিতার- ‘যদি কেউ কোন দিন ক্রোধের উজ্জ্বলতায় হাতে নেয় হাতিয়ার যদি চিৎকারে জ্বলে ওঠে প্রচ- ঝাঁকুনিতে উল্টে ফেলে পুরনো বিশ্বাস নির্ঘাত দেশব্যাপী শুরু হবে মানবজয়ের তুঙ্গ জোয়ার...’ চরণগুলো স্পষ্ট করে দেয় মতিন বৈরাগীর কাব্যমানস এবং কাব্যকৌশল। এসব চরণের মধ্যে পুরাতন বাসি-পঁচা অচলায়তনকে ভেঙ্গে ফেলে আলোকোজ্জ্বল দিন প্রত্যাশার প্রেরণা ও প্ররোচনা রয়েছে। পেছনে যুক্তি হিসেবে রয়েছে প্রকৃতি (নদী ও পাখি) এর সমর্থন সহযাত্রীয় শরিক হওয়ার ছবি। তিনি নতুন কিছু করার আশায় বুক বেঁধেই পুরাতনকে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। উন্নততর জীবন ব্যবস্থার জন্য যে পরিবর্তন, তারই নাম প্রগতিশীলতা। তিনি যখন বলেন, ‘প্রিয়তম ঝরে যাচ্ছি পুড়ে যাচ্ছি তবু রেখে যাই কিছু আশা রঙ অনন্ত পাবার এক ইচ্ছে রেখে যাই তুষার অমল অমেঘ ফুল্লবিথী ফিরে যাওয়ার পথে পথে স্বপ্নের সোনালী হাত’। তখন তাঁর শুভবাদী কাব্যভাবনা সোনালি রঙে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিদগ্ধ পাঠকের সামনে। কবি মতিন বৈরাগী দার্শনিক প্রজ্ঞায় গভীরচারী। জীবন ও জগতকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর অন্যতম প্রধান সহায়। তিনি জীবন-জগতের উপরি কাঠামো দেখে তৃপ্ত না থেকে তার গভীরে প্রবেশ করেন। পাল তোলা নৌকার সৌন্দর্য দেখে তাঁর চোখ জুড়ালেও তৃপ্তি হন না। ঐ পালের রশি ধরে থাকা হাতগুলোর বেদনা ও বঞ্চনা, হাতগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আড়ালের অজ¯্র জীবনের সুখ-দুঃখকে স্পর্শে করতে চান। জীবনশিল্পী বলে জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করে নতুন মাত্রা দিতে চান শিল্পে। তাঁর এসব প্রয়াসে উদ্দেশ্যবিহীন নয়, লক্ষ্যহীনও না। তাঁর কাব্য সাধনার মূলে রয়েছে উদার, মহৎ ও মুক্ত জীবনের স্বপ্ন। তিনি যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সভ্য, যা কিছু মহৎ, যা কিছু উদার, সেসব কিছুর সমর্থক। কিন্তু একটি সমাজকে, একটি রাষ্ট্রকে একটি রাজনৈতিক দলকে, একটি পৃথিবীকে সুন্দরের দিকে, সভ্যতার দিকে মহত্ত্বের দিকে টেনে নিয়ে যেতে হলে ব্যক্তি-সমাজ, রাষ্ট্র-সংঘ যে সকল ব্যাধিতে আক্রান্ত তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। কবি মতিন বৈরাগী একজন জীবন-দার্শনিকের মন নিয়ে সেসব কাজ করার প্রয়াস চেষ্টা করেছেন এবং ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। মতিন বৈরাগী ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে সৌহার্দ্যরে অভাব, আন্তঃগোষ্ঠী বিবাদ, আন্তঃবর্ণ বিদ্বেষ, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ, জাতিতে জাতিতে রক্তপাত, পরিবেশ দূষণ, গুম-খুন- লোপাট-শোষণ-নির্যাতন, গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতি উপসর্গগুলো ধরে ধরে মূল রোগ বা রোগসমূহ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সেসব রোগ শনাক্ত করেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভালোবাসার অভাব। ব্যক্তি যদি ব্যক্তিকে ভালোবাসে, জাতি যদি আরেক জাতিকে ভালোবাসে, রাষ্ট্র যদি অন্য রাষ্ট্রকে ভালোবাসে, এক ধর্মের লোক যদি অন্য ধর্মের লোককে ভালোবাসে, তবে পৃথিবীর অনেক সমস্যাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না বলে সমাজে, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গন এত বিদ্বেষপূর্ণ বঞ্চনা ও শোষণ ক্লিষ্ট। এ প্রসঙ্গে মতিন বৈরাগীর ‘চলো ভেঙে ফেলি’ কাব্যগ্রন্থের ‘অভাব’ শিরোনামে কবিতাটি উদ্ধৃতিযোগ্য: ‘ভালোবাসার জন্য কাতরাচ্ছে প্রাণ; বনভূমিও ভালোবাসার জন্য সারা পৃথিবীতে তোলপাড় রাজ্য রাজত্ব হিক্কা তুলছে পাহাড়ে পর্বতে ঠুকাঠুকি আলিঙ্গনে গেছে ঘাতকের হাত পুড়ছে শহর বসতি অঘোষিত যুদ্ধ শরণার্থী মানুষ ভালোবাসা পুড়ছে কামানে বন্দুকে আগুনে বোমায় মেলে না কোথাও প্রশান্তি; কাঁটাতারে ঝুলছে ফালানি—’ এই যে ভালোবাসার অভাব, এটি হচ্ছে সকল সমস্যার মূল। যে মানুষের অন্তরে অন্যদের জন্য ভালোবাসা নেই, ভালোবাসা নেই প্রকৃতির জন্য, তার পক্ষে খুন জখম-ধর্ষণ- শোষণ-যুদ্ধ সন্ত্রাস সবকিছু করা সম্ভব। ব্যক্তি নষ্ট হলে সংগঠন, সমাজ, রাষ্ট্র সবই রসাতলে যায়। সমাজমনস্ক কবি মতিন বৈরাগীর চোখে এ সময়ের মানুষ নষ্টামি তীব্র হয়ে ধরা পড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের, রাষ্ট্রের সক্ষমতায় রয়েছে দুর্বৃত্ত প্রকৃতির ব্যক্তিগণ। আর অবশিষ্ট ব্যক্তিগণ ভেড়ার পালের মতো বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে দুর্বৃত্তদের চাপিয়ে দেয়া শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব। ফলে সমাজে রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত সংঘটিত খুন-ধর্ষণ-ঘুষ-ছিনতাই-রাহাজানি-গুম-অপহরণ-লুটপাট-দাঙ্গাহাঙ্গামা-চাঁদাবাজি-যুদ্ধ-গণহত্যা এসবের বিরুদ্ধে কোন সুসংগঠিত প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। মতিন বৈরাগীর কলমে ব্যক্তির অধঃপতনের ছবিগুলো শৈল্পিক সুন্দরে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর ‘চলো ভেঙে ফেলি’ কাব্যগ্রন্থের ‘পশ্চিম রণাঙ্গন কি থেমে গেছে’ শিরোনামের একটি কবিতা- ‘মানুষের কান্না ছিলো কান্না ছিল এখন পাথর মানুষের প্রতিবাদ ছিল প্রতিবাদ ছিলো, এখন নির্বোধ মানুষের রাগ ছিলো দ্রোহ ছিলো-আশার উত্তাপ মানুষ নির্জীব কিছু নেই কিছু নেই কেবল মানুষ জমাট বরফ... মানুষের মানুষ নেই মানুষ নেই সুচির বন্দুক ... ব্যক্তির এ অধঃপতন ঘটাচ্ছে যে শক্তি, তা হচ্ছে মানুষ সৃষ্ট চরম পঁজিবাদ নির্ভর ছদ্মবেশী সা¤্রাজ্যবাদ এবং ধনিক শ্রেণী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্র। পুঁজিবাদ মানুষকে পণ্য বানিয়ে ফেলে। নারী হয়ে ওঠে সেক্স পণ্য। শ্রমিক হয়ে যায় ক্রীতদাস। শিল্প সংস্কৃতি-মিডিয়া সব হয়ে যায় পণ্য প্রচারের মাধ্যম ও বাহন। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষে কবজায় নেয় প্রচারযন্ত্র, সিনেমা, নাটক, টিভি-সিরিয়াল সর্বত্র তাদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। নারীকে কসমেটিক ও গয়না ভুলিয়ে দিয়ে করে তোলে পণ্য ও পণ্যের খরিদ্দার। ফলে পণ্য মানুষ বুঝতেও পারছে না যে তারা পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আবার নিজেরাই পণ্য সংস্কৃতির দাসে পরিণত হচ্ছে। ‘ভালোবাসা আজ আর গায় না জীবনের গান সে কেবল তড়পায় ইহুদী রমণী- মার্কিনীরা নাচে ব্রা ফ্রি ডে হংকংয়ে হাসে চিনা রমণী হলিউড নাচে বলিউডে, বলিউডে কত বিনিময় প্যারিস ঢুকে পড়ে মস্কোয় মস্কো দাঁড়িয়ে থাকে কঠিন শীতে- উদোম বণিতার এই পৃথিবী ভালোবাসা পেয়ে যায় গরম মুদ্রায় (পুঁজির বাজারে ভালোবাসা/ চলো ভেঙে ফেলি) পুঁজিবাদ- সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বীভৎস পেট থেকে নতুনভাবে বের হয়ে আসছে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, চরম জাতীয়তাবোধ, নিষ্ঠুর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রভৃতি। যে পরমত সহিষ্ণুতা, ধর্মসম্প্রীতি, বহুত্ববাদ গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেসব মার খাচ্ছে মারাত্মকভাবে। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র জাতীয়তাবোধ, ধর্মীয়বোধ এবং বর্ণবাদ প্রকট আকার ধারণপূর্বক সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ‘যেদিকে তাকাও গণতন্ত্র এখন চুইং গামের মতো ষোড়শীর কানের ঝুমকা, খোকার নিপল পথে ঘরে মুক্ত মাঠে বক্তৃতার অনর্গল শব্দ উৎসব পোশাকির দাপট আর হই হই আর শক্তিমানের হাতে উপদেশের খোয়াবনামা নতুন আদেশ আর নির্দেশের জাদুই মাধুলি।’ (গণতন্ত্র / চলো ভেঙে ফেলি) দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদগণ সময়কে নানা কালপর্বে ভাগ করে আলোচনা করে থাকেন। সাহিত্যের ইতিহাসের আলোচনাতেও সময়কে ভাগ করে নানা যুগে গ-িবদ্ধ করা হয়। মতিন বৈরাগী সময়কে চিহ্নিত করেননি কোনো কালপর্বে। তিনি দেখেছেন যে সময় শ্রোতহারা নদীর মতো গতি হারিয়ে হয়ে গেছে বদ্ধ জলাময়। সেই বন্ধ্যা মোড়ে কবির আশা আকাক্সক্ষা থমকে রয়েছে অপ্রত্যাশিত ফুলস্টপ হয়ে। সময় এতটাই বৈরী হয়ে চেপে বসে আছে যে- কিছুতেই কাটছে না নেতিবাচক দিনরাত। এটি সর্বাত্মক হতাশার ছবি । হতাশার এই পাঠাতনে বসে কবি যেন শুনতে পান সেই গান-‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে /আমার পৃথিবী থেকে’। এমন অবস্থায় নিজেকে অসহায় মনে হয়, বন্ধুহীন মনে হয়। প্রতীয়মান হয় যে নিরাশার এই চত্বরে আইন কাজ করে না, বিচার কাজ করে না, সুনীতি অচল, শুভচিন্তা বিনষ্ট। ‘স্বপ্নগুলো ইতিহাসে পরিত্যক্ত নগরীর মতো নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে আকাক্সক্ষাগুলো রৌদ্রের মতো আকাশ ছুঁই ছুঁই আর নেই সবদিকে বামন বামন দিন নিঃসঙ্গ পর্বতশৃঙ্গে কেবল তুষারস্তূপ আর বৃক্ষেরা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরগন্তব্যে.. হাহাকার আর প্রতারণার এই সময় খেয়ে ফেলছে মানবিক সভ্যতা ভালোবাসা ধুলি হচ্ছে ধূলা হচ্ছে গুড়া হচ্ছে আরও রাতের আঁধারে সাঁতরায় ক্লান্তির মীন কেবল সেই নিঃসঙ্গ স্বপ্নগুলো ভাবনায় দুলে দুলে তুমি হয়ে যাচ্ছো মধ্যরাতে আর কবির কান্নাগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের ফুলস্টপ...।’ (ইতিহাসের ফুলস্টপ/ খ-ে খ-ে ভেঙে গেছি) কবিতায় মতিন বৈরাগী আগাগোড়ায় সমাজমনস্ক এবং মানবদরদী। তিনি ‘শুধু শিল্পের জন্য শিল্প’ এই তত্ত্ব মেনে কবিতা রচনা করেননি। তাঁর কাছে বড় ‘জীবনের জন্য শিল্প’ এই সূত্র উৎকৃষ্ট কবিতা হচ্ছে কোন বিষয়ে একেবারে সরাসরি না বলে প্রতীক, উপমা, তুলনা, কল্পচিত্র, চিত্রকল্প, কূটাভাস, রহস্যময়তা, আড়াল প্রভৃতির অশ্রয় নিয়ে পরোক্ষ ভাষায় ও ইঙ্গিতে তা তুলে ধরা। মতিন বৈরাগী কবিতায় এসবই ব্যবহৃত হয়েছে নিপুণ শিল্পচারুতায়। তার কবিতায় ঘনবদ্ধতা ও বহুমাত্রিকতার ব্যঞ্জনা রয়েছে। ‘দরজাটা খুলে দাঁড়াতেই চমৎকার রোদ লাফিয়ে পড়লো যেন একটা দুরন্ত চিতা ভিতরের অন্ধকারে, আর আমি বাইরে নামতে বকুল গাছটা থেকে টুপটুপ ঝরে পড়ল ক’টা ফুল তখন ক’টা কুকুর হৈ হৈ করে এসে পড়লো বাড়ির গেইটে আর বিড়ালটা লাফিয়ে উঠলো বুকে পাশের বাড়িঅলা বললো তাড়াতাড়ি ভেতরে যান এসব কুকুরের প্রভু আছে’ (কুকুর কাহিনী/ চলো ভেঙে ফেলি) তেমনি আরেকটি কবিতা ‘খ-ে খ-ে ভেঙে গেছি’ কাব্যগ্রন্থের ‘সেই পুরনো বাড়িটা’। এই কবিতায় কবি বাড়িটাকে পার্সোনিফাই করত তাকে জীবিত সত্তায় উন্নীত করেছেন। জোছনা, রাতের তারা ঝলমল আলোয় বাড়িটাকে ঘিরে বৃক্ষ, নক্ষত্র, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতির সরব হয়ে ওঠার এবং বাড়িটার বর্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগসূত্র রচনা করে সেখানে বেদনার ইতিহাসের ইঙ্গিত দানের মধ্য দিয়ে একটি বাড়ি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ শীর্ষক ছোটগল্পের মতো সমৃদ্ধি ও ব্যঞ্জনা লাভ করেছে যদিও দুটি ভিন্ন রচনা এবং এদেরপ্রেক্ষাপটও ভিন্ন ভিন্ন। মতিন বৈরাগীর কাব্যভাষা অনুদ্ধত। তিনিা অন্যায়-অবিচার-অসাম্য-কুশাসন-প্রথাগত অন্ধত্ব প্রভৃতির বিরুদ্ধেও কবিতা লিখেছেন তবে তাঁর প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা রয়ে গেছে অনুদ্ধত এবং বিন¤্র। তাঁর কবিতার ভাষা পরিশীলিত এবং পরোক্ষ। প্রতীকায়ন, পরাবাস্তবতা, কল্পচিত্র এবং দেশী-বিদেশী মিথের ব্যবহার তাদের কবিতার শরীরপ্রাণ নির্মাণে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর কবিতায় সমসাময়িক ঘটনাবলীর প্রসঙ্গ ও প্রতিক্রিয়া এসেছে কিন্তু তিনি এড়িয়ে চলেছেন প্রতিবেদনধর্মী ভাষ্য। তাঁর কবিতায় প্রেম-ভালোবাসা, দেশপ্রেম, আন্তর্জাতিকতা, প্রকৃতি, পরাবাস্তবতা, প্রতিবাদ, ঘৃণা, হতাশা, আশাবাদ— সবই আছে । তবে তার উপস্থাপনার ভঙ্গি মৃদু, ন¤্র, অনুদ্ধত এবং পরোক্ষ। তার কবিতায় প্রগতিশীলতার পক্ষাবলম্বন আছে কিন্তু দলবাজি নেই; প্রেম আছে কিন্তু তরল রোমান্টিকতা নেই ; দেশপ্রেম আছে কিন্তু কূপম-ূকতা নেই; প্রতিবাদ আছে কিন্তু অভব্য গালিগালাজ নেই। সকল প্রকারের অনুভূতি-অনুভব-ভাবনা প্রকাশে এবং সর্বাবস্থায় তিনি উন্নত পরিশীলন অনুসরণ এবং নিশ্চিত করেছেন। তিনি একদিকে কবিতার ইতিহাস, বিবর্তন, পরিবর্তন, বিষয় ও প্রকরণ প্রভৃৃতি সম্পর্কে হালনাগাদ গভীর জ্ঞানের অধিকারী, অন্যদিকে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সা¤্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ প্রভৃতি বিষয়েরও সমানভাবে ওয়াকিফহাল। তার কবিতার বিষয় তাই বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এবং একইসাথে কবিতার আঙ্গিকও বহুবর্ণিল। কবিতার বিষয় অনুসারে তিনি তার আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন। তিনি আঙ্গিককে ব্যবহার করেছেন তার বক্তব্য বিষয়কে যুৎসইভাবে প্রকাশের অস্ত্র হিসেবে। ফলে তাঁর কবিতা একইসাথে কবিতার বিষয়বৈভব এবং প্রকরণগত সৌকর্যকে ধারণ করেছে পরিপূরক ও সম্পূরক ব্যঞ্জনায়। তাঁর কবিতায় মহৎ জীবনের সুর বেজে উঠেছে কখনো স্বরলিপির পরিসীমায়, কখনোবা স্বরলিপির পরিসীমা ছাড়িয়ে। তিনি শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলাননি আবার ভঙ্গিকে অস্বীকারও করেননি। জীবনে জীবন যোগ হওয়ায় তাঁর কবিতায় ঘোষিত হয়েছে মহৎ জীবনের জয়; একইসাথে তা কবিতারও বিজয় হয়ে উঠেছে।
×