ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহার

ঢাকা লিট ফেস্ট ॥ বাংলা সাহিত্যের বৈশ্বিক যাত্রা

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

ঢাকা লিট ফেস্ট ॥ বাংলা সাহিত্যের বৈশ্বিক যাত্রা

বাংলা একাডেমি চত্বরে গত আট থেকে দশ নবেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা লিট ফেস্ট বা আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। উৎসব উদ্বোধন করলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিৎজার জয়ী লেখক অ্যাডাম জনসন ও পাকিস্তান বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের লেখক মোহাম্মদ হানিফ। দেশ-বিদেশের দুই শতাধিক সাহিত্যিক, অভিনেতা রাজনীতিবিদ,গবেষক সাংবাদিক এ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠান স্থলে ছিল বইয়ের স্টল, খাবারের স্টল এবং আলোকসজ্জিত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছিল উৎসবমুখর। ব্যাপক দর্শক, শ্রোতার আগমনে এবারের লিট ফেস্ট ছিল মুখরিত ও আলোচিত। ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৮ আলো করলেন যে অতিথিরা ঢাকা লিট ফেস্টে এবার সময় কাটালেন পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অ্যাডাম জনসন, পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও কলামিস্ট মোহাম্মদ হানিফ, ব্রিটিশ উপন্যাসিক ফিলিপ হেনশের, বুকারজয়ী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জেমস মিক, ভারতীয় জনপ্রিয় লেখক জয়শ্রী মিসরা, লন্ডন ন্যাশনাল এ্যাকাডেমি অব রাইটিংয়ের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক রিচার্ড বিয়ার্ড, ভারতীয় লেখক হিমাঞ্জলি শংকর, শিশুতোষ লেখক মিতালি বোস পারকিন্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার প্রধান হুগো রেস্টল, মার্কিন সাংবাদিক প্যাট্রিক উইন এবং লেখক ও সাংবাদিক নিশিদ হাজারি এবং ভারতীয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আরও এসেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা ও অভিনেত্রী ও পরিচালক নন্দিতা দাস এবং অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী টিলডা সুইনটোন ঢাকা লিট ফেস্টের পূর্বকথা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব হে-অন-ওয়ে ফেস্টিভ্যালের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা ব্রিটিশ কাউন্সিলে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজিত হয়। মূলত বিশ্বজুড়ে হে উৎসবকে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা থেকেই হে কর্তৃপক্ষ ঢাকায় হে সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। পরবর্তীতে ২০১২ সাল থেকে বাংলা একাডেমিতে বেশ বড় পরিসরেই এই উৎসবটি নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে। প্রথম দিকে এ উৎসব আয়োজনে ডেইলি স্টার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রধান ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রনালয়, বাংলা একাডেমি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ এর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে। অষ্টমবারের মতো আয়োজিত হয় এ উৎসব। কেন এই লিট ফেস্ট : আয়োজকদের ভাষ্য ৫ নবেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ফেস্টের অন্যতম পরিচালক ড. কাজী আনিস আহমেদ বলেন- “২০১১ সালে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ নাম দিয়ে এই আয়োজন যাত্রা শুরু করে। ২০১৫ সাল থেকে এটি ঢাকা লিট ফেস্ট নামে যাত্রা শুরু করে। গত ৮ বছরে আমরা চেষ্টা করেছি এগিয়ে যাওয়ার। আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। নানা পরিসরে নানা ধরনের অনুবাদের কাজ চলছে। বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার যে প্রয়াস আমরা নিয়েছি সেটির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতেই সারা বছর ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এক কথায় ঢাকা লিট ফেস্ট বাংলার ঐতিহ্য ও বিশ্ব সংস্কৃতির সম্ভারের অনন্য মিলনমেলা। সাদাফ সায্ সিদ্দিকী বলেন- গত ৮ বছরে ৫০টি দেশের ৩৩০ জন অতিথি এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে। আহসান আকবর বলেন, লিট ফেস্টে আমাদের মূল আগ্রহ থাকে বাংলা সাহিত্যকে প্রচার ও প্রসারের। সেটিকে এগিয়ে নিতে আমরা বাংলা সাহিত্যের লেখকদের বই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ‘সি গার্ল’ বলে একটি ভারতীয় প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। যাদের আয়োজনে এই ফেস্ট সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হলো এই ফেস্ট। উৎসব পরিচালনায় ছিলেন- বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ, কবি সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও কবি আহসান আকবর। ঢাকা লিট ফেস্টের টাইটেল স্পন্সর হিসেবে ছিল বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন, কী-স্পন্সর হিসেবে ব্র্যাক। গোল্ড স্পন্সর এনার্জিস, স্ট্রাটেজিক পার্টনার ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং পুরো আয়োজনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলো যাত্রিক। কিছু উল্লেখযোগ্য সেশনের টুকরো চিত্র ঢাকা লিট ফেস্ট শুরুর দিনে ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক রিচার্ড বেয়ার্ড কথা বলেছেন তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্য ডে দ্যাট ওয়েন্ট মিসিং’ নিয়ে। উপন্যাসটি তিনি ভাই হারা নোর বেদনা থেকে লিখেছেন। ‘টেলস অব ওয়ান্ডার : মিথস এ্যান্ড ফেইরিটেইলস’ শীর্ষক সেশনে আড্ডা দেন লেখক স্যালি পম ক্লেটন ও কবি, ও অনুবাদক কায়সার হক। কায়সার হক বলেন, ‘গল্প হচ্ছে মানুষের মতো, এগুলোও এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমণ করে। ভ্রমণের সময়, এগুলো রুপান্তরিত হয় তবে হারিয়ে যায় না।’ সময়ের গান, অসময়ের কবিতা সেশনে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কথা বলেন, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে। প্রদর্শিত হয় ভারতীয় নির্মাতা নন্দিতা দাস নির্মিত ও নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত চলচ্চিত্র ‘মান্টো’। প্রদর্শনী শেষে চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নন্দিতা দাস। ‘আই অ্যাম চেঞ্জ’ স্লোগানে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট -এর দ্বিতীয় দিন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে প্রকাশিত হয় ‘হার স্টোরিজ’ দ্বিতীয় সংখ্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেদা শাহরিয়ার কবির, সায়েবা’স মেথডের আবিষ্কারক অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলের শিক্ষিকা নমিতা হালদার এবং লোকসংগীত শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া তুলে ধরেন তাদের সফলতার ইতিহাস। সেশনটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক নবনীতা হালদার। বাংলা একাডেমির বটতলায় বিকালের ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস’ সেশন অনুষ্ঠিত হয় ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস’ একটি চলচ্চিত্রের নাম হলেও আলোচনার ব্যাপ্তি ছড়ায় এশিয়ার জনমানুষ, সংস্কৃতি ও বিশেষত অর্থনৈতিক কর্মকা-ে। নিশীথ হাজারির সঞ্চালনায় এ সেশনে উপস্থিত ছিলেন এশিয়ার অপরাধ ও অপরাধী বিষয়ক হংকংভিত্তিক সাংবাদিক প্যাট্রিক উইন, লেখক ও সমালোচক গুয়েন রবিনসন এবং লেখক চন্দ্রহাস চৌধুরী। গোয়েন রবিনসন জানান, বর্তমানে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিত্তশালী মানুষ বেরিয়ে আসছেন সিঙ্গাপুর সিটি আর ইন্দোনেশিয়া থেকে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে বিত্তশালী ও অর্থনৈতিক প্রভাবকের ভূমিকায় রয়েছে চীন। এশিয়ায় প্রতিদিনই বিত্তশালীদের তালিকা দীর্ঘ হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এশিয়ানদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে নির্ভরতা কমা, সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনের প্রতি ঝোঁক এবং নিজস্ব সংস্কৃতি নির্ভরতাই প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী কবি হায়াত সাইফের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনা করেন তাঁর ‘চ্যারিয়ট অব লাইফ’ বইটি লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে। তিনি বলেন, ‘এই বইটিতে দুটি জীবনের ভিন্ন গল্প আছে। একটি যুদ্ধের সময়ের, আরেকটি ২০০৮-এর আমার জীবনের। এটা মুক্তিযুদ্ধের কোনও ইতিহাস না। আমার জীবনের গল্প। যখন জেলে ছিলাম তখনকার গল্প-কি দেখেছিলাম, কি হয়েছিল তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত। তরুণ সরকারী চাকরিজীবীর যোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প, মুক্তির সংগ্রামের কথা আছে। আমি অতীত নিয়ে গর্ব করি। হাজার বছরের ইতিহাস আছে আমাদের। লিট ফেস্টের শেষ দিন প্রথমার্ধে ছিল ‘সেভেন্টিওয়ান পোয়েমস’ সেশন। আলোচ্য বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা কবিতার সংকলন- ‘পিস অ্যান্ড হারমনি: সেভেন্টিওয়ান পোয়েমস ডেডিকেটেড টু শেখ হাসিনা’। আলোচনা করেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কবি মোহাম্মদ সামাদ, কবি কামাল চৌধুরী, আবুল আজাদ, সংকলনের সম্পাদক আহমেদ রেজা, সংকলনের ইংরেজী অনুবাদক আনিস মুহাম্মদ প্রমুখ। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কবিতা সবাইকে নিয়ে লেখা যায় না, সব বিষয় নিয়েও লেখা যায় না। কিন্তু পদ্য লেখা যায়। পদ্যে শব্দের অর্থ আক্ষরিক নয়, কিন্তু কবিতায় শব্দের অর্থ আক্ষরিক। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ও কবিতা লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন তার নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল তখনও একজন কবি তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি হচ্ছেন নির্মলেন্দু গুণ। সুতরাং কবিদের নিয়ে যতই হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করি না কেন, কবিরা জাতির দুঃসময়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। শেখ হাসিনাকে নিয়ে কবিতা রচনা ও সেটির সংকলন প্রকাশও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা সাহিত্য : নারী ও পুরুষ সেশনে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, সালমা বানী, শাহনাজ মুন্নী, অদিতি ফাল্গুনী আলোচনা করেন কবি শামীম রেজার সঞ্চালনে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত ও লেখক মারিও পালমা তার দ্বিতীয় বই ‘টেলস অব অ্যান আর্ট লাভার’ সেশনে বই থেকে পাঠ করে শোনান। উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির এবং কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজরুল ইসলাম। সেশনটি সঞ্চালনা করেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়য়ের উপ-উপাচার্য ফখরুল আলম। মারিও পালমা বাংলাদেশে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, এ দেশের শিল্পকর্মের সমৃদ্ধ ভা-ার তাকে মুগ্ধ করেছে। ‘শিল্পকর্মের ভাষা বৈশ্বিক, এ জন্য শিল্পীরাই পারেন সমগ্র বিশ্বকে এক সুতায় গাঁথতে। ‘নো নোবেল : মি টু ইন লিটারেচার’ এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জার্মান লেখক ওলগা গ্রাসনোয়া, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও অধ্যাপক ফিলিপ হেনশার, ব্রিটিশ লেখক রিচার্ড বিয়ার্ড, আমেরিকান লেখক রস পটার ও ভারতীয় লেখক, সম্পাদক ও সমাজকর্মী হিমাঞ্জলি শংকর। সঞ্চালক ছিলেন ভারতীয় লেখক চন্দ্রবিভাস চৌধুরী। হেনশার বলেন, ‘আগে অনেকেই কণ্ঠস্বর না তুললেও এখন সবাই কন্ঠস্বর তুলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল পুরস্কার বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাই। রস পর্টারের মতে- ‘যারা বই পড়ে, শিল্প ও সাহিত্যের চর্চা করে তাদের জন্য এই দূষিত পরিবেশ ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে।’ হিমাঞ্জলি শংকর বলেন, বিগত কয়েক মাস ধরে এক ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু নারীদের মধ্যে না, পুরুষদের মধ্যেও জনসচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’ রিচার্ড বিয়ার্ড বলেন। ‘মি টু আন্দোলন সাহিত্যের ওপর যে প্রভাব তৈরি করেছে, তা শুধু সাহিত্যে কিংবা শিল্পকে ছাড়িয়ে ভেঙে দিয়েছে ক্ষমতার ভিত্তিকে। চন্দ্রবিভাস চৌধুরী বলেন, ‘যেসব লেখক এরকম ন্যক্কারজনক কাজ করতে পারে তারা লেখক হলেও শিল্পী হতে পারে না। কারণ একজন শিল্পী এ ধরনের কাজ করতে পারে না।’ কোনও পুরুষ তার কাজের ক্ষেত্রে কোনও নারীকে হয়রানি করেন, সেটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে হোক কিংবা সাধারণ মানুষের জীবনেই হোক, সোচ্চার হওয়া জরুরী এমন উচ্চারণই উঠে আসে এই সেশন থেকে। ‘এখনও কেন কবিতা’ শিরোনামের আলাপচারিতায় উঠে আসে অমোঘ কিছু প্রশ্ন : কবিতা কী অথবা কেন কবিতা লেখা হয় কিংবা কবিতার প্রয়োজনীয়তা কি এখনও টিকে আছে? কবি আসাদ চৌধুরী, রুবি রহমান, পশ্চিমবঙ্গের সুমন গুণ এবং ড. নিখিলেশ রায় মুখোমুখি বসেন কবিতা নিয়ে কথা বলতে। সেশনটির সঞ্চালনা করেন কবি শামীম রেজা। কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, যতদিন জরা-ক্লান্তি-ভয় থাকবে, ততদিন টিকে থাকবে কবিতা। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে কবিতা। লিট ফেস্টে শীর্ষেন্দু সাহিত্য প্রেমীদের জন্য এবারের লিটফেস্টে বড় আকর্ষণ ছিল শেয দিনে ভারতে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর সেশন। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে এ সেশনে ছিল অস্বাভাবিক ভিড়। অনেক ভক্ত শ্রোতা সেশনে যোগ দিতে পারেননি। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের এত গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু সেখানে আমাদের লেখকদের কোনও গুরুত্ব নেই কেন? এরকম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একটা ফ্যাক্ট। কিন্তু মিলনের লেখা কিন্তু গুরুত্ব পায়। পাঠক যে লেখা পড়ছে না এমনটি নয়। অনেকেই বসে থাকে, লেখা চলে না। এই জিনিস কিন্তু আমরা সেখানেও দেখতে পাই। পাঠক কমছে, কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে, সব জায়গায় নয়। কাজেই এটা নিয়ে দুঃখ করার চেয়ে আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের সব লেখকই ধীরে ধীরে সম্মানিত হবে। ইউটিউবে সুন্দর সুন্দর বাংলাদেশি নাটক আছে। এখানকার টিভি চ্যানেল ওখানে দেখানো হয় না। পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়ে দেখতে পারে না। আমি কিন্তু ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখি। নাটকের গল্পগুলো খুব চমৎকার এবং মিষ্টি। আমার নিজেরও রোমান্টিক মিষ্টি গল্প পছন্দ। কাজেই এগুলো আস্তে আস্তে আদান প্রদানের মাধ্যমে হবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সাংস্কৃতিক জিনিস জোর করে চাপানো যায় না। ভাল কাজ করতে করতে সেই কাজ গৃহীত হবে। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’ মনীষা, নন্দিতা, টিলডা সুইনটোনের গল্প মৃত্যু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি মরতে চাইনি। আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম, চোখ মেলে দেখি আমার আকাশ কালো হয়ে আসছে। নিজেকে আশ্বস্ত করলাম, আমাকে এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। একসময় জানতে পারলাম বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৪৪ শতাংশ, কিন্তু এটাও সত্যি যে ৫৬ শতাংশ মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছি...।’ ‘ক্যান্সার আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি ভেতর থেকে বদলে গিয়েছি। আমার পৃথিবীও বদলে গেছে।’ এভাবেই নিজের গল্প বলেন অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা। তাঁর লেখা বই ‘দ্য বুক অব আনটোল্ড স্টোরিজ’ থেকে পাঠ করেন। ‘আমি মনে করি যে কোন পরিস্থিতি আমাদের শিক্ষা দেয়। আমি ক্যান্সারের প্রতি কৃতজ্ঞ, সে আমাকে জীবনের মূল্য শিখিয়েছে। ভীত হয়ে মৃত্যুর জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক মানুষের কাছে অনেক আশা ছিল যে তারা এগিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু হয়নি। আবার কিছু মানুষ আমার জীবনে এসেছে ফেরেশতা হয়ে। এ থেকেই বলতে পারি পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছে। লাইফ ইজ ফুল অব পজেটিভ স্টোরিজ।’ লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ অধিবেশনের আলোচক ছিলেন মনীষা কৈরালা এবং নন্দিতা দাস। সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক সাদাফ সায্। অকপটে নিজেদের ভাবনা তুলে ধরেছেন তারা। বাণিজ্যিক ছবির ‘আইটেম সং’, নারীর গায়ের রং, ওজন বা বয়স, অভিনয় জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, দর্শকদের প্রশ্নের জবাবে ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন মনীষা কৈরালা। এ অঞ্চলে নারী হয়ে জন্মানো মানেই অলি-গলি, বাড়ি বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হওয়া। এসব কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করেই এগোতে হয়। নন্দিতা বলেন তাঁর ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ প্রচারাভিযানের কথা। ‘যে পরিবারে জন্মেছি, সেখানে চামড়ার রং কী, তা নিয়ে কখনো কোন আলোচনা হয়নি। তবে সমাজ আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছে, আমার গায়ের রং কালো। প্রচারাভিযানে যুক্ত হওয়ার পর তিনি আরও গভীরভাবে বুঝতে পারেন, গায়ের রং কালো হওয়া নিয়ে মানুষ কতটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। নিজের মেধা ও মননশীলতাকে শাণিত করার বদলে ত্বক ফর্সা করার জন্য নারীরা সময় ব্যয় করে। এ থেকে চলচ্চিত্রশিল্পও মুক্ত নয়, বলিউডে কালো চামড়ার যেসব অভিনেতা এসেছিলেন, দিনে দিনে তাঁরা কেবল ফর্সাই হয়েছেন। নন্দিতার মতে, একজন নারী হয়তো মহাসমুদ্রে একটা বিন্দুর মতো। তবে সেই বিন্দুকে পূর্ণ হতে হবে, স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী হতে হবে। মহাত্মা গান্ধীকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, দুনিয়াটাকে বদলাতে চাইলে নিজেকে বদলাতে হবে আগে। আর মনীষার মতে- নারীকে হতে হবে যোদ্ধার মতো। লিট ফেস্ট শেষ দিন ভিন্নধারার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ‘অন ড্রামডন হিল’ শীর্ষক আলোচনায় লেখক আহসান আকবারের সঞ্চালনায় কথা বলেন স্কটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইনটোন। টিলডার মতে, বর্তমান বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে কাঠামো এবং শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের যে বাড়াবাড়ি, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুর শৈশব থেকে পরিণত হয়ে ওঠার পথে অন্তরায়। ‘আগত ভবিষ্যৎকে মোকাবিলা’ স্লোগানে প্রতিষ্ঠিত ভিন্নধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ স্কটল্যান্ডের ড্রামডন স্কুল। স্কুলটির কার্যক্রম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টিলডা বলেন, তিন ধাপে এখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ৪-৭ বছর পর্যন্ত শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়; কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না তাদের। দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ ৭-১৪ বছর পর্যন্ত হাতে-কলমে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে অভ্যস্ত করা হয়। শিক্ষা কার্যক্রমের শেষ ধাপ অর্থাৎ ১৪-২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেখানে তারা একটা দীর্ঘ সময় কোনও নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে যেমন, স্থাপত্য, জীববিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করে। এই বিদ্যায়তনিক শিক্ষা শেষে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে যেতে তাদের সাহায্য করে। এ অভিনেত্রী দ্বিতীয়বারের মতো অংশগ্রহণ করলেন লিটফেস্টে তিনি আবারও আসার ইচ্ছে রাখেন। ঢাকা লিস্ট ফেস্ট : কিছু প্রশ্ন ২০১১ সালে ঢাকা লিট ফেস্টের যাত্রা যখন শুরু হয়েছিল ‘হে ফেস্ট’ নামে তখন এই ফেস্ট নিয়ে বিতর্ক দেখা গিয়েছিল কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে। ২০১২ তে বাংলা একাডেমিতে ‘হে ফেস্টিভাল’এর আয়োজন হলে কবি ও লেখক ও সাহিত্যিকগণ একে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী এবং সামাজ্যবাদের প্রতীক অভিহিত করে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ বন্ধের দাবিতে বাংলা একাডেমির সামনে মাথায় কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ঢাকা লিস্ট ফেস্ট নামকরণের পর এই ফেস্ট এর নামকরণ নিয়ে আর কোন বিতর্ক বা প্রতিবাদ প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে লিট ফেস্টে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত হচ্ছে কি না, এই ফেস্ট তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারছে কি না এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে বিদগ্ধ জনের মধ্যে। প্রথমত: কারা এই লিটফেস্টে আসছেন? লিটফেস্টের শ্রোতা এবং দর্শক কারা? দেখা যাচ্ছে লিট ফেস্টে আসছেন বেশির ভাগই ইংরেজী মাধ্যমে পড়–য়া তরুণ প্রজন্ম। এই যে তরুণরা তারা কি বাংলা সাহিত্য পাঠ করছেন? দূভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে তারা বাংলা সাহিত্যের পাঠক নন। লিট ফেস্টের অন্যতম উদ্দেশ্য বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের মেল বন্ধন। সেটাই যদি হয় উদ্দেশ্য তাহলে যারা বাংলা সাহিত্যের পাঠকই নন, যাদের আদৌ কোন আগ্রহই নেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি তারা কি করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত করবেন? তাহলে লিট ফেস্ট কি এলিট শ্রেণীর কোন ফেস্ট? যেখানে কি না, সাহিত্য পাঠকের চাইতে সমাজের একটা শ্রেণীর উপস্থিতি বেশি লক্ষণীয়। দ্বিতীয়ত: যে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন রাখছেন তা হলো যে সকল সম্মানিত অতিথি লিট ফেস্টে আসেন তারা বাংলা বা বাংলাদেশকে কতটুকু জানেন? যদি ধরে নেয়া হয় আমাদের দুর্বল অনুবাদের কারণে তারা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না। তাহলে বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে তারা আমাদের জন্য কি করেছেন? তাদের কাছে কি আমরা বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি পৌঁছাতে পেরেছি? নোবেল বিজয়ী ভি এস নাইপলকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য কি তার কাছে পৌঁছেছিল? তিনি কি কোথাও এদেশের সাহিত্য নিয়ে কোন মন্তব্য বা বিশ্লেষণ রেখেছিলেন? তৃতীয়ত: রাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে গ্রুপিং বিষয়টি নানাভাবেই আলোচিত ও সমালোচিত। গ্রুপ ও গোষ্ঠীপ্রীতির কাছে নানাভাবেই ব্যাহত হচ্ছে সাহিত্যের স্বতস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক বিকাশ। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় লিটফেস্টে দেখা যাচ্ছে একই লেখক, কবি সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে লিটফেস্টের মতো আন্তর্জাতিক একটা ফেস্ট যার মূল উদ্দেশ্য অনেক বিশালও বিস্তৃত যার মূল লক্ষ্য বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়া সেই ফেস্টও কি গ্রুপিং আর গোষ্ঠীপ্রীতির সীমাব্ধতার খপ্পরে? চতুর্থত : অতিথি যারা আসছেন তারা তাদের অভিজ্ঞতা লেখার গল্প, সৃষ্টির গল্প আমাদের জানান। নিঃসন্দেহে তাদের অভিজ্ঞতা তাদের সৃষ্টি আমাদের সমৃদ্ধ করে। সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য সাহিত্যের আদান-প্রদান খুবই প্রয়োজন। তারা আমাদের দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমরা তাদের কি দিচ্ছি? তারা কি কোন একটা সেশনে আমাদের সাহিত্য বা আমাদের সাহিত্যিকদের সৃষ্টির গল্প শুনছেন? তারপর তারা কি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন? একজন মনীষা কৈরলা তার ক্যান্সার জয়ের গল্প বলেছেন নিঃসন্দেহে তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে কিন্তু আমরা কি কোন সেশনে মণীষাকে শুনিয়েছি আমাদের কোন সংগ্রামী নারীর গল্প? নন্দিতাকে কি দেখিয়েছি আমাদের কোন চলচ্চিত্র? তারা তা দেখে শুনে কি বলেছেন? নাকি একতরফা আমরা শুধু প্রশস্তি গেয়েই যাচ্ছি আর চাতকের মতো ঊর্ধ্বাকাশে তাকিয়ে আছি। পঞ্চমত: আয়োজকদের ভাষ্য মতে প্রায় দেড় শতাধিক দেশী লেখক শিল্পী কবি লিটফেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন। পুরো লিটফেস্টে ৯০টির অধিক সেশনে অংশ নিয়েছে। এটা নিশ্চয় আমাদের জন্য শুভ সংবাদ লিটফেস্টে নানা বিষয় নিয়ে অেেলাচনা হচ্ছে নানা বিষয়ে, নানা দেশের কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকরাও অংশ নিতে পেরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই এসব সেশনে যে মূল্যবান আলোচনা হলো সেগুলো কারা শুনলেন, গল্প নিয়ে যিনি কাজ করেন তিনি কি গল্পের সেশনটি শুনেছেন, কবিতা নিয়ে যার আগ্রহ বা যিনি দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে আছেন তারা কি সেটা শুনেছেন? টার্গেট পিপলের কাছে কি সেগুলো পৌঁছেছে? লিট ফেস্ট : কিছু কথা লিটফেস্টের দর্শক এবং শ্রোতার একটা বিরাট অংশ হচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমে পড়–য়া তরুণ প্রজন্ম। বিষয়টি কিন্তু নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক। ইংরেজী মাধ্যমে পড়–য়ারা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ নিয়ে এখানে আসছেন। হয়তো তাদের আগ্রহ ইংরেজি সাহিত্যে। সেটাও নেতিবাচক কিছু নয়। তারা বাংলা সাহিত্যের পাঠক নয়। তারা বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাদন করার সুযোগ সেভাবে পায়নি। তাদেরকে যদি বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাদন করানো যায় তাহলে তারা নিশ্চয় বাংলা সাহিত্যের প্রতিও আগ্রহ দেখাবে। ইংরেজী মাধ্যমে পড়–য়া যারা সাহিত্য বা শিল্পের চর্চা করেন তাদের জন্য কিছু সেশন রাখা যেতে পারে যেন তারা এদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যেতে হলে এ প্রজন্মকে এবং ইংরেজী মাধ্যমে পড়–য়াদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে যেন তারা প্রাণের তাগিদ থেকে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ করে এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে নিয়ে যায়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যদি আমরা আমাদের এই সাহিত্যের অমূল্য ভান্ডার সম্পর্কে সচেতন না করি তাহলে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আঁধারে ঢেকে যাবে। বাংলাদেশে নবীন এবং প্রবীণ যারা ইংরেজীতে লিখছেন এবং যারা বাংলায় লিখছেন তাদের মধ্যে উভয়ের সৃষ্টি নিয়ে পারস্পরিক আদান-প্রদান খুব জরুরী। কারণ যারা ইংরেজীতে লিখছেন তারা এ দেশের মাটিতে বসেই লিখছেন। এ দেশকেই তুলে ধরছেন। শুধু তাঁদের লেখার মাধ্যম ভিন্ন। ফলে তিনি কি লিখছেন তা জানাটা জরুরী আবার বাংলায় যিনি লিখছেন তিনি কি লিখছেন তা ইংরেজী মাধ্যমে লিখিয়েদের জানা জরুরী। তাই এ ধরনের একাধিক সেশন রাখা প্রয়োজন। ৯০টি সেশনে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব সেশনে হাতে গোনা কয়েকজন আলোচক, সাহিত্যিক, লেখক ছিলেন। আমাদের নবীন, প্রবীণ, সাহিত্য ও শিল্পকমীদের এ সেশনগুলোতে আরও বেশি সংযুক্ত করা যেত। সবাইকেই স্টেজে বসে কথা বলতে হবে, সবাইকেই সম্মানী দিতে হবে এমনটি তো নয়। বিভিন্ন সেশন উপভোগ করে সমৃদ্ধ এবং মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবার জন্য বোদ্ধাদের ও সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানানো যায়। তাতে অংশগ্রহণকারী যেমন সম্মানিত বোধ করে, সমৃদ্ধ হয়, তেমনি সেশনটিও সমৃদ্ধ হতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ বোধহয় স্দিচ্ছা থাকলেই নেয়া সম্ভব। সেটি করা হলে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কাছে বা একটি গোষ্ঠীর কাছে লিটফেস্টের মতো আন্তর্জাতিক ফেস্ট গ-িবন্ধ হয়ে আছে এমনটি যেমন মনে হতো না, তেমনি লেখক সাহিত্যিক শিল্পীরা এখন এই ফেস্টের একাত্ম হতে পারতেন। লিটফেস্ট আমাদের এ ধরনের একটা বোধে তারা উদ্দীপ্ত হতে পারতেন। বাংলা সাহিত্রের বৈশ্বিক যাত্রা সম্ভাবনার হাতছানি বাংলাদেশের সাহিত্য এখন যে কোন সময়ের চাইতে বেশি বেগবান। অমিত এক সম্ভাবনার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সাহিত্য। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সন্মেলন হওয়া খুবই জরুরী। অন্য দেশের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা। অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেবার আশু প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। বাংলা সাহিত্যের বৈশ্বিক যাত্রায় এবং অন দেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা লিট ফেস্ট নিঃসন্দেহে সম্ভাবনার হাতছানি। এখানে বিদেশী স্বনামধন্য লেখক সাহিত্যিক শিল্পী অভিনেত্রীরা আসছেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছেন। তারা বাংলাদেশকে দেখে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের পাঠকরা নতুন নতুন বই এবং বইয়ের লেখকদের সান্নিধ্যে আসতে পারছেন। এগুলো লিটফেস্টের খুবই ইতিবাচক দিক। লিট ফেস্টকে যদি সত্যিকার অর্থে বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে, বাংলা সাহিত্যের ¯্রােতধারাকে বিশ্বসাহিত্যের ¯্রােতের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া যায়। আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই চিহ্নিত করতে পারি আমাদের সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতার জায়গাটি, কোথায় আমাদের শক্তি আর কোথায় আমাদের ঘাটতি তা হলে অবশ্যই বাংলা সাহিত্য বিশ্বে শক্ত অবস্থান গাড়তে পারবে। লিটফেস্ট আরও লক্ষ্যভেদী হতে হবে। আয়োজকদের দৃষ্টির সীমানাকে আরও উন্মুক্ত করতে হবে। কোন গোষ্ঠীচিন্তা বা গ্রুপপ্রীতি, ব্যক্তিসুনাম এবং ব্যক্তিপ্রচারকে প্রশয় দিয়ে এর বিশাল ও মহৎ উদ্দেশ্যকে কোনদিনই ছোঁয়া যাবে না। শুধু বাগড়ম্বরই করা যাবে, অথবা লোকের ঢল দেখে আত্মপ্রাসদে ভোগা যাবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমাদের মনের দরজাকে আরও উদার ভাবে খুলতে হবে, সঙ্কীর্ণ চিন্তার উর্ধে উঠতে হবে। সাহিত্যিক কবি, লেখক যদি তাদের যোগ্যতা, মেধা এবং শক্তি অনুযায়ী মূল্যায়িত হয় এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিজেদের সৃষ্টি এবং এদেশের সাহিত্য ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে লিট ফেস্ট হয়ে উঠবে আমাদের প্রাণের ফেস্ট এবং একই সঙ্গে বিশ্বের আয়নায় দেখা বাংলা সাহিত্যের মুখচ্ছবি বা বাংলা সাহিত্যের আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া বিশ্বের মুখ। তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন লিটফেস্টে আগত লেখক সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলোচনা।
×