ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পপি দেবী থাপা

বিশ্ব দর্শন দিবস ॥ শান্তি ও মানবাধিকারের বার্তা

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্ব দর্শন দিবস ॥ শান্তি ও মানবাধিকারের বার্তা

বিশ্ব দর্শন দিবস সম্পর্কে ইউনেস্কো বলেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অভিযাত্রা বর্তমান বিশ্বে অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, অন্যায়, সন্ত্রাস, সহিংসতা, অনৈতিকতা, নিরাপত্তাহীনতা মোটেই কমাতে পারেনি। এসব থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে দর্শনের শিক্ষা ও অনুশীলন। কেননা দর্শনের জীবনবোধ, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, নান্দনিকতা, যুক্তিবোধ ও মননশীলতা বর্তমান বিশ্বকে নানাবিধ সঙ্কট ও সমস্যা থেকে মুক্ত করে মানবজাতিকে দিতে পারে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের সন্ধান। এ লক্ষ্যেই ইউনেস্কো ২০০২ সালের ২১ নবেম্বর প্রথমবার দর্শন দিবস ঘোষণা করে। ইউনেস্কোর তৎকালীন ডাইরেক্টর জেনারেল কইচিরো মাতুসুয়ারা বিশ্ববাসীর প্রতি এক বার্তায় মানবাধিকার, ন্যায়-নীতি, গণতন্ত্রকে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দারিদ্র্য, বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, নারী অধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি সমকালীন বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এবং এসব সমস্যা সমাধানে বিশ্লেষণের গভীরে প্রবেশ করে দার্শনিক বিশ্লেষণ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ইউনেস্কোর কাজ। যেহেতু ‘দর্শন’ একটি প্রাচীন শিক্ষার বিষয়। আর যে দেশ দর্শন চর্চায় যত বেশি অগ্রসর সে দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিকতা তত বেশি উন্নত। তাই বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে দর্শন দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়টিকে মাথায় রেখে ইউনেস্কো ২০০৫ সালের সাধারণ সম্মেলনে নবেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে হিসেবে এবারের বিশ্ব দর্শন দিবস পালিত হয়েছে গত ১৫ নবেম্বর। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এবারের বিশ্ব দর্শন দিবসের কর্মসূচীতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মানবাধিকার। সমাজকে সুন্দর করে গড়ে তোলায় ইউনেস্কো দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। প্রথমত, ঋড়ৎবংরমযঃ বা দূরদৃষ্টি। সুন্দর এবং ভাল কিছু অর্জন করার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির গুরুত্ব অপরিহার্য। যার দৃষ্টি সঙ্কীর্ণ এবং সে দূরের কিছু দেখতে পায় না বা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করতে পারে না। এখানে দূরত্ব ভৌগোলিক অর্থে যেমন আছে, একইভাবে সময়ের দূরত্ব, উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের দূরত্ব এসবও আছে। দ্বিতীয়ত, ন্যায়বিচার। বিচারমূলক চিন্তা এবং এর মধ্য দিয়ে দূরদৃষ্টি গঠন এ দুয়ের সমন্বয় থেকেই গড়ে ওঠে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের প্রত্যয় ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে সক্রেটিসের আলোচনার শুরুই এ বিষয়টি নিয়ে। প্রতিটি মানুষ তার সামাজিক অবস্থানে থেকে সেই অবস্থান অনুযায়ী নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবেÑ এটাই হলো ব্যক্তির ন্যায়পরতা। কিন্তু দায়িত্ব কিভাবে পালন করা হবে? একটি উপায় হতে পারে যে, মানুষ দায়িত্ব পালন করবে কর্তব্যবোধ দিয়ে। অন্য একটি মতাদর্শ হতে পারে যে, মানুষ দায়িত্ব পালন এমনভাবে করবে সেখানে লক্ষ্য হবে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ অর্জন করা। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এ দুটো মতাদর্শেরই গুরুত্ব আছে। কর্তব্যবোধকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। একই সঙ্গে এটাও স্বাভাবিক যে, মানুষ সুখী হতে চাইবে। এই প্রেক্ষিতে এ দুটো মতাদর্শের সমন্বিত রূপই হবে সুস্থ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপায়। এ দুটো মতবাদের মধ্যে কর্তব্যবাদকে পরিণতিমুক্ত মতবাদ বলা হয়। এখানে কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করা হবে, কোনকিছু প্রাপ্তির জন্য নয়। বেদান্ত দর্শনে এমন মতবাদকে বলা হয় নিষ্কাম কর্মবাদ, অর্থাৎ এখানে কাজের পেছনে কোন কামনা-বাসনা থাকবে না, থাকবে কেবল কর্তব্যবোধ। এ মতের বিপরীত অপর মতটি হলোÑ যেখানে সুখের কামনা থেকে কাজ করা হবে। এই দ্বিতীয় মতটিতে কামনার বিষয় হিসেবে সুখকে বর্জন করব এবং সুখের পরিবর্তে কল্যাণকে গ্রহণ করব। কারণ, সুখের কামনার সঙ্গে জৈবিক প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রীয় অনুভূতি যুক্ত থাকতে পারে এবং এমন প্রবৃত্তি ও অনুভূতি থেকে লোভ, হিংসা, মোহ গড়ে উঠতে পারে। এভাবেই ভারতীয় দর্শনের একটি মতাদর্শে বলা হয়েছে যে, সুখী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও ঘি খাও। এমন অবস্থা বর্জন করার জন্যই জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন যে, ‘সুখী চতুষ্পদ প্রাণী হওয়ার চেয়ে অসুখী মানুষ হওয়া ভাল এবং সুখী বোকা মানুষ হওয়ার চেয়ে অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভাল।’ কিন্তু পার্থক্য এই যে, বিচারমূলক চিন্তা বা দূরদৃষ্টি না থাকলেও সুখকে চাওয়া এবং পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে কল্যাণের ধারণাটিই বিচারমূলক চিন্তা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সুস্থ সমাজ গঠনে ভবিষ্যত প্রজন্ম কল্যাণমূলক কর্তব্যবাদকেই বেছে নেবে; কর্তব্য করা হবে মানব কল্যাণের জন্য এবং এর মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। দর্শন এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়, যেখানে নীতি নৈতিকতা, যুক্তি, নান্দনিকতা, মানবতা, চিন্তা-চেতনা তথা জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়। দর্শন মানুষের আত্মসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক সক্রেটিস মনে করেন- বিষ্ময়, কৌতূহল, সংশয়, জিজ্ঞাসা, প্রয়োজনবোধ এবং জ্ঞানপ্রীতি থেকে দর্শন চিন্তার উৎপত্তি। দর্শন চিন্তার মূলে কাজ করেছে মানুষের মহান মানবিক মূল্যবোধ। এই মানবিকতা মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে মানুষ পৃথিবীতে তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর দর্শনের তিনটি কাজ- অনুধ্যানমূলক, সমালোচনামূলক ও গঠনমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবজাতির বিকাশের ধারায় যত সঙ্কট সামনে এসেছে তার মূলে রয়েছে নীতি- নৈতিকতার সঙ্কট। মানব জীবনে সব ধরনের দুঃখ দুর্দশার মূলেও রয়েছে নৈতিক সঙ্কট। এসব সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারবে না বিজ্ঞান প্রযুক্তি, পারমাণবিক অস্ত্র, ইন্টারনেট, কম্পিউটার কিংবা অফুরন্ত সম্পদ। উত্তরণের একমাত্র উপায় নৈতিক শিক্ষা। যা ব্যতীত বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও সাফল্য কোন ভাল ফল বয়ে আনবে না, আর পৃথিবীর অফুরন্ত সম্পদও মানুষের কোন কাজে আসবে না। তাই পৃথিবীতে সর্বস্তরে সুখ, শান্তি ও কল্যাণের জন্য মানবজাতিকে আসতে হবে নৈতিক শিক্ষার মাতৃভূমি দর্শনের কাছে। সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিবেকবোধ, স্মৃতি, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। সমাজ ব্যবস্থা যেন অসচেতন ও অসংবেদনশীল হয়ে পড়ছে, হারিয়ে ফেলছে তার মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ব্যক্তি মানুষ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে দয়া, মায়া, মমতা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বন্ধন, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও মনুষ্যত্ব। আর তা হচ্ছে সঠিক ও নৈতিকতা সম্পৃক্ত মানবিক আদর্শিক শিক্ষার অভাবে। এরূপ বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথ হবে দর্শনের শিক্ষাগ্রহণ, অনুশীলন ও তার প্রয়োগ। দর্শনবিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক দিক থেকে খাদ্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসায়, প্রযুক্তিক দিক থেকে প্রাচুর্য আসবে কিন্তু কখনও সুখ বা শান্তি আসবে না। তাই দর্শন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি, অনুশীলন ও প্রয়োগ আজ সময়ের দাবি।
×