ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ত্রিংশ শতাব্দী’ ও ‘হেলেন কেলার’ প্রদর্শনীতে দর্শকের মুগ্ধতা;###;জাহিদ রিপন

জাপানে বাংলাদেশের স্বপ্নদল

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

জাপানে বাংলাদেশের স্বপ্নদল

পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মমতম অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলার ঘটনা-প্রেক্ষাপট-পরিণতি আর পরবর্তী যুদ্ধ-অনাচার-গণহত্যা প্রভৃতি নিয়ে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদলের যুদ্ধবিরোধী গবেষণাগার প্রযোজনা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’। নাট্যকার ও নাট্যতাত্ত্বিক বাদল সরকারের মূল রচনা থেকে এর রূপান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছি আমি। বাংলা নাট্যরীতির শিল্প সূত্র অবলম্বনে নির্মিত এ প্রযোজনায় বিভিন্ন সময়ে যৈক্তিকভবেই সংযুক্ত হয়েছে নানা হালনাাগাদ প্রসঙ্গ। তাই তো বর্ণিত নাট্যরীতির সাযুজ্যে উপস্থাপিত হয়েছে ধর্মের নামে আইএসের মধ্যপ্রাচ্যে বর্বরতা কিংবা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা, বর্বরতার শিকার নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দিদের তুরস্ক সাগরের তীরে মরে পড়ে থাকা কিংবা হলি আর্টিজানে জঙ্গীদের নির্মমতা অথবা সাম্প্রতিক বাসচাপায় শিক্ষার্থী হত্যার মতো নানা বিষয়। যুদ্ধ ও আণবিক অস্ত্র আর সমকালীন নানা অনাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য স্বপ্নদল গত ১৭ বছর ধরে নিয়মিতভাবে মঞ্চায়ন করে যাচ্ছি এ প্রযোজনাটির। শুধু তাই নয় জীবন ও শিল্পের অভেদ দায়ে ২০০২ থেকে জাপানের বাইরে একমাত্র নাট্যদল হিসেবে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-এর মঞ্চায়ন ও নানা আনুষ্ঠানিকতায় নিয়মিত ‘হিরোশিমা দিবস’ পালন করে আসছি আমরা। এ ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডের লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইউরোপের স্বনামখ্যাত নাট্যোৎসব ‘এ সিজন অব বাংলা ড্রামা ২০১৫’-এর আমন্ত্রণে দুটি এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় নাট্যোৎসব ‘ভারত রং মহোৎসব ২০১৫’-এ একটিসহ ভারতের নানা স্থানে আমন্ত্রিত হয়ে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-এর বেশ কিছু প্রদর্শনীও করেছি। এবারে আমরা আমন্ত্রিত হই জাপানের প্রধান নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ‘ফেস্টিভ্যাল/টোকিও ২০১৮’ থেকে, স্বনামখ্যাত টোকিও মেট্রোপলিটন থিয়েটারের থিয়েটার ওয়েস্ট মিলনায়তনে ৩রা ও ৪ঠা নবেম্বর ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-এর দুটি প্রদর্শনীর জন্য। পরবর্তীতে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আমাদের আমন্ত্রণ জানায় দূতাবাসের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে ৫ নবেম্বর আমন্ত্রিত বাংলাদেশী ও জাপানী অতিথিদের জন্য অপূর্ব কুমার কু-ুর রচনা থেকে আমার নির্দেশনায় স্বপ্নদলের ব্যতিক্রমী মনোড্রামা ‘হেলেন কেলার’-এর প্রদর্শনীর জন্য। স্বপ্নদলের দর্শনানুযায়ী ‘বিশ্বের বিস্ময়’ মহীয়সী নারী হেলেন কেলারের জীবন-কর্ম-স্বপ্ন-সংগ্রাম-দর্শনভিত্তিক মনোড্রামা ‘হেলেন কেলার’-এও প্রযুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যের ধারায় আধুনিক বাংলা নাট্যরীতি। প্রযোজনাটিতে একক অভিনয় করেন জুয়েনা শবনম এবং সাম্প্রতিক ভারতে প্রদর্শনীর মতো জাপানেও এটি হয় ব্যাপক সমাদৃত! আর দূতাবাসে ‘হেলেন কেলার’ মঞ্চায়নে সার্বিক সহযোগিতা করে বাংলাদেশ সাংবাদিক-লেখক ফোরাম, জাপান। জাপানের মূলধারার নাট্যোৎসবে প্রথম বাংলাদেশের নাট্যদলের প্রদর্শনী উপলক্ষে ‘ডিসাইফারিং বাংলাদেশ’ শীর্ষক ধারাবাহিক বক্তব্যের দ্বিতীয় দিনে ২ নবেম্বর আমার ‘থিয়েটার অব বাংলাদেশে টুডে : কন্টিনিউশন অব ট্রাডিশন এ্যান্ড মর্ডানিজম’ শীর্ষক বক্তব্যে বাংলা অঞ্চলের দীর্ঘ নাট্যধারাবহিকতার সূত্রসমূহ, উপনিবেশের কারণে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বাংলা নাট্যবিকাশের মধ্যখ-ন, উপনিবেশ-উত্তর বাংলা নাট্যরীতি সম্পর্কিত সচেতনতা এবং বর্তমানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে বাংলার নিজস্ব আধুনিক নাট্যরীতি বিনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি ছবি- আলোকচিত্র-অডিও-ভিডিও প্রভৃতি সহযোগে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি। প্রথম দিন টোকিও ফরেন স্টাডিজ বিশ^বিদ্যালয়র বাংলা বিভাগের শিক্ষক কিওটো নাইওয়া বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে এবং শেষ দিন ফুক্্ুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর রিনা ইগারাশি বাংলাদেশের ভিসুয়াল আর্ট সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। জাপান সফরের অরেকটি অর্জন দেশটির জাতীয় বেতার ‘এনএইচকে ওয়ার্ল্ড সার্ভিস’-এর আমন্ত্রণে আমার স্টুডিওতে একটি এবং প্রথম প্রদর্শনী শেষে মিলনায়তন থেকে অরেকটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার। কেমন হয়েছিল ‘ত্রিংশ শতাব্দী’র মঞ্চায়ন? আমাদের বিবেচনায় জাপানে প্রদর্শনী দুটি ছিল ‘ত্রিংশ শতাব্দী’র ১০২টি মঞ্চায়নের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। জাপানী সাবটাইটেল ছিল এবং নিজেদের পূর্বপুরুষের দুর্দশার ইতিহাস প্রত্যক্ষ করে জাপানী দর্শকরা এমনই একাত্ম হয়েছিলেন যে তারা অঝোর ধারায় কেঁদেছেন আর প্রদর্শনী শেষে প্রায় ৫-৭ মিনিট টানা করতালি দিয়েছেন। গ্রন্থিকেরা মঞ্চ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও চলতে থাকে হাততালি, ফলে পুনর্বার আমাদের মঞ্চে ফিরে আসতে হয়। দু’দিনই ঘটে এমন ঘটনা! ‘ত্রিংশ শতাব্দী’র দ্বিতীয় প্রদর্শনী শেষে উৎসবের নির্বাহী পরিচালক সাচিয়ো ইচিমুরার সঞ্চালনায় দর্শকের প্রশ্নোত্তর-মুক্তালোচনা পর্বের মুখোমুখি হই আমি। দর্শক বাংলা নাট্যরীতি ও ‘ত্রিংশ শতাব্দী’র ব্যাপক প্রশংসা এবং হিরোশিমা-নাগাসাকিসহ জাপানের সব শহরে প্রযোজনাটি মঞ্চায়নের দাবি জানান। আয়োজকরা দ্বিধাহীনভাবে খুব শীঘ্রই তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দেন। অনেকে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’কে চিহ্নিত করেন জাপানের বিস্মৃতিঘেরা নতুন প্রজন্মের জন্য এক নতুন যাত্রার পথনির্দেশরূপে! জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মান্যবর রাবাব ফাতিমা এবং কূটনীতিকদের মন্তব্যও এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। তারা বলেন, ‘হলি আর্টিজানের ঘটনার মধ্য দিয়ে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে যে দ্বিধা বা টানাপোড়েন প্রবেশ করেছিলো স্বপ্নদলের এ নাট্যসফর ও ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তা যেন একেবারে দূর হয়ে গেল!’ বলাবাহুল্য, এমন মন্তব্যের পর তো অনুভূতিপ্রবণ নাট্যকর্মী আমাদের আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, কারণ শিল্পের পতাকাতলে আমাদের পাশে তখন তো দাঁড়িয়ে গেছেন ষোলো কোটি বাঙালী আর সে সম্মান পৌঁছে গেছে তাদের প্রত্যেকের মস্তকে!
×